ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

পীযূষ বন্দ্যোপাধ্যায়

পেরেছেন, তিনিই পেরেছেন

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ১০ এপ্রিল ২০১৭

পেরেছেন, তিনিই পেরেছেন

বেশ কয় বছর আগে, উদ্ভট ওয়ান ইলেভেনের দুঃসময় পার করে দেশবাসীর রেকর্ড ভোটে শেখ হাসিনা জয়ী হয়ে সরকার গঠন করেছেন মাত্র। তখন ‘পারলে তিনিই পারবেন’ শিরোনামে একটা লেখা লিখেছিলাম। সেই লেখায় অনেক আকাক্সক্ষা এবং প্রত্যাশার কথা ছিল। প্রাপ্তির ব্যাপারে অথবা প্রত্যাশা পূরণের ক্ষেত্রে অনেক বন্ধুই মুচকি হাসিতে আমার আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশাকে অলীক স্বপ্ন বলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন। বলেছিলেন যা হওয়ার নয়, যেগুলো অসম্ভব তা নিয়ে অযথা কেন মাথা ঘামাই এবং সময় নষ্ট করি। নিরুত্তর আমি, নিজ আস্থায় দৃঢ় থেকে অপেক্ষা করেছি এবং দেখেছি শেখ হাসিনা কিভাবে একের পর এক অসম্ভবকে সম্ভব করে দেশের জন্য, মানুষের জন্য সাফল্য নিয়ে আসছেন। হাজারও বাধার বিন্দাচল টপাটপ টপকে তিনি একের পর এক জিতে চলেছেন শত্রুর দেয়া কঠিন চ্যালেঞ্জ। দেশকে নিয়ে গেছেন এক অনন্য উচ্চতায়। দেশের মানুষের বুকে ভরে দিয়েছেন স্বস্তি, মাথায় পরিয়েছেন বিজয়ের মুকুট। প্রজ্ঞা, মেধা, দূরদর্শিতা, বিচক্ষণতা আর সময়োপযোগী সঠিক সিদ্ধান্তের কারণে তিনি একের পর এক সৃষ্টি করে চলেছেন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। সব কাজের কাজী হয়ে, বলতে গেলে একক নৈপুণ্যে যেখানেই স্পর্শ রাখছেন সেখানেই ফলাচ্ছেন স্বর্ণবৃক্ষ। অতীতের সকল দায় পূরণ করে দেশ ও দেশবাসীর জন্য খুলে দিচ্ছেন উজ্জ্বল আলোর ভবিষ্যতের দুয়ার। যে দুয়ার দিয়ে অহরহ আসছে আলোর ঝর্ণাধারা, যার পরশে আমরা নিয়ত শুদ্ধচিত্ত হচ্ছি। ভূমিকায় এত কথা লেখার কারণ, আমি বোধহয় কিছুটা আবেগপ্রবণ হয়েছি। আবেগপ্রবণ হব নাই বা কেন! সেই কবে যেই প্রত্যাশা ও আকাক্সক্ষা কিংবা স্বপ্নের কথা লিখেছিলাম শেখ হাসিনার ওপর অগাধ আস্থা রেখে এবং সেই লেখা পড়ে বন্ধুরা মুচকি হেসেছিল, আজ যখন আমার প্রত্যাশার অধিক প্রাপ্তির দৃশ্যমান এবং সত্য হয়ে যায় তখন খুশি হব না কি দুঃখ ভারে অশ্রু বিসর্জন করব! শেখ হাসিনার প্রতি দৃঢ় আস্থায় সেদিনও যেমন অনড় ছিলাম তেমনি আজও বিশ্বাস করি যে, বাকি কাজগুলো সম্পন্ন হলে বাংলাদেশ সময়মতোই অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছাবে এবং সেটাও সম্ভব হবে শেখ হাসিনার নেতৃত্বেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফর নিয়ে গত ক’মাস কত কথা, কত আলোচনা, কত বাকবাকুম। চোখ-কান খোলা রেখে গণমাধ্যমের প্রায় সব কথাই শোনা এবং দেখার চেষ্টা করেছি। বেশি চেষ্টা করেছি যারা উঠতে বসতে শেখ হাসিনার কাজকে বুঝে-না বুঝে বিরোধিতা করেন, যারা শেখ হাসিনার সব কর্মোদ্যোগের ভেতর ‘কিন্তু’ খোঁজেন তাদের লেখা পড়তে এবং কথা শুনতে। রাজনৈতিক ক্ষেত্রে যারা শেখ হাসিনা, শেখ হাসিনার সরকার, আওয়ামী লীগবিরোধী তাদের দেখেছি বাতিল ফর্মুলার কানাগলিতে চলতে এবং পুরনো ভাঙ্গা রেকর্ডের মতো একঘেয়ে পুড়ে ঘ্যান