ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৬ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

‘পান্তা-ইলিশ’ কালচারের সঙ্গে বৈশাখ বরণের কোন সম্পর্ক নেই

প্রকাশিত: ০৫:১৯, ১০ এপ্রিল ২০১৭

‘পান্তা-ইলিশ’ কালচারের সঙ্গে বৈশাখ বরণের কোন সম্পর্ক নেই

মনোয়ার হোসেন ॥ পুরনো বছর বিদায় নিয়ে আসছে নতুন বছর। সময়ের আয়নায় উঁকি মারছে নতুন বঙ্গাব্দ ১৪২৪। আর বাংলা পঞ্জিকার হিসেবে নতুন বছর মানেই জাতিসত্তার সুন্দরতম প্রকাশের উৎসব পহেলা বৈশাখ। বৈশাখ যখন দুয়ারে তখন নানাভাবে উঠে এসেছে রূপালি ইলিশের আলাপ। অনেক শহুরে নাগরিকই নববর্ষবরণের সঙ্গে নিজের অজান্তেই জুড়ে দিয়েছে পান্তা-ইলিশ। যদিও বাংলা নববর্ষের উদ্্যাপনের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের কোন সম্পর্ক নেই বলে মন্তব্য করেছেন লোকগবেষক থেকে শুরু করে সংস্কৃতিজন ও মৎস্য বিশেষজ্ঞরা। জানা যায়, হাল আমলে বৈশাখে তৈরি হওয়া পান্তা-ইলিশ খাওয়া কালচারের সঙ্গে সম্পর্ক নেই হাজার বছরের বাংলা সংস্কৃতির। ইলিশের যথাযথ উৎপাদন প্রক্রিয়া অব্যাহত রাখার স্বার্থেই বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টজনরা। অথচ পহেলা বৈশাখের দিন রাজধানী থেকে শুরু করে দেশের নানা প্রান্তে ধুম পড়ে যায় পান্তা-ইলিশ খাওয়ার। অসচেতনতায় আপন সংস্কৃতির অংশ মনে করে আরোপিত সংস্কৃতির ভ্রান্ত ধারণায় উদ্বুদ্ধ হচ্ছে মানুষ। চোখে পড়ে বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার রসনা মেটানো বাগাড়ম্বর। সেই রসনা মেটানোর ফলশ্রুতিতে বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার হুজুগে বিরূপ প্রভাব পড়ছে সারাবছরের ইলিশ উৎপাদনে। অন্যদিকে পুষ্টিবিজ্ঞানীরা বলছেন, পহেলা বৈশাখ ও তার আশপাশের সময়ে মূলত ইলিশের বেড়ে ওঠার সময়। এ সময় ইলিশ আসলে জাটকা থাকে কিংবা ডিম ছাড়ে মা ইলিশ। তথাপি নববর্ষ উদ্যাপনের অত্যুৎসাহী প্রবণতায় হিমাগারের স্বাদহীন ইলিশ খাওয়ার ঝোঁকটি দেখা দেয় প্রবল হয়ে। স্বাদহীন হিমাগারের ইলিশটি স্বাস্থ্যসম্মতও থাকে না। বৈশাখে ইলিশ না খাওয়ার আহ্বান জানিয়ে গত নববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও তার খাবার তালিকা থেকে ইলিশ বর্জন করেছিলেন। ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক সংগঠন ছায়ানটের হাত ধরেই শুরু হয়েছিল বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপনের শহুরে রীতিটি। নববর্ষের পান্তা-ইলিশ প্রথার প্রচলন প্রসঙ্গে এই সংগঠনটির সভাপতি ও দেশের সাংস্কৃতিক আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব সন্্জীদা খাতুন জনকণ্ঠকে বলেন, নববর্ষ উদ্্যাপনে পান্তা-ইলিশ খেতে হবে-এমনটা কখনও দেখিনি এবং শুনিনি। বছরের বাকি দিনগুলোর মতোই নববর্ষে গ্রামের মানুষ পান্তা ভাত খায়। কিন্তু সেখানে ইলিশ থাকে না। কাঁচা লংকার সঙ্গে কাঁচা পেঁয়াজ দিয়ে অথবা মরিচ পুড়িয়ে পান্তা খায়। ইলিশ তো দামি মাছ, এটা গ্রামের মানুষ কোথায় পাবে? এ এক অদ্ভুত জিনিস ঢুকিয়ে দেয়া হয়েছে বর্ষবরণের আয়োজনে। একসময় দেখলাম আমাদের প্রভাতী বর্ষবরণ অনুষ্ঠানের গা ঘেঁষে