ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রাজশাহীর সর্বত্র এবার বর্ষবরণের নানা প্রস্তুতি

পদ্মার ছেঁড়াদ্বীপে বসবে প্রাণের মেলা, বৈশাখী উৎসব

প্রকাশিত: ০৫:২৫, ১০ এপ্রিল ২০১৭

পদ্মার ছেঁড়াদ্বীপে বসবে প্রাণের মেলা, বৈশাখী উৎসব

মামুন-অর-রশিদ, রাজশাহী ॥ চৈত্রের শেষ সপ্তাহে এসে প্রকৃতিতে এখন প্রখর রোদের তপ্ত দহন। নদী-নালা, খাল-বিল প্রায় শুকনো। দুয়ারে কড়া নাড়ছে বাংলা নববর্ষ-পহেলা বৈশাখ। কদিন পরই শুরু হবে বাঙালীর ঐতিহ্যের বৈশাখী মেলা। এবার রাজশাহীর সর্বত্র নানা আয়োজনে বৈশাখ বরণের আয়োজন চলছে। এরই মধ্যে ব্যাপক প্রস্তুতি চলছে রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের চারুকলা, বাংলা বিভাগ ছাড়াও রাজশাহী কলেজে। এবারই প্রথম বর্ণিল আয়োজনে বৈশাখ উদযাপনের প্রস্তুতি চলছে জেলার গোদাগাড়ী উপজেলার পদ্মা নদীর চরে। এখানে মেলা বসবে নদীর বুকে জেগে ওঠা এক চিলতে চরে। বৈশাখের এ আয়োজন সম্পূর্ণ ভিন্নমাত্রায় পালনের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১৫ দিন ধরে চলছে পদ্মার চরে বৈশাখী উৎসবের আয়োজন। এক সপ্তাহ ধরে চলবে উৎসব। রবিবার সকালে গোদাগাড়ির পদ্মার নদীর চরে গিয়ে দেখা গেছে সম্পূর্ণ আলাদা চিত্র। পদ্মার চর ঘিরে সাজসাজ রব। পদ্মানদীর এ সময়ে পানির প্রবাহ নেই। চারিদিকে স্বচ্ছ পানির মাঝে জেগে উঠেছে এক চিলতে চর। চারিদিকে টলটলে পানির মধ্যে জেগে ওঠা এ চরের নামকরণ হয়েছে ‘ছেঁড়াদ্বীপ’। সেখানেই প্রস্তুতি চলছে আয়োজনের। কাঠ আর বাঁশের সাঁকো বানিয়ে চরে যাওয়ার রাস্তা তৈরি করা হয়েছে। সেখানে বাঁশের খুঁটি আর ত্রিপল টাঙ্গিয়ে তৈরি হচ্ছে মেলার আয়োজন। ঠিক নদীর বুকে জেগে ওঠা একখ- দ্বীপে এবার বসবে বৈশাখী মেলা। স্থানীয় বৈশাখী মেলা উদযাপন কমিটির আয়োজনে পদ্মার বুকে জেগে ওঠা এক ফালি দ্বীপেই চলছে মেলার আয়োজন। এলাকাবাসীর তাই কৌতূহলের কমতি নেই। সবাই মুখিয়ে আছেন বৈশাখের অপেক্ষায়। স্থানীয় সংসদ সদস্য ওমর ফারুক চৌধুরী মেলা আয়োজনের অন্যতম স্বপ্নদ্রষ্টা। তার নির্দেশনায় মাঝ পদ্মার বুকে শুরু হয়েছে সাজসজ্জা। পদ্মার বুকে জেগে ওঠা প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে বিশাল নৌকা আকৃতির এ ‘ছেঁড়াদ্বীপ’ যেন এখনই হাতছানি দিচ্ছে উৎসব প্রিয় মানুষকে। রঙিন করে তোলা হচ্ছে এ দ্বীপ। নানান রঙের ছাতা বসিয়ে করে তোলা হচ্ছেÑ আকর্ষণীয়। বাহারি আয়োজনের সঙ্গে নদীর স্বচ্ছ পানিও দেখা যাবে এ মেলায়। আয়োজকরা জানান, মেলায় বাঙালীর লোকজ ঐতিহ্য দৃশ্যমান হবে এখানে। থাকবে পুতুল নাচ, লাঠিখেলা, মোটরসাইকেল খেলা, নাগরদোলা, ট্রেনসহ গ্রামীণ পরিবেশের নানান খেলাধুলা। এখানে প্রবেশ ফি নির্ধারণ করা হয়েছে মাত্র ১০ টাকা। মেলায় প্রথমদিন পহেলা বৈশাখে পদ্মাপাড়ের বাসিন্দারা আমন্ত্রিত অতিথিদের পান্তা খাওয়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। সব মিলিয়ে এ মেলার আয়োজনে এবার রাজশাহী অঞ্চলে ভিন্নমাত্রা যোগ করবে বলে মনে করছেন আয়োজকরা। নদীর সঙ্গে বাঙালীর দৃশ্যমান ঐতিহ্য ফুটিয়ে তুলতেই ব্যতিক্রমী এ উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। রঙিন শখের হাঁড়িতে সেজেছে পালপাড়া ॥ ঐতিহ্যের বৈশাখী মেলায় পসরা সাজাতে এখন ভীষণ ব্যস্ত পবা উপজেলার বসন্তপুর পালপাড়া। হাজার বছরের পুরনো শখের হাঁড়ি, পঞ্চসাঞ্জি, মাটির পুতুলসহ বিভিন্ন দৃষ্টিনন্দন তৈজসপত্র তৈরি হচ্ছে এখানে। সারাদেশের বৈশাখী মেলা রাঙাতে ব্যস্ত এখানকার কারিগররা। সারাদেশে প্রচলিত শখের হাঁড়ির যোগানদাতা হিসেবে এখন পরিচিত পেয়েছে বসন্তপুরের শখের হাঁড়ি’। সারাবছর প্রায় ঝিমিয়ে পড়া এ গ্রামটিতে এবার নতুন করে বৈশাখী হাওয়া লেগেছে। এবারো পহেলা বৈশাখের অনুষঙ্গ শখের হাঁড়ি, মাটির পুতুল, পঞ্চসাজি, শৌখিন পাখা তৈরি করা হচ্ছে। এবার এ কাজে যুক্ত হয়েছে নতুন প্রজন্মের শিশুরাও। তারাও বসে একসঙ্গে প্রশিক্ষণের পাশাপাশি তৈরি করছে মাটির পুতুল থেকে শুরু করে হাতি, ঘোড়া, পাখি, কলস, ঘটি-বাটি ইত্যাদি। পালপাড়ার সুশান্ত পাল হলেন শখের হাঁড়ির অসাধারণ কারিগর। তার মোহনীয় তুলির রেখায় জন্ম নেয় শখের হাঁড়ির মনমাতানো সব নক্সা। ছোট্ট পালপাড়ায় সুশান্ত পালরাই প্রধান, তারই জ্ঞাতি-গোষ্ঠী আরও কিছু কুমার রয়েছেন। এরা মাটির পুতুল ও শখের হাঁড়ি তৈরি করে থাকেন। শখের হাঁড়ি তৈরিতে সুশান্ত পালের রয়েছে কয়েক পুরুষের অভিজ্ঞতা। বসন্তপুর পালপাড়ায় ত্রিশটির মতো মৃৎশিল্পী পরিবার। এরা বৈশাখের উপকরণ নিয়ে দারুণ ব্যস্ত। সুশান্ত কুমার পাল বলেন, বাবা-দাদার এই সংস্কৃতিকে বাঁচাতে রীতিমতো হিমশিম খাচ্ছেন তিনি। সারা বছর এই শিল্পের তেমন একটা কদর থাকে না। বৈশাখকে ঘিরে তিন মাস আগে থেকে তাদের প্রস্তুতি শুরু হয়। ঢাকাসহ সারাদেশ থেকে অর্ডার আসে। সুশান্ত কুমার জানান, বিয়াই-বিয়াইন বাড়িতে মিষ্টি নেয়ার কাজে আগে শখের হাঁড়ি প্রচুর ব্যবহার হত। কোন বাড়ি থেকে কত বেশি শখের হাঁড়িতে পিঠা, মিষ্টি বা অন্যান্য উপাদান নিয়ে যাবে, সেটার ওপর নির্ভর করত ওই বাড়ির মান-মর্যাদা। তবে হালে কাগজের প্যাকেটে মিষ্টি নেয়ার প্রবণতা বাড়ায় কমে গেছে শখের হাঁড়ির ব্যবহার। এত কিছুর পরও শখের হাঁড়ি কখনও হারিয়ে যাবে না। বৈশাখ বরণের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত রাবির চারুকলা বিভাগ ॥ বাঙালীর বৃহত্তম উৎসব পহেলা বৈশাখ ঘিরে উত্তরবঙ্গের সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) প্রতিবারই থাকে বর্ণাঢ্য আয়োজন। এবারও তার ব্যতিক্রম হচ্ছে না। লোকজ সংস্কৃতি ও আবহমান বাংলার চিরচেনা রূপে নতুন বর্ষকে বরণ করে নিতে ইতোমধ্যেই প্রস্তুতি শুরু করে দিয়েছে বিভিন্ন বিভাগ ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক সংগঠন। প্রতি বছরই পহেলা বৈশাখে প্রধান