ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

‘দেশ বিক্রির’ ভাঙ্গা রেকর্ড খালেদা জিয়া আর কতবার বাজাবেন?

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১০ এপ্রিল ২০১৭

‘দেশ বিক্রির’ ভাঙ্গা রেকর্ড খালেদা জিয়া আর কতবার বাজাবেন?

মোয়াজ্জেমুল হক, চট্টগ্রাম অফিস ॥ রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তি আধিপত্য এবং মৌলবাদী, যুদ্ধাপরাধী, জঙ্গীসন্ত্রাসবাদীদের সঙ্গে ঐক্য গড়ে ক্রমাগতভাবে ভারতভীতি সৃষ্টির অপরাজনীতি অব্যাহত রাখার প্রেক্ষাপটে বিএনপি নামের রাজনৈতিক দলটি এখন অনেকটাই কফিনবন্দী। এ কফিনে শেষ পেরেকটি কখন মারা হচ্ছে তাই এখন দেখার অপেক্ষায় রাজনীতির সচেতন মহল। বিশেষজ্ঞ সূত্রসমূহের মতে, শুধু ক্ষমতায় যাওয়া এবং ব্যক্তি আধিপত্য সৃষ্টিতে অপতৎপরতা চালিয়ে দেশে জনবিধ্বংসী ঘটনার জন্ম দিয়ে কলঙ্কজনক অধ্যায় রচিত করেছে তাতেই এরা অনেকটা জনবিচ্ছিন্ন। তবে উগ্র মৌলবাদী, জঙ্গীসন্ত্রাস সৃষ্টিকারী ও তাদের সমর্থনকারীদের সমর্থনেই বিএনপির অপরাজনীতি। স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বিশেষ করে পঁচাত্তরের পটপরিবর্তনের পর মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র এবং চক্রান্তে যে বীজ বপন হয় তাতে ক্রমাগতভাবে চলেছে ইতিহাস বিকৃতি। বছরের পর বছর যুদ্ধাপরাধী ও স্বাধীনতাবিরোধীদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে বিএনপি ক্ষমতায় যেতেও সক্ষম হয়েছিল। এরা চিহ্নিত কয়েক যুদ্ধাপরাধীকে মন্ত্রিত্বের পদে বসিয়ে স্বাধীনতার পবিত্র পতাকা তুলে দিয়ে ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির প্রতি চরম উপহাসেরই শামিল। এদের অপরাজনীতির একটিই স্লোগান। আর তা হচ্ছে ভারতজুজুর ভীতি প্রদর্শন। কূটনৈতিক পর্যায়ে ভারতের সঙ্গে সম্প্রীতি বজায় রেখে দেশ ও স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যখনই তৎপর হয় তখনই এই দলটি এবং তাদের জোটভুক্তরা এর বিরোধিতায় নামে। সর্বশেষ এই উদাহরণ হচ্ছে গত ৭ এপ্রিল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফর এবং ২২ চুক্তি ও ৪ সমঝোতা স্মারক সম্পাদনের ঘটনা নিয়ে নতুন করে বিভ্রান্তি সৃষ্টিতে তৎপর হওয়া। অথচ, ভারতের সঙ্গে সুসম্পর্ক রেখে ইতোমধ্যেই বাংলাদেশের বহু অর্জন এসেছে। সর্বশেষ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরসূচী ঘোষণার পর থেকেই এদের চিল্লাহল্লার নতুন বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। মাঠে-ময়দানে মিডিয়ায় এ দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা যা বলে আসছেন তা অনেকটা ‘পাগলের প্রলাপ’ বলেই প্রতিভাত হয়েছে। কি চুক্তি হচ্ছে আর কি চুক্তি হবে না এর কোন যাচাই-বাছাই না করে শুরু হয়ে যায় অপপ্রচার। এটাই মূল বিএনপি ও এর জোটভুক্ত দলগুলোর অপরাজনীতির মূল বৈশিষ্ট্য বলে আওয়াজ উঠেছে। তিস্তা চুক্তি হয়নি। কিন্তু হবে বলে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা দিয়েছেন। এ নিয়ে তাদের কোন মাথাব্যথা নেই। অতীতেও অপরাজনীতির স্বার্থে অপপ্রচার চালানোর উদাহরণ রয়েছে ভূরি ভূরি। সেই মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি পরবর্তী সময়ে তারাই এটিকে অভিহিত করেছিল গোলামির চুক্তি হিসেবে। ঐতিহাসিক পার্বত্য শান্তি চুক্তির প্রাক্কালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া দফায় দফায় প্রকাশ্যে বলেছিলেন, এই চুক্তি দেশ বিক্রির চুক্তি। দেশের এক দশমাংশ চলে যাবে ভারতের নিয়ন্ত্রণে। শুধু তাই নয়, তিনি আরও বলেছিলেন, পার্বত্য চুক্তি সম্পাদিত হলে বাংলাদেশীদের সেখানে