দর্শকদের ঠেলে কিছু দোকান বসল। সেখানে পান্তা ইলিশ খাওয়ানো শুরু। মূলত বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু ছাত্র এসব দোকান দিয়েছিল। দোষটা এসে চেপেছিল আমাদের ঘাড়ে। পহেলা বৈশাখে পান্তার সঙ্গে ইলিশ খাওয়ার প্রবণতাকে একইসঙ্গে অনৈতিক ও হুজুগ বলে উল্লেখ করেছেন ইকো মৎস্য প্রকল্পের পরিচালক ও মৎস্যসম্পদ গবেষক অধ্যাপক আবদুল ওয়াহাব। তিনি জনকণ্ঠকে বলেন, মার্চ ও এপ্রিল এই দুই মাস হচ্ছে জাটকা ইলিশের মৌসুম। এ কারণেই এ দুই মাসে জাটকা ধরা সরকারীভাবে নিষিদ্ধ। এ প্রচারণাকে সফল করতে গত বছর নববর্ষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও নিজের খাবারের তালিকা থেকে ইলিশ বাদ দিয়েছিলেন। যদি নববর্ষকে উপলক্ষ করে মানুষের মধ্যে ইলিশ খাওয়ার ধুম ওঠে তাহলে এই জাতীয় মাছটির উৎপাদন ব্যাহত হবে। অন্যদিকে অসময়ে মানুষের এই ইলিশ খাওয়ার প্রবণতায় জেলেরাও জাটকা ধরতে উৎসাহী হচ্ছে। ফলে রূপালি ইলিশের ওপর বিরাট চাপ পড়ছে। আর বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়া আমাদের কোন অতীত ঐতিহ্যও নয়। এটি আমাদের কোন পুরনো রীতিও নয়। একসময় কৃষকরা শুকনো মরিচ চটকে বা কোন ভর্তা দিয়ে পান্তা খেত। সেই থেকে বৈশাখে নাগরিকদের মধ্যে পান্তা খাওয়ার কিছুটা প্রচলন থাকলেও সেই পাতে ইলিশ থাকত না। এখন পহেলা বৈশাখে পান্তা-ইলিশ খাওয়াটা কিছু মানুষের মধ্যে একটা হুজুগে পরিণত হয়েছে। মূলত বর্ষাকালকে কেন্দ্র করে জুন-জুলাই ও আগস্ট হচ্ছে ইলিশের ভরা মৌসুম। অথচ বৈশাখে মানুষের ইলিশ খাওয়ার প্রবণতা বেড়ে যাওয়ার সুযোগে ব্যবসায়ীরাও কূটকৌশল গ্রহণ করছে। তারা ভরা মৌসুমের ইলিশকে সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে না দিয়ে কোল্ডস্টোরে গুদামজাত করে। তখন আর ১৬ কোটি মানুষের বছরে অন্তত একদিনের জন্য ইলিশ খাওয়ার সাধটি পূরণ হয় না। গুদামজাত মাছকে চড়া দামে ছাড়া হয় বৈশাখ মাসে। সেসব মাছ কিনতে পারে না নি¤œ মধ্যবিত্ত কিংবা নি¤œবিত্ত মানুষ। ইলিশ চলে যায় সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই ইলিশের যথাযথ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হলে মার্চ-এপ্রিলে ইলিশ খাওয়া চলবে না। পহেলা বৈশাখে যদি শহুরে মানুষের মাছ দিয়ে পান্তা খাওয়ার খুব বেশি শখ হয় সেক্ষেত্রে তারা ভাজা তেলাপিয়া মাছ দিয়েও খেতে পারে। গত বছর বৈশাখে ইলিশ খাওয়ার বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে আমরা কিছুটা সফল হয়েছিলাম। শিল্পী-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবীসহ সমাজের সচেতন নাগরিকরা নববর্ষে ইলিশ খাওয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নিলে এই হুজুগে সংস্কৃতি পুরোপুরি বন্ধ হবে বলে আমরা আশা করি। এ বিষয়ে লোক-গবেষক ও বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক শামসুজ্জামান খান বলেন, বাংলা নববর্ষের সঙ্গে কখনই পান্তা-ইলিশের কোন সম্পর্ক ছিল না। কিছুকাল ধরে উড়ে এসে জুড়ে বসার মতো এটিও অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছে বৈশাখের সঙ্গে। মূলত কিছু তরুণের নববর্ষের দিনে