ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বিতর্ক

প্রকাশিত: ০৪:৪৬, ১২ এপ্রিল ২০১৭

ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস বিতর্ক

ডাক্তারদের বিশেষ করে সরকারী চাকরিজীবী ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়ে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনার ইতিহাস খুব নতুন নয়। প্রায়ই পত্রপত্রিকায় বিষয়টি নিয়ে লেখালেখিও হয় বিস্তর। অনেকে সমালোচনা করে বলছেন, ‘সরকারী ডাক্তার আবার প্রাইভেট প্র্যাকটিস কেন করবেন? বেতন তো পাচ্ছেনই তারা। সরকারী চাকরিরত ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা উচিত নয়। সরকারী ডাক্তাররা কাজে ফাঁকি দিয়ে প্রাইভেট প্র্যাকটিস আর ক্লিনিক ব্যবসা নিয়েই ব্যস্ত থাকেন।’ এ ধরনের সমালোচনা কখনও কোন অনাকাক্সিক্ষত ঘটনায় ক্ষোভের পরিপ্রেক্ষিতে, আবার কখনওবা আবেগপ্রসূত অতিকথন। সুধীজনদের কেউ কেউ এখানে মানবসেবার কোন উপলক্ষ খুঁজে পান না, বরং ডাক্তারদের বাণিজ্যের বিষয়টিকেই সামনে নিয়ে আসেন। কথায় কথায় ডাক্তারদের কপালে কাজের পুরস্কারের চেয়ে তিরস্কারটাই জোটে বেশি। সত্যিকার অর্থেই সরকারী চাকরিজীবী ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা কতটুকু উচিত বা একেবারেই উচিত নয়, পাশাপাশি এর ইতিবাচক আর নেতিবাচক দিকগুলোইবা কি কি এটা বিতর্কিত বিষয়। এ নিয়ে বাংলাদেশে কোন জরিপ কিংবা গবেষণা হয়েছে বলে আমার জানা নেই। যারা সমালোচনা করেন তারা তাদের নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গি ও যুক্তিতর্কের মাধ্যমেই নিজের বক্তব্য তুলে ধরেন। আবার যারা বিপরীত মেরুর তারাও যে খুব যৌক্তিকভাবে বিষয়টি খোলাসা করেছেন তাও নয়। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই বিষয়টি নীতিনির্ধারণের ক্ষেত্রে বিতর্কের মঞ্চে জায়গা পেয়েছে বেশি। মনে রাখতে হবে, আমাদের দেশে জনসংখ্যা বেশি, তাই স্বভাবতই রোগীর সংখ্যাও বেশি। সেই তুলনায় বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সংখ্যা অপ্রতুল। ১৬ কোটি মানুষের এ দেশে এখনও স্বাস্থ্যব্যবস্থা পুরোপুরি পিঠ সোজা করে দাঁড়াতে পারেনি। রাজধানীর বড় বড় কর্পোরেট হাসপাতাল আর বড় শহরগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার কিছুটা সহজলভ্যতা থাকলেও জেলা বা উপজেলা পর্যায়ে তা এখনও যে অনেকটাই নড়বড়ে অবস্থানে, এ কথা জোর গলায় অস্বীকার করার মতো নয়। সীমিত সম্পদ নিয়ে ১৬ কোটি মানুষের স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সরকারের পক্ষে আসলেই কঠিন। অসংখ্য রোগীর চিকিৎসাসেবার চাহিদা মেটাতে সরকারী প্রতিষ্ঠানগুলো মোটেও পর্যাপ্ত নয়। তার ওপর সামর্থ্যরে তুলনায় কয়েকগুণ বেশি সেবা দিতে গিয়ে কাক্সিক্ষত মান রক্ষাও সম্ভব হয় না। ফলে রোগীদের ক্ষোভ যেমন বাড়ে, আবার অনাকাক্সিক্ষত ঘটনাও ঘটে। স্বভাবতই সরকারী ডাক্তাররা অফিস টাইমের পরে তার নিজস্ব সময় অন্য কোন কাজে মনোনিবেশ না করে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে মনোনিবেশ করেন। যেসব রোগীর আর্থিক সঙ্গতি আছে এবং অনেকেই বিশেষ করে যারা ব্যবসায়ী, চাকরিজীবী