ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৫ চৈত্র ১৪৩০

দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি;###;উন্নয়ন প্রকল্পে দিল্লী সরকার আরও ৪০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেবে;###;বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ও সরকারী ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা

৭২ হাজার কোটি টাকা ॥ ভারতের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবেন

প্রকাশিত: ০৫:১৭, ১০ এপ্রিল ২০১৭

৭২ হাজার কোটি টাকা ॥ ভারতের ব্যবসায়ীরা বিনিয়োগ করবেন

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে ৭২ হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ করবেন। এ বিষয়ে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে কয়েকটি চুক্তি হয়েছে। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পে ভারত সরকার ঋণ দেবে আরও ৪০ হাজার কোটি টাকা। বাংলাদেশে বেসরকারী খাতে বিনিয়োগ ও ভারতের সরকারী ঋণের মোট পরিমাণ দাঁড়াবে এক লাখ ১২ হাজার কোটি টাকা। এছাড়া আঞ্চলিক ও বিশ্ব ফোরামে অংশীদার হিসেবে থাকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে দুই দেশ। উভয় দেশ অভিন্ন নদী ফেনী, মানু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমারের পানি বণ্টন নিয়ে সমাধানে পৌঁছাতেও ঐকমত্য হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরে বাংলাদেশ ও ভারতের যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশের বিভিন্ন খাতে ৭২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগে চুক্তি করেছেন। এছাড়া সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিনিয়োগ ও বাণিজ্য বৃদ্ধির হারে উভয়পক্ষই সন্তুষ্টি প্রকাশ করেছে। বাংলাদেশে ভারতের ব্যবসায়ীদের বিনিয়োগ ধীরে ধীরে বাড়ছে। বিশেষ করে মেরিকো, সিয়াট, টাটা মটরস, গোদরেজ, সান ফার্মা ও এশিয়ান পেইন্টসের মতো ভারতীয় কোম্পানিগুলো ইতোমধ্যে বাংলাদেশে কারখানা স্থাপন করেছে বা প্রক্রিয়ায় রয়েছে। গত দেড় দশকে ভারতে বাংলাদেশের রফতানি দশগুণ বেড়েছে, অন্যদিকে বাংলাদেশে ভারতের রফতানি বেড়েছে ছয়গুণ। ২০১৫-১৬ অর্থবছরে দুই দেশের মধ্যে ৬১৪ কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়েছে। দিল্লী সফরের আগে ঢাকায় ভারতীয় হাইকমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেছিলেন, বাংলাদেশের বিদ্যুত, তরল প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) ও বন্দর খাতে প্রায় এক হাজার ১০০ কোটি ডলারের (৮৮ হাজার কোটি টাকা) বিনিয়োগ পাইপলাইনে রয়েছে। এর মধ্যে ৩০০ কোটি ডলারের (২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা) বেশি ভারতীয় বিনিয়োগ বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (বিডা) নিবন্ধিত হয়েছে বলে জানিয়েছিলেন হাইকমিশনার। দিল্লী সফরে দুই দেশের শীর্ষ বৈঠকে ভারতের জন্য বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল নির্মাণে জায়গা খুঁজতে এবং এই প্রক্রিয়া এগিয়ে নিতে দুই প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন। স্থলবন্দর ও শুল্ক স্টেশনগুলোর অবকাঠামো উন্নত করে পণ্য বিনিময় ও দুই দেশের জনগণের সম্পর্ক বৃদ্ধিতেও দুই প্রধানমন্ত্রী একমত হয়েছেন বলে বিবৃতিতে জানানো হয়েছে। দুই দেশের মধ্যে যৌথ বিবৃতিতে বলা হয়েছে, দুই দেশের মধ্যে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজ করতে বন্দরসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রের সব বাধা দূর করতে শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি একমত হয়েছেন। এর মধ্যে ভারত বাংলাদেশের পাটপণ্যে আরোপ করা শিল্প সুরক্ষা (এ্যান্টি ডাম্পিং) শুল্ক নিয়ে নতুন করে ভেবে দেখবে বলে আশ্বস্ত করেছে। অন্যদিকে ভারতের নির্দিষ্ট কিছু পণ্যে ন্যূনতম আমদানি মূল্যের বিষয়টি বাংলাদেশ বিবেচনার আশ্বাস দিয়েছে। দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে একান্ত ও পরে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে ২২টি চুক্তি ও সমঝোতা সই হয়েছে। এছাড়াও ব্যবসায়ীদের মধ্যে বেসরকারী পর্যায়ে আরও কয়েকটি চুক্তি সই হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরসঙ্গীদের মধ্যে মন্ত্রী, সরকারী কর্মকর্তা ছাড়াও বেসরকারী উদ্যোক্তা এবং ব্যবসায়ীদের ২৫৭ জন প্রতিনিধি আছেন। দুই দেশের ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের মধ্যে বিনিয়োগে আলোচনাও চলছে। আজ সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার উপস্থিতিতে সফরের শেষ দিনে দিল্লীতে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের মধ্যে একটি সেমিনারও হবে। এদিকে বেসরকারী বিনিয়োগের পাশাপাশি ভারত সরকার বাংলাদেশকে তৃতীয় ঋণ সহায়তার আওতায় আরও ৪০ হাজার কোটি টাকা দেয়ার ঘোষণা দিয়েছে। এর মধ্যে সামরিক খাতে কেনাকাটার জন্য দেবে ৪০০ কোটি টাকা। গত ছয় বছরে বাংলাদেশকে দেয়া ভারতের সহজ শর্তে (১ শতাংশ সুদে) ঋণ সহায়তা ৬৪ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়নে ভারত সরকার যে অর্থ দেবে তা বাংলাদেশের অগ্রাধিকার প্রকল্প গ্রহণ করে তাতে অর্থায়ন করা হবে। এর আগে ২০১৫ সালে নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের সময় ১৪ প্রকল্প বাস্তবায়নে এক হাজার ৬০০ কোটি টাকার ঋণচুক্তি সই হয়েছিল। ওই প্রকল্পগুলো এখনও বাস্তবায়নাধীন। তারও আগে ২০১০ সালে ৮০০ প্রায় কোটি টাকার ঋণচুক্তি হয়েছিল। ঢাকা-দিল্লীর যৌথ ঘোষণায় বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ও ভারতকে এই অঞ্চলের ভাল প্রতিবেশীর দৃষ্টান্ত তৈরি করার অঙ্গীকার ব্যক্ত করেছে দুই দেশ। উভয় দেশের জনগণের অভিন্ন স্বার্থের পক্ষে কাজ করতে সম্মত হয়েছে, যাতে সবাই সম্প্রীতি বজায় রেখে এবং পারস্পরিক সুবিধাজনক পরিবেশে একসঙ্গে চলতে পারেন। বাংলাদেশ ও ভারত সম্পর্ক আরও ঘনিষ্ঠ ও সম্প্রসারণের লক্ষ্যে নতুন সম্ভাবনার দিকগুলো খতিয়ে দেখার অঙ্গীকার করেছেন তারা। যৌথ বিবৃতি অনুযায়ী, এই সফরে ব্যবসা সংক্রান্ত চুক্তিসহ মোট ৩৪টি দ্বিপক্ষীয় চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই, বিনিময়, গৃহীত ও হস্তান্তর হচ্ছে। এতে দুই দেশের ভ্রাতৃত্বমূলক সম্পর্ক সামনে এগিয়ে নেয়ার ওপর আলোকপাত করা হয়েছে। ঘরে বন্ধুত্ব এবং আঞ্চলিক ও বিশ্ব ফোরামে অংশীদার হিসেবে থাকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ হয়েছে দুই দেশ। এই সফরে যেসব চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে তার মধ্যে নতুন সহযোগিতার ক্ষেত্র হিসেবে প্রতিরক্ষা, আনবিক শক্তি সহযোগিতা, মহাকাশ প্রযুক্তি ও সাইবার নিরাপত্তার মতো বিষয়গুলো এসেছে। ২০১১ সালের জানুয়ারিতে দুই দেশের সরকার তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তিতে সম্মতি দিলেও তার সুরাহা না হওয়ায় শেখ হাসিনা বিষয়টির নিষ্পত্তির জন্য নরেন্দ্র মোদিকে অনুরোধ করেছেন। এ সমস্যার সমাধানে তার সরকার ভারতের সব অংশীদারদের সঙ্গে কাজ করছে বলে জানিয়েছেন নরেন্দ্র মোদি। অভিন্ন নদী ফেনী, মানু, মুহুরি, খোয়াই, গোমতী, ধরলা ও দুধকুমারের পানি বণ্টন নিয়ে সমাধানে পৌঁছাতেও সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দিয়েছেন