ইলিশ-পান্তা বিক্রি করে এই রেওয়াজটি ছড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু এর সঙ্গে নববর্ষের কোন আত্মিক যোগাযোগ নেই। বৈশাখ হচ্ছে খরার মাস। এ সময়টিতে কৃষকের ঘরে ফসল ওঠে না। তাই তেমন অর্থকড়িও থাকে না। সে কারণে গ্রামের গরিব কৃষকের পক্ষে নববর্ষে ইলিশ-পান্তা খাওয়া সম্ভব ছিল না। তারা পান্তাভাত খেত শুঁটকি মাছ, বেগুন ভর্তা দিয়ে। মূলত আষাঢ় ও শ্রাবণে পাট বিক্রির টাকায় কৃষক পরিবারের পাতে আসত ইলিশ। এমনকি মধ্যবিত্তরাও বর্ষাকালেই ইলিশ খেত। এছাড়া বৈশাখ মাস হচ্ছে মা ইলিশের ডিম পাড়া ও জাটকা ইলিশের বেড়ে ওঠার মৌসুম। এ সময় ইলিশের আকার যেমন ছোট থাকে তেমনি সুস্বাদুও হয় না। [জঞঋ নড়ড়শসধৎশ ংঃধৎঃ: }থএড়ইধপশ[জঞঋ নড়ড়শসধৎশ বহফ: }থএড়ইধপশ এ প্রসঙ্গে প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক ও শিশু একাডেমির চেয়ারম্যান সেলিনা হোসেন বলেন, পান্তা খাওয়ার সংস্কৃতিটা এসেছে আমাদের গ্রামীণ জীবন থেকে। তাই পহেলা বৈশাখের মতো বিশেষ দিনে শহরবাসীর পান্তা খাওয়াটাও এক ধরনের উদ্্যাপন। তাই বলে পান্তার সঙ্গে ইলিশের যোগসূত্র খোঁজাটা অর্থহীন। এটার মধ্যে আসলে প্রবেশ করেছে এক ধরনের বাণিজ্যিকীকরণ। কারণ, জাটকা থেকে পরিণত ইলিশ হয়ে ওঠার মৌসুমে নিজের রসনা মেটানোর কোন মানে নেই। তাই উৎসব উদ্্যাপনের নামে ইলিশ নিধন আমাদের কাম্য নয়। কারো যদি নববর্ষের পান্তা খাওয়ার ইচ্ছে হলে সেটা যে কোন ধরনের ভর্তা দিয়েও অনায়াসে খাওয়া যায়। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ বলেন, নববর্ষের সঙ্গে পান্তা-ইলিশের কোন সম্পর্ক নেই। আশির দশকে কিছু তরুণ নিজেদের মুনাফার স্বার্থের এই প্রথার প্রচলন ঘটিয়েছে। আর বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোও সেটা লুফে নিয়েছে। এমনভাবে এটার হয়েছে যে ঋতুভিত্তিক খাদ্য বৈশিষ্ট্যও এই প্রভাবে চাপা পড়েছে। গ্রীষ্মের এই সময়টিতে করলাভাজি, পাটশাক, সজনে ডাঁটাসহ নানা ধরনের ভর্তা-ভাজি দিয়েই পান্তা খাওয়া যায়। কিন্তু উৎসবের নাম করে নববর্ষের দিনে পান্তার সঙ্গে ইলিশ জুড়ে দেয়ায়Ñএটি এখন ইলিশ নিধনের অভিযানে পরিণত হয়েছে। নববর্ষের ইতিহাস তুলে ধরে এই সংস্কৃতিজন বলেন, মোগল আমলের আগে সৌর পঞ্জিকা অনুসারে বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপন করা হতো তৎকালীন বঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মনিপুর, উড়িষ্যা, এমনকি নেপাল, পাঞ্জাবেও। একেক অঞ্চলে অনুষ্ঠানের রীতি এবং খাবারের পদ ছিল আলাদা। বাংলায় খাবারের তালিকায় থাকত কচু, কলা থেকে শুরু করে সিদলসহ বিভিন্ন ধরনের শাকসবজির ভর্তা। পান্তাভাত এমনিতেই বাঙালী গরিব কৃষকের আবহমানকাল ধরে নিত্যদিনের খাবার। তার সঙ্গে সামর্থ্যরে মধ্যে কয়েক পদের ভর্তার আয়োজনই ছিল উৎসবের ছোঁয়া। করলা, কাকরোলের মতো সবজি বিশেষভাবে রান্না করা এবং সজনে ডাঁটার ডালেরও প্রচলন ছিল। সবচেয়ে জনপ্রিয় ছিল শুঁটকি ভর্তা। কয়েক ধরনের মাছের শুঁটকি জোগাড় করা হতো। পাশাপাশি এ এলাকায় চাঁদা মাছের শুঁটকির সঙ্গে কচু শাকের ডাঁটা মিশিয়ে শুকিয়ে তৈরি করা সিদল ভর্তাও জনপ্রিয় ছিল।
×