ঘ্যান করতে। চার দশকের বেশি সময় আগে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির সময় যা বলতেন এখনও তাই বলছেন। ভারতের সঙ্গে সম্পর্ক মানেই দেশের সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়াÑ এই হচ্ছে তাদের ভাঙ্গা রেকর্ডের বেসুরো বয়ান। শুনতে শুনতে কান পচে গেছে। কান এখন নতুন কিছু শুনতে চায় যাতে যুক্তি আছে। আছে বিশ্বাসযোগ্যতা। তাছাড়া বর্তমানকালে সার্বভৌমত্ব বিকিয়ে দেয়া যেমন সম্ভব নয়, ছিনিয়ে নেয়াও অবান্তর চিন্তা। এটা সাধারণ লোকমাত্রই বোঝে। প্রতিদিন পার্টি অফিসে গণমাধ্যমকর্মীদের (বেশিরভাগই নিজ দলীয়) সামনে লিখিত-অলিখিত অন্তঃসারশূন্য কথার ফুলঝুরি ছুটিয়ে আজকাল বিশেষ লাভ হয় বলে মনে হয় না। বরং সেই পুরনো প্রচলিত প্রবাদটাই মনে পড়ে, যে কহে বিস্তর কথা সে কহে বিস্তর মিছা। বিরোধী রাজনৈতিক দল ও নেতৃবৃন্দের (অথবা কথকবৃন্দের) মুখে ছাই দিয়ে শেখ হাসিনা প্রথম দফায় সরকার গঠন করে মিটিয়েছেন গঙ্গার পানির পুরনো সমস্যা। পরের দফায় মিটিয়েছেন বহু আরাধ্য ছিটমহল সমস্যা। আন্তর্জাতিক আদালতে আইনী লড়াই করে মিটিয়েছেন সমুদ্রসীমার মালিকানা। এ সবই তিনি করেছেন বিচক্ষণতা ও দূরদর্শিতার প্রগাঢ় জ্ঞান এবং মেধায়। বিরোধী পক্ষ দফায় দফায় সরকারে থেকেও এসব দীর্ঘদিনের সমস্যা মেটাতে তো পারেইনি বরং জটিল করেছে। উল্লেখিত বিষয় ছাড়াও বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার, একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী ও মানবতাবিরোধীদের বিচার, পঁচিশে মার্চকে গণহত্যা দিবসের স্বীকৃতিÑ এ বিষয়গুলো কি একেবারেই ফেলনা! বিস্ময় জাগে, যখন এসব শুভ কাজের জন্য শেখ হাসিনাকে দেশে-বিদেশে প্রশংসা করা হচ্ছে তখন সমালোচনার ঝড় বইয়ে দেয়া বিরোধী দল মুখে কুলুপ এঁটেছে। পাছে তাদের গডফাদার কিংবা গার্জিয়ান পেয়ারা পাকিস্তান গোস্্সা করেÑ এ জন্যই কি! তাছাড়া দেশীয় রাজনীতির সেরা বন্ধুরা যদি মুখ ফিরিয়ে নেয় অথবা লেজ গুটিয়ে সটকে পড়ে তবে তো নিজেরা ফুটো কলস। দল কিংবা নেতাদের কথা না হয় ছেড়েই দিলাম। দলের থিঙ্ক ট্যাঙ্ক বুদ্ধিজীবীরাও বা কম যান কিসে। ‘চিলে কান নিয়ে গেল’ শুনে তারাও অহেতুক চিলের পিছে দৌড়াননি কি! প্রতিরক্ষা বিষয়ে পারদর্শী নন তবু সেই বিষয়ে দিস্তা দিস্তা কাগজ নষ্ট করে লিখবেন অনেক কিছু। সবকিছু জেনে বুঝেও তিস্তা চুক্তি নিয়ে এমন সব কথা বলেন যেন শেখ হাসিনা দেশের মানুষের স্বার্থের বিপক্ষে গিয়ে তিস্তা চুক্তিতে আগ্রহী নন। বঙ্গবন্ধুর কন্যা শেখ হাসিনা দেশের মানুষের স্বার্থের বিপক্ষে যাবেন এ কথা বোধহয় আজ পাগলেও বিশ্বাস করবে না। মনে পড়ে পঁচাত্তর-পরবর্তী সময় তখনকার সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ফারাক্কা মিছিল হয়েছিল মিছিলের বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে মনে হয়েছিল ভারতকে তুড়ি মেরে ফারাক্কা বাঁধ গুঁড়িয়ে দিয়ে তারা নদীর পানি কেড়ে নিয়ে আসবে। ফলাফল শূন্য। একাত্তরের সর্বোত্তম বন্ধু ভারতকে দেশের মানুষের কাছে শত্রু বানানো ছিল এই জাতীয় মিছিলের উদ্দেশ্য। অথচ শেখ হাসিনা গঙ্গার