ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

তিস্তার উজান ও ভাটিতে ১৫ হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত হচ্ছে

প্রকাশিত: ০৬:০২, ১১ এপ্রিল ২০১৭

তিস্তার উজান ও  ভাটিতে ১৫  হাজার কিউসেক পানি প্রবাহিত  হচ্ছে

তাহমিন হক ববি, তিস্তা ব্যারাজ ডালিয়া থেকে ॥ উজানের গজলডোবা ব্যারাজের জলাধারে পানি ধারণ ক্ষমতা কত এটি সঠিকভাবে জানা না গেলেও ২০১২ সালের ১৯ জুলাই বাংলাদেশের অংশের তিস্তায় বড় ধরনের ঢল নেমেছিল। সে সময় গর্জন দিয়ে যে ঢল এসেছিল, তার পানি প্রবাহ ছিল দেড়লাখ কিউসেক। সে সময় স্মরণকালের উজানের ঢল যেমন রের্কড ভঙ্গ করেছিল তেমনি বাংলাদেশ অংশের ডালিয়া পয়েন্টে তিস্তার প্রবাহ ছিল একটানা ৪২ ঘণ্টা বিপদসীমার ওপরে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের তিস্তা ব্যারাজ কন্ট্রোল রুম সূত্রমতে, উজানের গজলডোবা ব্যারাজের মাধ্যমে তিস্তা নদীর নিয়ন্ত্রণ থাকায় ওই সময় দেড়লাখ কিউসেক পানির প্রবাহে তিস্তা অববাহিকা ভেসে গিয়েছিল। জারি করা হয়েছিল রেড এ্যালার্ট। এর আগে ২০০৭ সালে তিস্তা ৩০ ঘণ্টাব্যাপী বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়। আরেক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ৮৮ ও ৯৬ সালে বন্যার সময় তিস্তা ১৬ ঘণ্টা বিপদসীমার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে রেকর্ড গড়েছিল। এর পরের বছরগুলোতে তিস্তার পানি বিপদসীমার ওপর গেলেও তা ৪ থেকে ৫ ঘণ্টার ওপর স্থায়ী ছিল না। সূত্র মতে, ২০১২ সালের জুলাইয়ে ভারতের শিলিগুড়ির কাছে মহানন্দা নদীর বাঁধ পানির চাপে বিধ্বস্ত হওয়ায় উজানে ভারতের বেশ কিছু নদ-নদীর পানির প্রবাহ ঘুরিয়ে দেয়া হয়েছিল তিস্তা ও তোর্সা নদীমুখী। আর পানির চাপ ধরে রাখতে না পারায় গজলডোবা ব্যারাজ থেকে সে সময় এক লাখ ৪২ হাজার কিউসেক পানিও ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। অপরদিকে এবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরে যাওয়ার চারদিন আগে থেকেই শুকিয়ে যাওয়া তিস্তায় হঠাৎ উজানের ঢল নামে। সেই ঢল অব্যাহত রয়েছে তিস্তায় এখনও। বর্তমানে তিস্তা নদীতে উজান ও ভাটি এলাকায় ১৫ হাজার কিউসেকের ওপর দিয়ে পানি প্রবাহিত হচ্ছে। এদিকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৪ দিনের ভারত সফরের দ্বিতীয় দিন গত শনিবার নয়াদিল্লীতে রাষ্ট্রপতি ভবনে অনুষ্ঠিত নৈশভোজে তিস্তায় পানি নেই, তাই তিস্তা নিয়ে বিকল্প প্রস্তাব দেন পশ্চিমবঙ্গের মমতা ব্যানার্জি তোর্সা নিয়ে। মমতা ব্যানার্জির তোর্সা নিয়ে আলোচনার বিষয়টি তিস্তাপারের মানুষজনের কাছে সুবিধা হিসেবে ঠেকেনি। কারণ, তিস্তা নদীর সঙ্গে তোর্সার সম্পর্ক ভিন্ন। আর তিস্তায় যদি উজানে পানি না থাকে তাহলে ২০১২ সালে দেড়লাখ কিউসেক পানি এলো কেমন করে, এমনও প্রশ্ন নাড়া দিয়েছে তিস্তা অববাহিকার মানুষজনের কাছে। স্থানীয় পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্র মতে, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার কালিগঞ্জ জিরো পয়েন্ট হতে ৬৫ কিলোমিটার অদূরে তিস্তা নদীর ওপর গজলডোবা ব্যারাজ। আর গজলডোবা ব্যারাজ হতে তিস্তা নদীর ২০ কিলোমিটার ভাটিতে জলঢাকা ও তোর্সা নদীর মুখ। ফলে সে স্থানটিকে বলা হয় দোমহনী। তিস্তা নদীর যে পানি আসে সেই পানি জলঢাকা নদী ও তোর্সা নদীতে প্রবাহিত হয়। যা তিস্তা নদীর গজলডোবা ব্যারাজ নিয়ন্ত্রিত। সূত্র মতে তোর্সা এক সময় একটি আন্তর্জাতিক নদী ছিল। এটি পূর্ব তিব্বতে উৎপন্ন হয়ে চুম্বি উপত্যকার মধ্য দিয়ে ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। নদীটির আনুমানিক দৈর্ঘ্য ৩২০ কি.