ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক ও শিক্ষা-কর্মকর্তাদের ভূমিকা

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১০ এপ্রিল ২০১৭

উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে শিক্ষক ও শিক্ষা-কর্মকর্তাদের ভূমিকা

শিক্ষায় তুঘলকি কা- বা এ জাতীয় শিরোনামে যত লেখাই প্রকাশ হোক না কেন, যত বক্তৃতা-বিবৃতিতে আকাশ-পাতাল মুখর হোক; একটি কথা নির্দ্বিধায় স্বীকার করা বোধ হয় অসঙ্গত হবে না যে, শিক্ষায় একটি বৈপ্লবিক পরিবর্তন হয়েছে। বেখেয়ালি দৃষ্টি দিলেও বোঝা যাবে যে, শিক্ষার সংখ্যাগত সম্প্রসারণ অভাবিত ও অভূতপূর্ব। তবে শিক্ষামন্ত্রী হতে শুরু করে শিক্ষা সম্পর্কিত বিষয়ে জড়িত ও উৎকণ্ঠিত সবাই স্বীকার করবেন যে, আমাদের শিক্ষার মান আশানুরূপ নয়। এ ব্যাপারে আমাদের যেতে হবে বহু দূরে। তাই করণীয় বিষয় নিয়ে এই নিবন্ধে আলোচনা করা হয়েছে। এখানে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে সমস্যা ও সমাধান বিবেচিত হলেও এসব কিন্তু শিক্ষার সকল পর্যায়ে বা ক্ষেত্রে কম-বেশ প্রযোজ্য। শিক্ষার মানোন্নয়নে কতিপয় চালক বা নিয়ামক ইতোমধ্যে নিঃসন্দেহে চিহ্নিত হয়েছে, তার মধ্যে শিক্ষক-কর্মকর্তাদের ভূমিকা অসীম। এ নিয়ে বর্তমান নিবন্ধে আলোচনা করা হলো। উচ্চশিক্ষায় শিক্ষকের ভূমিকা উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা হচ্ছে মানসম্পন্ন ও নিবেদিত শিক্ষকের অভাব। এ ব্যাপারে বহু কিছু বিবেচ্য রয়েছে, তবে উচ্চশিক্ষার জন্য প্রণীত আইন বা সাধারণ ব্যবস্থাপনা বড় বাধা বলে প্রতিভাত হচ্ছে। তাই এ ব্যাপারে একটু আলোচনা করে নিচ্ছি। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয় বা উচ্চশিক্ষাস্থলগুলোর সামগ্রিক ব্যবস্থাপনা ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ, পরবর্তীতে প্রতিটি সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য সংসদের বিশেষ আইন এবং ২০১০ সালের বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। ১৯৭৩ সালের আইনে এমন কিছু বিধান রয়েছে যা স্বায়ত্তশাসনকে ছাড়িয়ে স্বেচ্ছাচারিতাকে প্রশ্রয় দেয়। অন্তত প্রথম ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ প্রশাসক বা প্রশাসকগণ যে প্রক্রিয়ায় বাছাই ও নিয়োজিত হোন বা যে প্রক্রিয়ায় শিক্ষক নিয়োজিত হোন কিংবা বিভাগীয় প্রধান ও ডিন নিয়োজিত হোন, সেগুলো সবাইকে কম-বেশি কর্মবিমুখ এবং দায়িত্ব বর্জনে উৎসাহিত করে থাকে বলে অনেকের বিশ্বাস এবং সে কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে মানসম্পন্ন শিক্ষা। আমাদের দেশে বিশেষত উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ইউজিসির উদ্যোগে উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়ন প্রকল্প চালু হওয়ার পর এখন কম-বেশি সবাই মানসম্পন্ন শিক্ষার জন্য কি কি করণীয় অত্যাবশ্যক, সে সম্পর্কে অবগত। কিন্তু যে জ্ঞান, প্রজ্ঞা, আন্তরিকতা ও নিষ্ঠা নিয়ে সেসব বাস্তবায়ন প্রয়োজন তা বেমালুম সবাই ভুলে আছেন বলে মনে হচ্ছে। অধ্যাদেশ বা আইনের খুঁত এখানে লক্ষণীয়। ১৯৭৩ সালের বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাদেশের বদৌলতে তিনজনের উপাচার্য নিয়োগ প্যানেল নির্বাচন করেন এক শ’র অধিক সিনেট সদস্য। তাদের মধ্যে অধিকাংশ শিক্ষক, অন্যরা কেউ কেউ মনোনীত। মনোনীত পর্বে সরকারের প্রভাব অধিক, ছাত্র সংসদের প্রভাবও রয়েছে, আর রয়েছে চলমান