ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

মমতাজ লতিফ

এ কেমন অনুষ্ঠান?

প্রকাশিত: ০৪:০২, ১১ এপ্রিল ২০১৭

এ কেমন অনুষ্ঠান?

বাংলাদেশে এই প্রথম ইন্টারপার্লামেন্টারি ইউনিয়নের ১৩৬তম সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হলো। সেদিক থেকে এটি দেশের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ আন্তর্জাতিক ইভেন্ট, যাতে ১৩৭টি রাষ্ট্রের ৭০০ জন সংসদ সদস্য ও স্পীকার অংশগ্রহণ করেছেন। এই অনুষ্ঠান আয়োজন করতে গিয়ে বড় ধরনের জঙ্গী হামলা ও নাশকতার ঘটনা ঘটিয়ে বিশাল ক্ষয়ক্ষতি করে অনুষ্ঠানটিতে বিদেশীদের অংশগ্রহণকে অসম্ভব করে তোলার মাধ্যমে সরকারকে এটি বাতিল করতে হয়- এমনি একটি গোপন হিসাব জঙ্গীদের হুকুমদাতা ও ব্যবহারকারীদের ছিল বলে ধারণা হয়। কেননা প্রথমত প্রতিটি জঙ্গী আস্তানায় রাখা হয়েছিল বিপুল পরিমাণ অত্যাধুনিক বিস্ফোরক দ্রব্য, বোমা, গ্রেনেড। দ্বিতীয়ত এই জঙ্গীরা কেউই আত্মসমর্পণ করে নিজেদের জীবন বাঁচাতে চাইল না- যা প্রমাণ করে এদের কাছে হুকুম ছিল পালাতে না পারলে আত্মঘাতী হতে হবে। অবশ্যই সীতাকুণ্ডে যে দু’জন জীবন্ত গ্রেফতার হয়েছে তাদের কাছ থেকে এসব জঙ্গীর নাম ও আস্তানার ঠিকানা পুলিশ জানতে পেরেছে এবং সম্ভবত এদের জঙ্গী তৎপরতার নেপথ্যের হুকুমদাতাদের নামও বেরিয়ে আসার সম্ভাবনা জঙ্গীরা বেঁচে থাকলে বেশি থাকে, সেটি সবার জানা। প্রশ্ন উঠেছে আমাদের পরিচিত সব বন্ধু, স্বজনের মনে যে, আইপিইউর সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠান এত মানহীন, হ-য-ব-র-ল হলো কেন? এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ১৩৭ রাষ্ট্রের সামনে বাংলাদেশের গর্বের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য খুবই সংক্ষিপ্ত, কিন্তু পরিচ্ছন্ন একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে তুলে ধরার বিরল সুযোগটিই কেন হেলাফেলা করে নষ্ট করা হলো? ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, বঙ্গবন্ধুর ভূমিকা নিয়ে ছোট্ট ভিডিও দেখানোটাই কী যথেষ্ট ছিল? শুরুতে স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, তারপর সাবের হোসেন চৌধুরী উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের সূচনাটি উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন। সঙ্গে প্রধানমন্ত্রীসহ অন্য দু’জনও সংক্ষিপ্ত বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর পারিবারিক ট্র্যাজেডি, বঙ্গবন্ধুর মতো জাতির জনকের হত্যা বড় মাপের শোক। তবু এ ধরনের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে জাতি সামরিক শাসকের হাতে কিভাবে ’৭৫-এ বঙ্গবন্ধু ও চার নেতা হত্যার পর আশাহীন এক অন্ধকারে ডুবে গিয়েছিল, গণতন্ত্র, উন্নয়ন পদক্ষেপও নিহত হলো, তার কয়েকটি বৈশিষ্ট্য উল্লেখ করে জাতি কিভাবে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে তা সংক্ষেপে বলে সম্মেলন উদ্বোধন করলে আরও ভাল হতো। তবু বলতেই হবে, এ পর্যন্ত ভালই হয়েছে। তারপর আমরা টিভি দর্শকেরা আশা করে আছি, হয়ত এখনই লালন অথবা শাহ আবদুল করিমের কোন একটি গান, মুক্তিযুদ্ধের কোন প্রাণমন স্পর্শ করা গান গেয়ে উঠবেন কোন খ্যাতিমান গায়ক বা গায়িকা, আমাদের জাতীয় সঙ্গীত রচয়িতা হিসেবে রবীন্দ্রনাথের গান, জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের গান থাকবে, স্ক্রিনে এসব গানের অর্থ সংক্ষেপে ইংরেজীতে লিখা থাকবে বিদেশীদের জন্য। থাকবে কয়েকটি ক্ষুদ্র নৃতাত্ত্বিক জাতিগোষ্ঠীর নৃত্য এবং সাধনা বা শর্মিলা, নীপা-শিবলী অথবা মুনমুন আহমেদের দলের একটি সুচারু উচ্চাঙ্গধর্মী নৃত্য। চ-ালিকা নৃত্যনাট্যের একটি খ-াংশ, যেখানে শ্রমণ সন্ন্যাসী চ-ালিকার হাতে জলপান করতে গিয়ে যে এক বৈষম্যহীন মানবতার কথা বললেন- ‘যে মানব আমি, সেই মানব তুমি কন্যা’- এ বার্তা হতো কতই না উপযুক্ত! ইংরেজীতে স্ক্রিনে কথাগুলো ভেসে উঠত। বিদেশীরা বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের উচ্চ মানবতাবাদী মর্মমূল উপলব্ধি করতে পারতেন। এসব কিছুই দেখা গেল না। দেখা গেল-মঞ্চে অপরিকল্পিত তরুণ-তরুণীদের ছোটাছুটি, হঠাৎ সেনা আক্রমণ, হঠাৎ নৌকা, হঠাৎ মণিপুরি নাচের এক ঝলক, এক ঝলক গারো নৃত্য, একদল শিশুর ছোটাছুটি ইত্যাদি! সত্যি বলতে এত বড় একটি সুযোগ ১৩৭ দেশের প্রতিনিধিদের সামনে মানবতাবাদী বাংলাদেশকে উপস্থাপন করা ঠিকমতো হলো না। একবার সূচনা অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের গণহত্যা, মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধু ও জেলে জাতীয় চার নেতা হত্যার বার্তাটি জানানোই ছিল যথেষ্ট। বার বার নানাভাবে একই ঘটনা প্রকাশের চেষ্টার ফলে ঘটনাগুলো মিলেমিশে কমজোরি হয়ে গেল। অথচ যা হতে পারত দর্শকের মনপ্রাণের ওপর একটি শোকের আঘাত। আবার নৃত্য-গীতের মাধ্যমে তা দর্শকের মন আনন্দ-বেদনার স্পর্শে ধন্য বোধ করত। অনুষ্ঠানের শেষে ‘স্টপ জেনোসাইড’ ছবিটির কিছু অংশ কয়েক মিনিট প্রদর্শন করে সেই ‘স্টপ জেনোসাইড’ বাক্যটি শুনতে শুনতে দর্শকদের মনে প্রবল অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারত। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হতো সম্মেলনের প্রধান থিম - গণহত্যার প্রতিবাদ। নৃত্য ও সঙ্গীতের ছোট অনুষ্ঠানের পর খুবই উপযুক্ত হতো বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর ওপর একটি সুন্দর ভিডিও প্রদর্শন। বাংলাদেশের ট্যুরিস্ট স্পটের ওপর সুন্দর সুন্দর ভিডিও তৈরি করেছে তরুণ নির্মাতারা এবং বিভিন্ন চ্যানেল। বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপস্থাপনের এবং বাংলাদেশ ভ্রমণে বিদেশীদের আমন্ত্রণ করার সবচাইতে ভাল সুযোগ ও সময় ছিল এটি। এ অনুষ্ঠানের পরিকল্পক কারা জানি না, তবে তাদের সৃজনশীলতা প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। কেননা এ অনুষ্ঠান দেখে আমরা নিজেরাই কোন থিম বা অর্থ উদ্ধার করতে পারছিলাম না। জানা কথা- বিদেশীরাও কিছু বোঝেননি। আগেই বলেছি, আমাদের যোগ্য স্পীকার শিরীন শারমিন চৌধুরী ও আইপিইউর প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরী উদ্বোধনী এ অনুষ্ঠানটিকে একটি উঁচু তারে বেঁধে দিয়েছিলেন। সেটি আর সে অবস্থানে রইল না। আমাদের প্রশ্ন, এত বড় মাপের সম্মেলনের অনুষ্ঠানের উদ্বোধনটিকে ছায়ানট, সুরের ধারা, সাধনাকে যৌথভাবে অথবা ছায়ানটকে এককভাবে পরিকল্পনা করার দায়িত্ব দেয়া হলো না কেন? আমাদের দুঃখ, আমাদের নিজস্ব দর্শন ও মাটি থেকে উঠে আসা সঙ্গীতের মনোমুগ্ধকর স্বাদ এই বিদেশীদের আমরা কেন দিতে পারলাম না? পরিকল্পকরা কি দেখেননি পশ্চিমবঙ্গের সা রে গা মা পা অনুষ্ঠানে কালিকাপ্রসাদ মাটির গান ও গ্রামের লোক গায়ক-গায়িকাদের তুলে এনে শ্রোতা ও বিচারকদের চমৎকৃত করেছেন। আমাদের লালনের গান, শাহ আবদুল করিমের গানকেও তাঁরা ব্যবহার করে তাঁদের অনুষ্ঠানটিকে উচ্চ মানে নিয়ে গেছেন। এগুলো তো শেখার বিষয়। কালিকাপ্রসাদের আকস্মিক মৃত্যুতে আমরাও পশ্চিমবঙ্গের মানুষের সঙ্গে অশ্রু ঝরিয়েছি। কেন একজন কালিকাপ্রসাদ এত কম সময়ে সব শ্রোতার মনে আসন গেঁড়ে বসেছেনÑ তা উপলব্ধি করতে হবে। সত্যি বলতে কি, ক্রিকেটের বিশ্বকাপ আয়োজনের সময় রাজপথের ধারে অরুচিকর সাজসজ্জা দেখে সংশ্লিষ্টরা সমালোচিত হয়েছিল, যা চোখের সামনে ছিল জাজ্বল্যমান। এত সমৃদ্ধ কাব্য, সাহিত্য, সঙ্গীত, দর্শন-পুঁথি সাহিত্যের ভা-ার এবং উপজাতিদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতি থাকার পরও একটি সুরুচিসম্পন্ন পরিশীলিত কিন্তু সংক্ষিপ্ত উপভোগ্য অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করা কোন কঠিন কাজ ছিল না। তবে যোগ্যতা ও আন্তরিকতার কমতি ছিল- তা বলাই বাহুল্য এবং এ পরিকল্পকদের মধ্যে ওবায়দুল কাদেরের ‘কাউয়া’, সুরঞ্জিৎ বাবুর ‘কালো বেড়াল’ অথবা ‘মুশতাক গং’ ছিল কিনা, তা অবশ্য জনগণের জানা নেই। লেখক : শিক্ষাবিদ
×