পাসপোর্ট নিয়ে যেতে হবে। বলেছিলেন, ক্ষমতায় গেলে তারা ওই চুক্তি বাতিল করবেন। কিন্তু ক্ষমতায় যাওয়ার পর দেখা গেল বেগম জিয়ার ওই ঘোষণা বাস্তবায়ন করেননি। অর্থাৎ কথার সঙ্গে কাজের মিল পাওয়া গেল না। কিন্তু তার এসব বক্তব্য সম্পূর্ণ অসার হিসেবেই প্রমাণিত হয়েছে। এসব ছাড়াও নির্বাচন এলেই বিএনপি অপপ্রচার চালায় এই বলে যে, আওয়ামী লীগকে ভোট দিলে এ দেশের মসজিদে মসজিদে উলুধ্বনি হবে। মুসলিম নর-নারীদের কপালে সিঁদুর ও হাতে শাখা পরতে হবে। বিস্ময়কর এসব বক্তব্য দিয়ে অপরাজনীতিতে চ্যাম্পিয়ন এ দল ও তাদের অনুসারীরা। বিষয়টি এখন আরও পরিষ্কার হয়েছে রাজনৈতিক বোদ্ধা মহল ছাড়িয়ে সাধারণ মানুষের মাঝেও। প্রসঙ্গত, ’৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে তৎকালীন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর নেতৃত্বাধীন সরকার যে নিঃস্বার্থ সাহায্য ও সহযোগিতা প্রদান করে এবং মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে সে দেশের সেনা সদস্যরা মিত্রবাহিনী হিসেবে রণাঙ্গনে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তারই বিনিময়ে বাঙালীর স্বাধীনতা অর্জন। ওই যুদ্ধে ৩০ লাখ বাঙালী শহীদ হওয়ার পাশাপাশি সে দেশের সেনাবাহিনীর বহু সদস্যও প্রাণ দিয়েছেন। এসব ঘটনা ইতিহাস স্বীকৃত। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা সাবেক প্রেসিডেন্ট জিয়াও ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছিলেন। অথচ তার প্রতিষ্ঠিত দলটি কথায় কথায় ভারতজুজুর ভীতি প্রদর্শন করে এ দেশের সাধারণ মানুষকে বিভ্রান্তির অতলগহ্বরে রেখেছিল বছরের পর বছর। আরও বিস্ময়কর ব্যাপার হচ্ছে, বেগম জিয়ার নেতৃত্বাধীন বিএনপি ’৯১ সালে প্রথমবারের মতো ক্ষমতায় আসার পর বাংলাদেশে ভারতীয় পণ্যের অবাধ আগমনের ঘটনার জন্ম নেয়। শুধু অপরাজনীতিকে বিভ্রান্তির মাধ্যমে এগিয়ে নিতে এরা একদিকে যেমন ইতিহাসকে বিকৃত করে রেখেছিল তেমনি সাধারণ মানুষকে বিশেষ করে নবপ্রজন্মকে দিগ্ভ্রান্ত করে রেখেছিল। এখনও সেই অপচেষ্টাই চালিয়ে যাচ্ছে ওরা। এ অভ্যাস তাদের বহু পুরনো। ‘কয়লা ধুলেও ময়লা যায় না’Ñ বলে বহুল প্রবাদের উদাহরণ হচ্ছে ইসলামী লেবাসের ধ্বজাধারী এ দলটি। মহান মুক্তিযুদ্ধ ও দেশের স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব নিয়ে যখনই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি সক্রিয় হয় তখনই এ দলটি ও জোটভুক্তরা ফণা তোলে। ছড়িয়ে দেয় সন্ত্রাসের বিষবাষ্প। রক্তে রঞ্জিত হয় নগর বন্দর ও গ্রামাঞ্চলে রাজপথ। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার যখনই প্রতিবেশী বন্ধু দেশ ভারতের সঙ্গে সখ্য বজায় রেখে এগিয়ে যেতে চায় তখনই বিএনপি প্রতিবন্ধকতার দেয়াল সৃষ্টি করতে তৎপর হয়। এর সর্বশেষ উদাহরণ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ৭ এপ্রিল থেকে ভারত সফর এবং চুক্তি ও সমঝোতা স্বাক্ষরের আগে এবং পরের তৎপরতা। ৮ এপ্রিল ২২ চুক্তি ও ৪ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের সঙ্গে সঙ্গেই বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বক্তব্য দিলেন এই বলে যে, ‘আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করেছেন। এছাড়া আজীবন ক্ষমতায় থাকার স্বপ্নে তিনি এর মধ্যে আরও অনেক কাজ করেছেন। এখন এ দেশের তিনি কিছুই রাখেননি, সবই বিক্রি করেছেন। আরও বোধহয় বাকি সেটা আছে সেটাও বিক্রি করে দেবেন। তিনি প্রধানমন্ত্রীকে এসব ব্যাপার নিয়ে হুঁশিয়ারও করে দিয়েছেন এই বলে যে, দেশ বিক্রি করে পৃথিবীর ইতিহাসে কেউ রক্ষা পায়নি।’ এছাড়া দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এবং যুগ্ম সম্পাদক রুহুল কবির রিজভীও এই বলে বক্তব্য দিলেন যে, দেশ ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। রাজনীতির বিশেষজ্ঞ সূত্রগুলো বলছেন, এসব বক্তব্য তাদের রেকর্ডকৃত এবং এর প্রচার চলে নিয়মিত। অপরাজনীতির সঙ্গে জড়িত থেকে এ দলটির কার্যক্রম এখন রীতিমতো কফিনবন্দী। এরা মুজিব-ইন্দিরা চুক্তিকে গোলামির চুক্তি আখ্যা দিয়ে নিজেদের অপরাজনীতিই উন্মোচন করেছিল। এর পরবর্তী সময়ে ভারতের সঙ্গে স্থল সীমানা চুক্তি, আন্তর্জাতিক আদালতে সমুদ্র সীমানার মামলায় বাংলাদেশের বিজয়কেও নেতিবাচক দৃষ্টিতে দেখেছে। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কূটনৈতিক সফলতার পাশাপাশি বিজয়ের ঘটনা মাইলফলক হিসেবে চিহ্নিত হলেও এদের গাত্রদাহ নিয়ত। বাংলাদেশের কূটনৈতিক সফলতায় দিল্লীর পার্ক স্ট্রীটটি এখন ‘বঙ্গবন্ধু সড়ক’ নামকরণ করা হয়েছে। ৮ এপ্রিল দুই দেশের মধ্যে সম্পাদিত চুক্তির দিনে শুরু হয়েছে খুলনা-কলকাতা-খুলনা ট্রেন চলাচল। দিনাজপুরের সীমান্ত দিয়ে বিরল পর্যন্ত হয়ে শুরু পণ্যবাহী ট্রেন চলাচল। এছাড়া সড়ক পথে বাস চলাচল তো রয়েছেই। শুধু বড় সমস্যার মধ্যে রয়েছে তিস্তা নদীর পানি বণ্টন সমস্যাটি। ৮ এপ্রিল ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, দুদেশের বর্তমান সরকারের আমলেই এই চুক্তি হবেই। এরপরও বিএনপির পক্ষ থেকে প্রকাশ্যে বলা হচ্ছে, দেশ ও জাতির সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হয়েছে। জাতিকে অন্ধকারে রেখে নিজেদের স্বার্থ চরিতার্থ করতে চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে যা দেশ ও জনগণের স্বার্থবিরোধী। বিএনপি চেয়ারপার্সন, মহাসচিব অপরাপর নেতা এবং পাতি নেতারাও একই সুরে একই ধ্বনি তুলেছেন। বিষয়টি বিস্ময়কর যেমন, জাতীয় স্বার্থ এবং প্রতিবেশী দেশের সঙ্গে বৈরী সম্পর্ক সৃষ্টি করে তা জিইয়ে রেখে ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টা ছাড়া আর কি হতে পারে। অথচ ভারতের সঙ্গে সৌহার্দপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার কারণে ঐতিহাসিক পার্বত্য চুক্তি যেমন সম্পন্ন হয়েছে, তেমনি কয়েক দশকের ছিটমহল সমস্যারও অবসান ঘটেছে। মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের এসব অর্জনকে অতীতেও ভাল চোখে দেখেনি এখনও দেখছে না। মূল কারণ রাজনীতির চেয়ে ব্যক্তি আধিপত্য বিস্তার এবং স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের সঙ্গে আঁতাতের জের। ’৭১-এর ২৫ মার্চের গণহত্যাকে বর্তমান সরকার যখন ‘গণহত্যা দিবস’ পালনের ঘোষণা দিয়ে ইতোমধ্যে তা একদফায় পালিত হয়েছে, সে ক্ষেত্রে এ দলটি ও তাদের অনুসারীরা তা পালন করেনি। এটা নির্লজ্জতার পরাকাষ্ঠা হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। এরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকেও প্রত্যক্ষভাবে সমর্থন করেনি। পরোক্ষ মনোভাব দেখিয়ে বলেছে, আন্তর্জাতিক নিয়মকানুন মেনে চলে এ বিচার করলে তাদের আপত্তি নেই। কিন্তু বর্তমান সরকার আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি ও বিধিবিধান মেনে চলেই তা শুরু করে ইতোমধ্যে কয়েক যুদ্ধাপরাধীর বিরুদ্ধে রায় কার্যকরও করেছে। বিএনপির রাজনৈতিক কার্যকলাপ অনেকটা অনাহার ক্লিষ্ট রমণীর লিপস্টিক লাগানো কথিত সাজগোজের মতোই প্রতিভাতও হচ্ছে রাজনৈতিক বোদ্ধাদের কাছে। অপরাজনীতির মাধ্যমে ফায়দা হাসিলের অপচেষ্টায় এ দলটির কফিনে শেষ পেরেকটি কখন নিজেরা ঠুকে দিচ্ছে তা-ই এখন দেখার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
×