রাজনীতির প্রভাব। ফলে প্যানেলভুক্ত তিনজনের মধ্যে কেউ অবাঞ্ছিত হলেও শিক্ষক নয় এমন ভোটার নিয়োগের প্রবণতা থাকতেই পারে। তিনজনের যে কোন একজনকে সরকার বা চ্যান্সেলর নিয়োগ দিয়ে থাকেন। এই নিয়োগ প্রক্রিয়াটি এমন যে, উপাচার্যের অসীম ক্ষমতা থাকা সত্ত্বে¡ও তিনি স্বাধীনভাবে বা নিরপেক্ষভাবে সে ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন না। তিনি প্রায়শ পরনির্ভরশীল। ভারসাম্য আনয়নের জন্য যদিও উপ-উপাচার্য ও কোষাধ্যক্ষের সরাসরি নিয়োগ দেয় সরকার; কিন্তু তা বরং ভারসাম্যহীনতা বৃদ্ধি করছে। অধ্যাদেশ মতে, অনুষদের ডিন তার সহকর্মীদের দ্বারা নির্বাচিত হন। ফলে যোগ্য শিক্ষক অপেক্ষা ভোটার নিয়োগের একটি প্রবণতা রয়েই যাচ্ছে। নির্বাচিত হওয়ার পর ভোটারের ওপর কর্তৃত্ব আরোপ সহজ নয়। ফলত শিক্ষকরা নিজেদের স্বাধীনতা ও স্বেচ্ছাচারিতা করায়ত্ত করার সুযোগ পেলেও কোনরূপ কর্মবর্ণনা ও তার বাস্তবায়নে বাধ্যবাধকতার অভাব হেতু স্বেচ্ছাচারী হয়ে ওঠেন। তদুপরি বিধিবিধান ও নিয়মনীতি এমনভাবে প্রণীত হয় যে, শিক্ষকরা নিজেরাই নিজেদের নিয়োগকর্তা, পদোন্নতিদাতা এবং ভাগ্যনিয়ন্তা। পরিণাম হচ্ছে কোন কোন শিক্ষক বছরের পর বছর ক্লাস না নিয়ে, পরীক্ষার খাতা সময়মতো জমা না দিয়ে, কোন উন্নতমানের প্রকাশনা ছাড়াই শুধুমাত্র পদ পুনর্বিন্যাস পদ্ধতির সুবাদে অথবা রাজনীতির সুবাদে তরতর করে প্রভাষক থেকে সহকারী অধ্যাপক, সহকারী থেকে সহযোগী ও সহযোগী থেকে অধ্যাপকে রূপান্তরিত হয়ে যাচ্ছেন। শিক্ষক নিয়োগ প্রক্রিয়া সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ে ২২ হতে ২৪ বছর বয়সী ব্যক্তিকে শুধুমাত্র শিক্ষাগত যোগ্যতার ভিত্তিতে নিয়োগ দেয়া হয়ে থাকে। নিয়োগ কমিটি গঠন আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ ও উদ্দেশ্য তাড়িত মনে হলেও তার গঠন প্রক্রিয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শীর্ষ প্রশাসক ও লাল-নীল-সাদা দলের প্রভাব লক্ষণীয়। শিক্ষক নিয়োগে প্রার্থীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা শিক্ষার্থী অবস্থায় প্রভাবান্বিত করা সম্ভব বলে প্রমাণিত হয়েছে। এমনকি ঘুষ বা তদ্বিরের মাধ্যমে নিয়োগ দেয়ার অভিযোগ আছে। অভিযোগ আছে যে, ভোটার নিয়োগের সুবিধার্থে এমফিল ডিগ্রীধারীকে পিএইচডি ডিগ্রীধারীদের চেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া। এসবে যুগোপযোগী ও মানসম্পন্ন শিক্ষাবান্ধব করতে নিয়োগ প্রক্রিয়ার কিছু সংস্কার করা যায়। তার পূর্বে আমাদের শিক্ষকের বিভিন্ন স্তর ও পদবি পুনর্বিন্যাস আবশ্যক। বর্তমানে প্রচলিত ৪টি স্তর ও পদবি ৬৫ বছরের চাকরি জীবনের প্রথম ১০ হতে ১৫ বছরের মধ্যে অতিক্রম করা সম্ভব। বাকি সময়টা কোন গবেষণা, প্রকাশনা, গবেষণা পরিচালনা কিংবা ছাত্র নির্দেশনা ছাড়াও ক্রমাগত বেতন বৃদ্ধি ও রাজনৈতিক পদবি লাভ সম্ভব বলে অনেকেই কিন্তু উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে ব্রতী বা উদ্যোগী হন না। তাই বর্তমানে প্রচলিত ব্যবস্থায় সরাসরি প্রভাষক নিয়োগ না দিয়ে গ্রাজুয়েট এ্যাসিস্টেন্ট, টিচিং এ্যাসিস্টেন্ট, রিসার্চ এ্যাসিস্টেন্ট বা রিসার্চ ফেলো হিসেবে নিয়োগ দেয়া যায়। প্রথম নিয়োগের ক্ষেত্রে পরীক্ষা পদ্ধতির প্রবর্তনের হয়ত অনেকেই চরম বিরোধিতা করবেন কিন্তু এই পরীক্ষার মাধ্যমে শুধু জ্ঞানের পরিধি নয়, মনমানসিকতা ও শিক্ষকসুলভ মূল্যবোধের অবস্থান প্রার্থীর মধ্যে চিহ্নিত করা যাবে। তারপর