ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রক্তাক্ত নীল নদের তীর

প্রকাশিত: ০৪:৪৫, ১২ এপ্রিল ২০১৭

রক্তাক্ত নীল নদের তীর

নীল নদের তীরের প্রাচীন সভ্যতার ধারক মিসরে আবারও জঙ্গী হামলার ঘটনা ঘটেছে। যা হৃদয়বিদারক। ফের একটি রবিবার। ফের হামলা গির্জায়। জোড়া হামলায় আক্রান্ত হলো সংখ্যালঘু খ্রীস্টানরা। এক সঙ্গে দুটো গির্জায় বিস্ফোরণে মৃত্যু হয়েছে কমপক্ষে ৪৫ জনের। আহতের সংখ্যা শতাধিক। এই ঘটনার পরে দেশজুড়ে তিন মাসের জরুরী অবস্থা ঘোষণা করা হয়েছে। মিসরের নয় কোটি বিশ লাখের বেশি জনসংখ্যার মধ্যে দশ ভাগেরও এক ভাগ কপটিক খ্রীস্টান। এর আগে গত ডিসেম্বরের এক রবিবারে রাজধানী কায়রোর একটি ভিড়ে ঠাসা গির্জায় এভাবেই হামলা চালিয়েছিল ইসলামী জঙ্গী সংগঠন আইএস। মারা গিয়েছিলেন ঊনত্রিশ জন। এবারও সেই ‘সানডে মাস’-এর ভিড়কেই কাজে লাগিয়েছে জঙ্গীরা। পবিত্র ‘মাস সানডে মাস’-এর জন্য জড়ো হওয়া ভক্তদের ভিড় এক মুহূর্তে পাল্টে গিয়েছে হুড়োহুড়ি কান্না, আতঙ্ক আর আর্তনাদে। আইএসের মুখপাত্র আমাক নিউজ এজেন্সি দাবি করেছে যে, আইএসের অংশ একটি দল দুটি গির্জায় হামলা চালিয়েছে। এবারের হামলাও ছিল পূর্বের মতো আত্মঘাতী। আগামী সপ্তাহের শেষদিকে ইস্টার সানডে। তার আগের রবিবারকে বলা হয় ‘পাম সানডে।’ যিশুখ্রিস্টের জেরুজালেম প্রবেশের এই দিনটাকে খুবই পবিত্র বলে ধারণ করেন খ্রীস্টানরা। হামলাকারীদের ভাষ্য যে, ২০১৩ সালে ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড নেতা প্রেসিডেন্ট মোহাম্মদ মুরসিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সেনাবাহিনীকে ক্ষমতায় বসানোর পেছনে কপটিক খ্রীস্টানরা সহায়তা করেছে। এই কারণে তাদের ওপর পড়শি মুসলিম সম্প্রদায়ের হামলার ঘটনা লেগেই থাকত। ২০১৪ সালের পর থেকে সেই ছবিটা পাল্টাতে শুরু করে। দেখা যায় ইরাক, সিরিয়ার মতো মিসরের সংখ্যালঘুদের ওপর বর্বরোচিত আক্রমণ শানাতে শুরু করে আইএস। ২০১৫ সালে সিরিয়ায় কর্মরত একুশ জন খ্রীস্টানকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। তাদের আতঙ্কে সিনাই উপদ্বীপ থেকে শত শত খ্রীস্টান ইতোমধ্যেই আশ্রয় নিয়েছেন প্রতিবেশী দেশে। ধর্মীয় বিভেদ ও সংঘাত সাম্প্রদায়িক হানাহানিতে পর্যবসিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। প্রথম বিস্ফোরণটি ঘটে নীল বদ্বীপ অঞ্চলের তানতা শহরের সেন্ট জর্জ গির্জায়। কায়রো থেকে প্রায় এক শ’ বিশ কিলোমিটার দূরের এই ছোট শহরে কপটিক খ্রীস্টানদের একটি বসতি রয়েছে। সকাল দশটা নাগাদ ভিড়ে ঠাসা প্রার্থনা কক্ষের সামনের সারিতে আচমকা বিকট আওয়াজ শোনা যায়। আগুনের গোলা তখন ছড়িয়ে পড়েছে চারদিকে। গির্জা কক্ষের চারদিকে ছড়িয়ে রয়েছে দেহ। কেউ নিহত, কারও দেহে তখনও রয়েছে প্রাণের স্পন্দন। কিন্তু শরীর থেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে গিয়েছে দেহাংশ। দ্বিতীয় বিস্ফোরণস্থল উপকূলবর্তী প্রাচীন শহর আলেকজান্দ্রিয়ার সেন্ট মার্কস কপটিক গির্জার বাইরে। ভিড়ের মধ্যে হামলায় নিহত হয় ষোলো জন। আহত একচল্লিশ জন। গির্জার ভেতরে থাকা প্রার্থনারত পোপ অক্ষত রয়েছেন। একজন আত্মঘাতী হামলাকারী গির্জার বাইরে বিস্ফোরণ ঘটায়। আগামী ২৮ ও ২৯ এপ্রিল ক্যাথলিক খ্রীস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিসের কায়রো সফর নির্ধারিত রয়েছে। সেখানে কপটিকদের সঙ্গে তার মিলিত হওয়ার কথা রয়েছে। ঘটনার পর পরই ভ্যাটিকানে হাজার হাজার ভক্তের সামনে পোপ বলেছেন, সন্ত্রাস, হিংসা আর মৃত্যুর বীজ যারা নিজেদের হৃদয়ে বপন করে, স্রষ্টা তাদের আত্মা বদলে যেন দেয়, সেই কামনা করেন তিনি। সিরিয়া, ইরাক, ইয়েমেন, লিবিয়ার অশান্ত পরিবেশের পাশাপাশি মিসর অনেকটা শান্ত থাকলেও আইএস জঙ্গীরা যে সে দেশে ঘাঁটি গেড়েছে তা বলাই বাহুল্য। মুসলিম ব্রাদারহুড নামক কট্টর ইসলামপন্থী দল মিসরে ক্ষমতাচ্যুত হলেও তাদের দাপট এখনও বহাল রয়েছে। ইরাক ও সিরিয়া থেকে পিছু হটা আইএস মিসরেও আশ্রয় নিতে পারে। তবে তাদের প্রতিহত ও নির্মূল করা সহজসাধ্য নয়। পরিস্থিতি যেদিকে যাচ্ছে, তাতে আগামীতে মিসরও হয়ে উঠতে পারে আইএস জঙ্গীদের অশুভ তৎপরতার কেন্দ্র। প্রাচীন সভ্যতার ধারক দেশটি রক্তাক্ত হয়ে উঠুক, প্রকম্পিত হোক বোমার শব্দে, বিপন্ন হোক সাধারণের জীবনÑ এটা কারও কাম্য হতে পারে না। জঙ্গী নির্মূলে মিসরের পাশে বিশ্ববাসী এসে দাঁড়াকÑএমন প্রত্যাশা আমাদেরও।
×