বা অফিস টাইমে নানা কাজে ব্যস্ত থাকেন, তারা নিতান্ত বাধ্য হয়েই চিকিৎসাসেবা নিতে ছোটেন ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে বা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে। বিশ্বের সব দেশেই এ ব্যবস্থা চালু আছে। সরকারী চাকরি শেষ করে যখন বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের বিশ্রাম নেয়ার কথা তখন তারা নিজের আরাম-আয়েসকে বিসর্জন দিয়ে ছুটে যান প্রাইভেট চেম্বারে। ক্লান্তিকে পায়ে ঠেলে সেবা দিয়ে যান মুখ বুজে। বিপরীতে কিছু ফি তারা পান এটা সত্যি। কিন্তু ডাক্তারের টাকা রোজগারটাই অনেকে বড় করে দেখছেন, তাদের সেবা বা ত্যাগটা কি একেবারেই গৌণ হয়ে গেল? অনেকের অভিযোগ, সরকারী হাসপাতালে সময় কম দিয়ে বা কাজকর্মে ফাঁকি দিয়ে ডাক্তাররা প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিয়েই ব্যস্ত থাকেন, আর দু’হাতে শুধু পয়সা কামানোকেই তারা গুরুত্ব দেন বেশি। কথাটা একেবারে অযৌক্তিক নয়, আবার ঢালাওভাবে সব ডাক্তারের ক্ষেত্রে এ অভিযোগ সত্যও নয়। অধিকাংশ ডাক্তার এমন নন। কোন ডাক্তার যদি তার দায়িত্ব পালনের সময় প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন, সরকারীভাবে দায়িত্বপ্রাপ্ত প্রতিষ্ঠানের রোগীদের চিকিৎসাসেবা দেয়ার ক্ষেত্রে অবহেলা প্রদর্শন করেন, এটা অবশ্যই নিন্দনীয় এবং যথাযথ কর্তৃপক্ষের উচিত হবে দোষী ব্যক্তির উপযুক্ত শাস্তির বিধান করা। এমনও শোনা যায়, দায়িত্ব পালনকালে কোন কোন ডাক্তার সরকারী হাসপাতালে বসেই ফি নিয়ে থাকেন। এটাও গুরুতর অপরাধ এবং এমন ঘটনা রোধ করতে কর্তৃপক্ষের কঠোর হওয়া উচিত। কতিপয় ব্যক্তির অর্থলোভ আর অসাধুতা যাতে সামগ্রিকভাবে চিকিৎসা পেশার মতো মহান কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ত সবাইকে কালিমালিপ্ত না করতে পারে, এ ব্যাপারে ডাক্তারদের নিজেদেরও সোচ্চার হওয়া উচিত। যারা দিনের পর দিন নিজের কর্মস্থলে অনুপস্থিত থেকে প্রাইভেট প্র্যাকটিসকে ধ্যান জ্ঞান মনে করে নিয়েছেন, তাদের আমি যৌক্তিকভাবে নিজের অবস্থান চিন্তা করে দেখতে বলব। তাদের বিবেকের সঙ্গে বোঝাপড়া হওয়া দরকার। কেউ যদি সরকারী চাকরিতে থেকে নিজের দায়িত্ব যথাযথভাবে পালন না করেন, তবে তাদের বেতন নেয়াটা হালাল হবে তো? প্রাইভেট প্র্যাকটিস করার কথা এলেই অর্থ আয়ের কথা আসে। এ কথা ঠিক নয় যে, ডাক্তাররা শুধু টাকা-পয়সাই কামাচ্ছেন। তারা সার্ভিসের বিনিময়ে ফি নিচ্ছেন; কিন্তু রোগীর সেবা কি একেবারেই হচ্ছে না? যিনি বলেন, ডাক্তারদের প্রাইভেট প্র্যাকটিস করা উচিত নয়, তিনি কি একবারও ভেবে দেখেছেন, সরকারী অফিস টাইমের পরে নিজে বা তার ছেলে-মেয়ে, বাবা-মা, ভাইবোন যদি গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়েন, তখন তিনি কোথায় যাবেন বা কি করবেন? আর সে অবস্থায় যদি একজন বিশেষজ্ঞ সরকারী ডাক্তারকে রোগী দেখতে অনুরোধ করা হয়, তখন ওই ডাক্তারের ভূমিকাইবা কি হবে? কারণ, প্রাইভেট প্র্যাকটিস নিষিদ্ধ হলে ডাক্তার তো আইনগতভাবে তখন ওই রোগী দেখতে পারবেন না এবং অফিস টাইমের পরে ডাক্তার তার সেবা দিতে বাধ্য নন। সাধারণ বা গুরুতর কোন রোগীর