তারা। পদ্মা নদীতে যৌথ উদ্যোগে গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণে বাংলাদেশের প্রস্তাবের পক্ষে ইতিবাচক পদক্ষেপের প্রশংসা করেছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর চালানো গণহত্যার নিন্দা জানিয়ে এর স্বীকৃতি এবং সে সময় যারা প্রাণ দিয়েছিলেন ও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন তাদের স্মৃতি সংরক্ষণে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন শেখ হাসিনা ও নরেন্দ্র মোদি। নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য একটি বিশেষ মেডিক্যাল স্কিম ঘোষণা করেছেন, যার আওতায় বছরে ১০০ মুক্তিযোদ্ধা সেদেশের হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা নিতে পারবেন। ভারত সরকার বাংলাদেশে মুক্তিযোদ্ধা পরিবারের সদস্যদের যে বার্ষিক বৃত্তি দিচ্ছে তার মেয়াদ আরও পাঁচ বছর বাড়ানোর ঘোষণা দিয়েছেন মোদি। মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদী মাল্টিপল ভিসা ঘোষণা করেছেন তিনি। কোন দেশের সীমান্ত ব্যবহার করে অন্য দেশে সন্ত্রাসী কার্যক্রম চালাতে না দেয়ার প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছেন তারা। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে ভারতীয় বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর যৌথ অভিযানের মধ্য দিয়ে যে সহযোগিতার সূচনা হয়েছিল, তা বিবেচনায় নিয়ে দুই দেশের মধ্যে প্রতিরক্ষা সহযোগিতা বাড়াতে একমত হয়েছে দুই দেশ। এ সহযোগিতা হবে উভয়পক্ষের জন্য লাভজনক। দুই দেশের সামরিক বাহিনীর মধ্যে প্রশিক্ষণ এবং তথ্য ও অভিজ্ঞতা বিনিময় বাড়িয়ে সহযোগিতা বাড়ানোর ওপর গুরুত্ব দিয়েছেন দুই প্রধানমন্ত্রী। বিদ্যুত, পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা, বাণিজ্য, ট্রানজিট ও কানেক্টিভিটি বৃদ্ধির ওপর গুরুত্বারোপ করেছেন তারা। আঞ্চলিক ফোরামের পাশাপাশি জাতিসংঘ ও অন্যান্য বহুপক্ষীয় সংস্থায় ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে দুই দেশ। জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ পুনর্গঠন ও সম্প্রসারণ হলে সেখানে স্থায়ী সদস্য পদে ভারতের প্রার্থিতার পক্ষে বাংলাদেশের সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনা বাংলাদেশ সফরের জন্য আমন্ত্রণ জানালে তা গ্রহণ করেছেন নরেন্দ্র মোদি। উভয়পক্ষের সুবিধাজনক সময়ে ওই সফরের বিষয়ে মতৈক্য হয়েছে। এদিকে রবিবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দিল্লী সফরের তৃতীয় দিনে সকালে আজমীর শরীফে হযরত খাজা মঈনুদ্দীন চিশতির মাজার জিয়ারত করেছেন। সেখানে মাজার জিয়ারত শেষে দুপুরে দিল্লী ফিরেন প্রধানমন্ত্রী। সন্ধ্যায় রাষ্ট্রপতি ভবনে জাতীয় কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর সঙ্গে বৈঠক করেন শেখ হাসিনা। তারপর রাষ্ট্রপতি ভবনে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জির সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে যোগদান শেষে রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজে অংশ নেন তিনি। ভারতের রাষ্ট্রপতির দেয়া নৈশভোজ অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও। দিল্লী সফরের চতুর্থ ও শেষদিন আজ সকালে ইন্ডিয়া ফাউন্ডেশন আয়োজিত এক অভ্যর্থনা অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করবেন প্রধানমন্ত্রী। এরপর ব্যবসায়ী কর্মসূচীতে অংশগ্রহণ করবেন তিনি। চারদিনের সফর শেষে তিনি আজ সোমবার রাতে ঢাকায় ফিরবেন। উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত শুক্রবার দিল্লী সফরে যান।
×