আকর্ষণ রাবির চারুকলা অনুষদ। রাবির সবচেয়ে বড় মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হয় চারুকলা অনুষদ থেকে। এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার মূল থিম ‘বর্ণচোরা’ বা গিরগিটি। বর্ণচোরা তৈরিতে ব্যবহার করা হচ্ছে কাঠ, বাঁশ, কাগজ ও রং। চারুকলা অনুষদের ৮০ শিক্ষার্থী দিনব্যাপী কাজ করছেন মঙ্গল শোভাযাত্রার নানা উপকরণ তৈরিতে। পহেলা বৈশাখ উদ্যাপন কমিটির আহ্বায়ক চারুকলা অনুষদের গ্রাফিক ডিজাইন, কারুশিল্প ও শিল্পকলার ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. আমিরুল মোমেনীন বলেন, দেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে আমরা ‘বর্ণচোরা’দের কাজ-কারবারই বেশি দেখি। এরা প্রয়োজনমতো নিজেদের রং বদলাতে সিদ্ধহস্ত। তাদের দাপটে সত্যিকার দেশপ্রেমিকরা বর্ণহীন হয়ে পড়েছে। তাই এ বছর ভিন্ন আঙ্গীকে শোভাযাত্রার থিম নির্বাচন করা হয়েছে। রবিবার দুপুরে রাবির চারুকলা অনুষদের প্রাঙ্গণ ঘুরে দেখা যায়, চৈত্রের তীব্র দহন উপেক্ষা করে শিক্ষার্থীদের মধ্যে উৎসবের আমেজ। আড্ডা-গল্প আর প্রাণখোলা হাসিতে বাঙালীর প্রাণের উৎসব বরণ করতে তৈরি করা হচ্ছে শোভাযাত্রার নানা প্রতীক। তারা কাগজ দিয়ে তৈরি করছেন হাজারো লম্বা টুপি (জোকার ক্যাপ), হাতে বহনের জন্য রং-বেরঙের মুখোশ, বানানো হচ্ছে বড় আকৃতির পাখা। সেগুলোতে রং-তুলির সাহায্যে ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে লোকজ ঐতিহ্য। বিপুল উৎসাহ নিয়ে শোভাযাত্রার উপকরণ তৈরির কাজ করছেন চারুকলার শিক্ষার্থীরা। তবে সরকারী নিষেধাজ্ঞা থাকায় মুখে পড়ার জন্য মুখোশ এ বছর বানানো হচ্ছে না। চারুকলা অনুষদের অধিকর্তা ড. মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, পহেলা বৈশাখে সকাল আটটায় সঙ্গীত পরিবেশনের মাধ্যমে বাংলা নববর্ষের উৎসবের উদ্বোধন করা হবে। সকাল ৯টায় হবে বর্ণাঢ্য মঙ্গল শোভাযাত্রা। এদিন দুপুরে চারুকলা অনুষদের নিজস্ব পরিবেশনায় সমবেত সঙ্গীত, লোক সঙ্গীত ও বাউল সঙ্গীত, নৃত্য, আবৃতি, হরবোলা, অভিনয় ও ফ্যাশন শোর আয়োজন করা হয়েছে। তিনদিনব্যাপী এ আয়োজনের দ্বিতীয় দিন থাকছে নৃত্য, আবৃত্তি ও ব্যান্ড সঙ্গীত। তৃতীয় দিন বেলা সাড়ে তিনটায় চারুকলার শিক্ষার্থীদের পরিবেশনায় ‘আঁধারের মুসাফির’ নামের যাত্রাপালা অনুষ্ঠিত হবে। এছাড়া ঐতিহ্যবাহী রাজশাহী কলেজেও এবার ভিন্ন মাত্রায় বৈশাখ উৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। কলেজের অধ্যক্ষ প্রফেসর মুহা. হবিবুর রহমান বলেন, অন্যান্য বছরের তুলনায় এবার ব্যতিক্রমী আয়োজনে এ কলেজে বৈশাখ উৎসবের প্রস্তুতি চলছে। এবারের বৈশাখাী মেলায় বাঙালীর ঐতিহ্যের সঙ্গে ডিজিটাল বাংলার মিশেলে শোভা পাবে তাদের মঙ্গল শোভাযাত্রা। এছাড়া দিনভর বাঙালী লোকজ সংস্কৃতির অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।
×