অনুরোধে তাকে চিকিৎসাসেবা দিতে গিয়ে আইন লঙ্ঘন বা বেআইনী কাজ হবে কিনা? আইনগতভাবে কোন রোগী অফিস টাইমের পরে ডাক্তারের চিকিৎসা নিতে অনুরোধ করতে পারবেন কি? এমনকি প্রচুর টাকার বিনিময়েও যারা প্রভাবশালী বা নীতিনির্ধারক, তারা অসুস্থ হলে তাদের কি তখন নৈতিকভাবে উচিত হবে অসময়ে বা ডিউটি আওয়ারের পরে একজন ডাক্তারকে রোগী দেখাতে অনুরোধ করা? আইন সবার জন্যই সমান। যারা আইন করছেন তারা যদি বিপদে পড়ে ডাক্তারদের শরণাপন্ন হন, তখন ডাক্তারের করণীয়ইবা কি হবে? আইনের ফাঁকতালে পড়ে কোন রোগী যদি এ অবস্থায় যথাযথ চিকিৎসাসেবা না পায়, তাহলে তা কি মানবাধিকার লঙ্ঘন হবে না? আইন প্রণেতারা কি এর দায় এড়াতে পারবেন? ডাক্তারের বিরুদ্ধে আবার নতুন করে কোন অভিযোগ আসবে কি-না? পরবর্তীতে ডাক্তারের কাঁধেই সব দায় চাপিয়ে দোষারোপের পাহাড় গড়া হবে না তো? একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যদি নিপীড়িত অসুস্থ মানুষের মুখে হাসি ফোটানোর কাজে ব্রত হন যে কোন সময়, সেটা কি অন্যায় হতে পারে? যারা সচ্ছল তারা নামী-দামী প্রাইভেট ক্লিনিক বা হাসপাতালে চিকিৎসা নিতে যান। এখন কথা হলো, বেসরকারী প্রতিষ্ঠানগুলোতে এই সেবা কে দেবে? অপ্রিয় সত্য হলো হাতেগোনা কিছু বড় হাসপাতাল বাদে অধিকাংশ ক্লিনিক বা হাসপাতালেও কিন্তু সরকারী চাকরিরত অনেক বিশেষজ্ঞ ডাক্তার অফিস টাইমের পরে সেবা দিয়ে থাকেন। কারণ বিশেষজ্ঞের সংখ্যা সেখানেও সীমিত। টাকা দিয়ে যন্ত্র বানানো যায়, ডাক্তার তো বানানো যায় না! একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার তৈরি হতে যুগ পেরিয়ে যায়। তাহলে এই প্রতিষ্ঠানগুলোতে সেবা দেবে কারা? প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধের ফলে ওই সমস্ত ক্লিনিক বা হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা পেতেও যথেষ্ট অসুবিধা হওয়ার সম্ভাবনাই কিন্তু বেশি। ফলে রোগীদের ভোগান্তিই বাড়বে বৈকি। যদি আইন করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করা হয় তবে ডাক্তাররা কিন্তু নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অফিসে থাকবেন, রোগীর চিকিৎসা দেবেন, কোন ক্লিনিকে যেতে পারবেন না, বিকেলে চেম্বারে রোগী দেখতে পারবেন না। এতে ডাক্তারদের হয়ত কিছু আর্থিক ক্ষতি হবে; কিন্তু রোগীরা তো গুরুত্বপূর্ণ সার্ভিস থেকে বঞ্চিত হবেন। ডাক্তারদের ক্ষতির চেয়ে রোগীদের ভোগান্তিটাই বেশি হবে। বিশেষ করে সাধারণ রোগ-ব্যাধিতে হাসপাতালে না গিয়ে ডাক্তারের প্রাইভেট চেম্বারে দেখাতে যারা স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন, তাদের ভোগান্তি আরও বাড়বে। দেখা যায় কিছু জটিল রোগীও বহুদূর থেকে সরাসরি চেম্বারে আসেন। আজকেই ডাক্তার দেখাতে না পারলে তাদের থাকার জায়গা নিয়ে ভোগান্তি পোহাতে হবে। ডাক্তারকে দেখিয়ে তারা ওইদিনই হয়ত নিজ বাড়িতে ফিরে যাবেন। রোগীর লোকজনের কাকুতিভরা অনুরোধ ‘স্যার বাঁচান, যত টাকা লাগে কোন অসুবিধা নেই, আমার ছেলেটারে বাঁচান।’ এখন ডাক্তারের কি করা উচিত? তাকে দেখে দেয়া, নাকি ক্লান্ত নিজেকে বিশ্রামের সুযোগ দেয়া? মানবিক কারণেই রোগীর চিকিৎসা দেয়ার পরে এ কথা কি বলা উচিত হবে, এই বিপন্ন রোগীদের টাকার লোভই আমাকে প্রচণ্ড ক্লান্তির মধ্যেও চিকিৎসা দিতে বাধ্য করেছে? এতটা অমানবিক দৃষ্টিভঙ্গিতে কেন দেখা হয় ডাক্তারদের? প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ হলে এ অবস্থায় দূর-দূরান্ত থেকে আগত কোন রোগী যদি চিকিৎসাসেবা না পায়, তাহলে আবারও মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে কোন অভিযোগ আসবে কিনা বা এটা নিয়ে কোন প্রশ্ন উঠবে কিনা? ॥ দুই ॥ অনেকে মনে করেন ডাক্তাররা শুধু টাকাই রোজগার করেন, ডাক্তারদের অর্থোপার্জনের সুযোগকে কটাক্ষ করতেও ছাড়েন না। কেউ কেউ মনে করেন ডাক্তাররা টাকা উপার্জনকেই ধ্যান-জ্ঞান করে নিয়েছেন, সেবার কথা সব বোগাস। আসলেই কি তাই? ডাক্তাররা টাকা নিচ্ছেন এটা সত্যি; কিন্তু সার্ভিস দেয়ার বিনিময়েই তো নিচ্ছেন। পৃথিবীর কোথাও কি এমন কোন পেশা রয়েছে, যেখানে কেউ সার্ভিস দেবেন, আন্তরিকভাবে শ্রম দেবেন অথচ পারিশ্রমিক নিতে পারবেন না? সেবার বিনিময়ে ডাক্তারদের ফি’ইবা কত? যেখানে একজনের জীবন বাঁচাতে সার্ভিস দিয়ে তার বিনিময়ে ফি নেয়া হচ্ছে, এটা কি পরিমাণে খুব বেশি? এই বিষয়গুলোও বিবেচনায় আনতে হবে। ডাক্তারি তো একটা পেশা। কাজেই তারা প্র্যাকটিস করতেই পারেন। এখানে তো আইনগত কোন বাধ্যবাধকতা থাকার কথা নয়। অফিস টাইমের পরে প্রাইভেট প্র্যাকটিসে ডাক্তাররা যে সময় দেন তা তার নিজস্ব সময়। যে সময়ে বিকেলে বা রাতে অনেকেই ক্লাবে, সিনেমায়, পার্কে বা অন্য কোনভাবে সময়টা উপভোগ করেন, সে সময়টাতে ডাক্তার প্র্যাকটিস করে রোগীর সেবা দিচ্ছেন। নিজের আরাম-আয়েস বা ভোগ-বিলাস বিসর্জন দিয়ে অফিস টাইমের পরে রোগীর জন্য সময় দেয়াটা কি খুব অন্যায়? অনেক চাকরিজীবী তার চাকরির সময়ের বাইরেও অন্য কাজকর্ম বা ব্যবসা-বাণিজ্য যদি করতে পারেন তবে ডাক্তাররা সরকারী চাকরি করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করতে পারবেন না কেন? ॥ তিন ॥ ডাক্তারদের বিরুদ্ধে আরও একটা অভিযোগ ঢাকা বা অন্য বড় শহরের বাইরে গিয়ে প্রত্যন্ত অঞ্চলে ছুটির দিনে প্রাইভেট প্র্যাকটিস করেন। এখানে ডাক্তারদের কি অপরাধ তা বোধগম্য নয়। একজন বিশেষজ্ঞ ডাক্তার যদি ঢাকা থেকে প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে একজন জটিল রোগীর অপারেশন করেন বা একজন রোগীকে দেখে চিকিৎসাসেবা দেন, এতে কি ওই রোগীটার লাভ হলো না? কোন জটিল রোগীকে যদি প্রত্যন্ত অঞ্চল বা গ্রাম থেকে ঢাকা বা অন্য শহরে প্রাইভেট চেম্বারে এসে চিকিৎসা নিতে হয়, তাতে তার ভোগান্তিও কম হয় না। রোগীর সঙ্গে আরও কয়েকজন আত্মীয়-স্বজন বা সাহায্যকারীর প্রয়োজন পড়ে। টাকা-পয়সা থেকে শুরু করে যাতায়াত, থাকা-খাওয়া সব মিলিয়ে তার অবস্থা কি দাঁড়াবে? বড় শহরে এসে সঙ্গে সঙ্গেই কি চিকিৎসা পাওয়া সম্ভব? জরুরী প্রয়োজনে সব সময় সরকারী হাসপাতালে চিকিৎসা পাওয়া বা ভর্তি হওয়া সম্ভব হবে কি? সে অবস্থায় হোটেলে থেকে তাকে আরও বাড়তি খরচের ঝামেলা কি পোহাতে হবে না? তার পরিবারের অবস্থাটাইবা কি হবে? তাই একজন ডাক্তার যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ঘরের দুয়ারে গিয়ে একজন রোগীর অপারেশন বা চিকিৎসাসেবা দিয়ে আসেন, তাতে রোগীর লাভই তো বেশি। এতে রোগীর ভোগান্তি এবং টাকা-পয়সার সাশ্রয় সবই তো হয়। ছুটির দিনে পরিবার-পরিজনকে সময় না দিয়ে, আরাম-আয়েসকে বিসর্জন দিয়ে বিশেষজ্ঞ ডাক্তার প্রত্যন্ত অঞ্চলে গিয়ে রোগীর যতটুকু সম্ভব সেবা দেয়াটা কি খুব খারাপ বা অন্যায় হয়ে যায়? এর কি কোন মূল্যই নেই? ॥ চার ॥ অনেক ডাক্তারের বিরুদ্ধে ওষুধ কোম্পানির বা ক্লিনিক বা ডায়াগনস্টিক সেন্টারের কাছ থেকে পারসেন্টেজ নেয়ার অভিযোগ আছে। কথাটা বাজারে চালু আছে এবং আংশিকভাবে সত্যও। তবে ঢালাও অভিযোগ দিয়ে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করানো অযৌক্তিক। পৃথিবীর বিভিন্ন পেশার সব মানুষ কি ভাল? সবার সততার মান কি এক রকম হয়? সব ডাক্তার সমান না। তাই কেউ যদি অসদুপায় অবলম্বন করেন, সেটা অবশ্যই অন্যায় এবং অনৈতিক। এক্ষেত্রে প্রশাসনকেই খুব সোচ্চার হতে হবে। প্রয়োজনে তাদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিতে হবে। ॥ পাঁচ ॥ বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের চেম্বারে ফি নিয়েও অনেকের অভিযোগের শেষ নেই। ডাক্তারের ফি’ইবা কত? একজন রোগীর জীবন বাঁচানোর বিনিময়ে যে ফি নেয়া হয়, তা কি অন্য পেশাজীবীদের চেয়ে খুব বেশি? এ কথা সত্য যে, একেকজনের ফি একেকরকম, অনেকের ফি হাজার টাকারও বেশি। এ ব্যাপারে বিএমডিসি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বা যারা নীতিনির্ধারক তারা ডাক্তারদের ফি নির্ধারণে একটি সুন্দর নীতিমালা তৈরি করতে পারেন। ডাক্তারদের ফি একটা নিয়মের মধ্যে নিয়ে এলে এ অভিযোগগুলো আর শুনতে হবে না, রোগীরাও উপকৃত হবেন। আরেকটি কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, ডাক্তারদের ফি’র চেয়ে ওষুধপত্র, পরীক্ষা-নিরীক্ষার বা অপারেশনের খরচ এমনকি প্রাইভেট হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ভাড়া বা অন্যান্য খরচ আসলেই অনেক বেশি। গরিব ও বহু মধ্যবিত্তের পক্ষে চিকিৎসার খরচ মিটানো অসম্ভব। সেদিকেও নীতিনির্ধারকদের নজর দেয়া উচিত এবং চিকিৎসাসেবা যাতে জনগণের জন্য সহজলভ্য হয় সে ব্যাপারে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। পরিশেষে বলা যায়, আমাদের মতো গরিব দেশে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সংখ্যা সীমিত। তাই বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা যদি অফিস টাইমের পরে প্র্যাকটিস না করেন, সেবা না দেন, তবে রোগীরা যাবেন কোথায়? বিশেষ করে জটিল ও গরিব মধ্যবিত্ত রোগীরা পড়বেন বেশি সমস্যায়। বিত্তশালীরা হয়ত উন্নত দেশের বড় হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে পারবেন। আর অনেকেই বিদেশগামিতার দিকে ঝুঁকে পড়বেন বেশি। তাই আইন করে প্রাইভেট প্র্যাকটিস বন্ধ করে দিলে পুরো চিকিৎসাব্যবস্থা যেন হুমকির মুখে না পড়ে সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে। এর দায়-দায়িত্ব তখন সংশ্লিষ্টদের ওপরই বর্তাবে। লেখক : ডিন, মেডিসিন অনুষদ, অধ্যাপক, মেডিসিন বিভাগ, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়
×