মৌখিক পরীক্ষার মাধ্যমে হ্রস্ব তালিকা তৈরি করে তাদের মধ্য থেকে সর্বশ্রেষ্ঠকে প্রথম বা অন্য স্তরে নিয়োগ দেয়া যেতে পারে। লেকচারার থেকে সহকারী অধ্যাপক হয়ে অন্য পদ-পদবিতে উত্তরণে সময় ও কর্মযজ্ঞকে এমনভাবে বিন্যাস করা প্রয়োজন যাতে শিক্ষক তার সারাটা জীবনে উচ্চমানের শিক্ষক হতে ও থাকতে পারেন। প্রাপ্য তথ্য অনুযায়ী জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়, উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় এবং বঙ্গবন্ধু মেরিটাইম বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত অন্যান্য সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা ১২ হাজারের অধিক, যাদের এক-তৃতীয়াংশ অধ্যাপক । এসব শিক্ষকের ৪৩ শতাংশ উচ্চতর শিক্ষায় শিক্ষিত। তবে দেশে না বিদেশে সে সংখ্যা অজ্ঞাত। সব বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক সংখ্যা হচ্ছে প্রায় ১৫ হাজার, যাদের অধিকাংশই প্রভাষক। মোট শিক্ষকের শতকরা ৬৬ ভাগ পূর্ণকালীন। তবে উচ্চতর ডিগ্রীধারী শিক্ষকের সংখ্যা সবই অধিভুক্ত কলেজের শিক্ষকদের চেয়ে কয়েকগুণ বেশি। নতুন নতুন বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয় অনুমোদনের কারণে শিক্ষক সঙ্কট সর্বত্র তীব্র এবং অচিরেই তীব্রতর হবে। যার ফলে বিভিন্ন মাত্রা ও ধরনের সার্টিফিকেট বিক্রির প্রবণতা বাড়বে, অতি দ্রুত মাত্রায় অযোগ্যদের পদোন্নতির প্রবণতা বাড়বে। বর্তমানে নিয়োজিত শিক্ষকদের তেমন কারও শিক্ষণ পদ্ধতি বা গবেষণা পদ্ধতির ওপর কোন প্রকারের প্রশিক্ষণ নেই। তাত্ত্বিকভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রতিটি পদোন্নতিকে নিয়োগ বলেই বিবেচনা করা হয়। বাস্তবতা হচ্ছে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে পদোন্নতিই দেয়া হয়। পদ পুনর্বিন্যাসের মাধ্যমে পদোন্নতি সারা শিক্ষকতা জীবনে একবারই করা উচিত। শিক্ষকদের মূল্যায়নে বেসরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচলিত বা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বৈকালিক কোর্সে প্রবর্তিত ৩৬০ ডিগ্রী মূল্যায়ন ব্যবস্থা প্রাতিষ্ঠানিকীরণ উচ্চশিক্ষার মানোন্নয়নে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে পারে। সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও মূল্যায়নে শিক্ষার্থীদের অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। পদোন্নতির ক্ষেত্রে সময় গণনাকে বা প্রকাশনাকে অবহেলা করার কারণ নেই। তবে কোনভাবেই স্বসম্পাদিত জার্নাল বা বন্ধুবান্ধব, শুভাকাক্সক্ষীদের সম্পাদিত জার্নালের প্রকাশনাকে গুরুত্ব দেয়া সমীচীন নয়। আন্তর্জাতিকমানের বহিঃসুপারভাইজার কর্তৃক মূল্যায়িত গবেষণাকে গুরুত্ব দিতে হবে। এক প্রকাশনায় তিনের বেশি প্রবন্ধকার বা গ্রন্থকারের অবদান বিবেচনায় নিয়ে পদোন্নতি দেয়া উচিত নয়। পাকিস্তানভিত্তিক জার্নালের প্রকাশনাকে বিবেচনার বাইরে রাখতে হবে। নিয়োগের সময়ই শিক্ষকদের কার্যাবলীর বিশদ বর্ণনা থাকতে হবে এবং ভবিষ্যতে বেতন বৃদ্ধি ও পদোন্নতিতে কি কি বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে তা জানিয়ে দিতে হবে। শিক্ষকদের সাপ্তাহিক ক্লাসের সংখ্যা ও সময় বেঁধে দিতে হবে। তাদের ক্লাসে অনির্ধারিত উপস্থিতি নিরোধ করতে হবে। তারা যেন সময়মতো ফলাফল ঘোষণা করে শিক্ষার্থীদের স্বতঃপ্রণোদিত ও ক্রম অগ্রগতির ব্যবস্থা রাখে তার ব্যবস্থা রাখতে হবে। চলবে...
×