মি.। তিব্বত ও ভুটানে এই নদীর নাম আমুচু। এরপর নদীটি দক্ষিণ দিকে প্রবাহিত হয়ে ভারতের কোচবিহারের ভেতর দিয়ে লালমনিরহাট হয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আর ধানসাই নদীটি হচ্ছে অসমের মূল নদী। বাংলাদেশে এর নাম ধানসিঁড়ি। এর উৎপত্তিস্থল নাগাল্যান্ডের ডিমাপুর পাহাড়ে। আর মানসাই নদী মানচিত্রেও খুঁজে পাওয়া যায় না। তাই বলা যেতে পারে তিস্তা নদীর সঙ্গে এসব নদীর কোন সংযোগ নেই। যে সংযোগটি এখন করা হচ্ছে তাও তিস্তার পানির ওপর নির্ভরশীল। হিমালয় থেকে উৎপত্তি হয়ে ভারতের সিকিম ও পশ্চিমবঙ্গের ভেতর দিয়ে যে তিস্তা প্রবাহিত হয়েছে, সেটির গুরুত্ব শুধু পানির মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এটি পরিবেশ ও প্রতিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অভিন্ন নদী। নদীর স্বাভাবিক প্রবাহ ব্যাহত করে কোন দেশ অন্য কোন দেশকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে না। পানিপ্রবাহের দিক দিয়ে গঙ্গা-ব্রহ্মপুত্রের পরেই তিস্তার অবস্থান। তাই বাংলাদেশের কাছে এই নদীটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অন্য ছোটখাটো নদী নিয়ে মমতা ব্যানার্জি যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা কীভাবে তিস্তার বিকল্প বলা হচ্ছে- এ নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। অপর একটি সূত্র জানায়, পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জীর নির্দেশে তিস্তা নদী নিয়ে একটি জরিপ করেছিলেন ভারতের নদী বিশেষজ্ঞ কল্যাণ রুদ্র। ২০১১ সালের ডিসেম্বের ওই জরিপের সময় কল্যাণ রুদ্র গণমাধ্যমকে বলেছিলেন প্রতিবছর তিস্তা দিয়ে যেমন ১০ মিলিয়ন টন পলি প্রবাহিত হচ্ছে তেমনই সিকিমসহ দার্জিলিং জেলায় নদীটির ওপর একাধিক জলবিদুত প্রকল্প গড়ে তোলার জন্যই তিস্তার জলপ্রবাহ অনেকটাই কমে গেছে। বেশ কিছু ক্ষেত্রে নদীটির গতিপথ পরিবর্তন লক্ষ্য করা গেছে। তবে তিনি গজলডোবা জলাধার হয়ে সারা বছর ঠিক কত পরিমাণ জল তিস্তা নদী দিয়ে বয়ে যায় তার হিসাব পাননি। এ ছাড়া তিস্তায় সারা বছর জলপ্রবাহ স্বাভাবিক রাখতে হলে যতটা সম্ভব তিস্তা গতিপথের বাধা দূর করতে হবে বলেও মন্তব্য করেছিলেন। কিন্তু কল্যাণ রুদ্রের সেই রিপোর্ট আর প্রকাশ করা হয়নি। নির্ভরযোগ্য সূত্র বলছে, গজলডোবা তিস্তা ব্যারাজ প্রকল্প পূর্ব ভারতের সবচেয়ে বড় সেচপ্রকল্প। এর ওপর প্রায় ৯ দশমিক ২২ লাখ হেক্টর জমির সেচের পানি নির্ভর করে। আর বিদ্যুত উৎপাদন হয় ৬৭.৫ মেগাওয়াট। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ সরকার এসব কারণ দেখিয়েই পানি বণ্টনে আপত্তি তুলে আসছে। ফলে ২০১১ সালে ভারতের সাবেক প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং এবং ২০১৫ সালে বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বাংলাদেশ সফরের সময় তিস্তা চুক্তি স্বাক্ষর করা সম্ভব হয়নি। ২০১৩ সালে প্রকাশিত এশিয়া ফাউন্ডেশন রিপোর্টে বলা হয়,তিস্তার ওপর প্রায় ৩০টি জলবিদ্যুত প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছে। যার থেকে ৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুত উৎপাদন হতে পারে। রিপোর্ট অনুযায়ী, এরই মধ্যে সিকিমে ৬টি বাঁধ নির্মাণ হয়ে গেছে। আর পশ্চিমবঙ্গের দার্জিলিং জেলায় আরও দুটি ছোট মাপের বাঁধের পরিকল্পনা রয়েছে। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর যাওয়ার আগে তিস্তার পানি বণ্টন বিষয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী সাম্প্রতিক এক সাক্ষাতকারে বলেছিলেন, বাংলাদেশ তার প্রিয়, কিন্তু তিনি পশ্চিমবঙ্গের চাষীদের সমস্যার মুখে ঠেলে দিতে পারেন না। আবার বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বৃহত্তর রংপুর, দিনাজপুর, বগুড়া ও আশপাশের উচ্চভূমি তিস্তা নদীর পানির ওপর নির্ভরশীল। এসব অঞ্চলের খাদ্যশস্য উৎপাদনে তিস্তার পানির বিকল্প নেই। শুষ্ক মৌসুমে যদি বাংলাদেশ এ পানি পায় তাহলে দেশের খাদ্য উৎপাদনের চিত্রও অনেকংশে বদলে যাবে। ডালিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, আট দিন ধরে উজানের ঢল অব্যাহত থাকায় তিস্তা নদী এখন উজান-ভাটিতে সমান তরিতে বয়ে চলেছে। এই পানিতে তিস্তার কমান্ড এলাকার ৬৫ হাজার হেক্টর জমি সেচ পাচ্ছে।
×