পানি ঠিকই এনেছিলেন তার বিচক্ষণ কূটনৈতিক দক্ষতায়। মাঝখানে একুশ বছর যারা রাজত্ব করেছেন তারা সারা ইনিংস খেলে রান করেছেন শূন্য। গণমাধ্যম মারফত জেনেছি তিস্তার পানি নিয়ে সৃষ্ট সঙ্কট মিটে যাবে। মিটে যাবে শেখ হাসিনার সরকারের মেয়াদকালেই। তার মানে এখানেও সেই শেখ হাসিনার কৃতিত্ব। তাই আমরা তাঁর উপরেই আস্থা রাখতে চাই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের রাষ্ট্রীয় সফর প্রায় দশ বছর পর। এর আগে তিনি যেবার রাষ্ট্রীয় সফরে ভারতে গিয়েছিলেন তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী ছিলেন ড. মনমোহন সিং। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমলে এটাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্রীয় সফর। এর আগে প্রধানমন্ত্রী মোদি দুই বছর আগে বাংলাদেশ সফর করে গেছেন। সেই সফরে তিনি জানিয়েছেন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রতি তাঁর অগাধ শ্রদ্ধার কথা। একাত্তরের যুদ্ধকালীন নিঃস্বার্থ বন্ধুত্ব, শেখ হাসিনার নেতৃত্ব, বাংলাদেশের মানুষের প্রতি ভালবাসা, বাংলাদেশের শনৈঃ শনৈঃ উন্নতি, নারীর ক্ষমতায়ন ইত্যাদি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদির স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতা মুগ্ধ করেছে এদেশের মানুষকে। গণমাধ্যমকর্মীরাও হয়েছিলেন তৃপ্ত। আগেই বলেছি প্রধানমন্ত্রী মোদির মেয়াদকালে এটাই শেখ হাসিনার প্রথম রাষ্ট্রীয় ভারত সফর। এর আগেও তিনি ভারতে গেছেন অন্য অনুষ্ঠানে সেখানে মোদিজির সঙ্গে তাঁর দেখা ও কথা হয়েছে। তাছাড়া ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের স্ত্রী বিয়োগের পর শেখ হাসিনার দিল্লী সফর ছিল মানবিক ও পারিবারিক সম্পর্কের গভীর নৈকট্যের কারণে। এই নৈকট্যের ভিত তৈরি হয়েছে একাত্তর এবং পঁচাত্তরে বঙ্গবন্ধু হত্যা-পরবর্তী সময়ে যখন অবলীলাক্রমে বেঁচে যাওয়া শেখ হাসিনা এবং শেখ রেহানা দিল্লীতে নিরাপদ আশ্রয় এবং আতিথেয়তা পেয়েছিলেন। সুবক্তা প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তাঁর বক্তৃতায় এবারও বলেছেন, বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের মানবিক সম্পর্কের বন্ধনের কথা। বলেছেন একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় দুই দেশের মধ্যে যে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন তৈরি হয়েছে তা অটুট রাখার কথা। জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভূমিকার প্রশংসা করে এই আশাও তিনি ব্যক্ত করেছেন যে, দুই দেশের ১৪০ কোটি মানুষের সুসম্পর্কের ওপর ভিত্তি করেই রচিত হবে উন্নতির সুদৃঢ় সোপান। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নামে দিল্লীর রাস্তার নামকরণ করেছেন নরেন্দ্র মোদি। মুক্তিযুদ্ধ এবং বঙ্গবন্ধুর উপর যৌথ প্রযোজনার চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারেও তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। টেলিভিশনে দেখেছি মোদিজির হিন্দী ভাষায় দেয়া সাবলীল, স্বতঃস্ফূর্ত, প্রাণবন্ত বক্তৃতা। হিন্দী ভাষা কম বুঝি, কিন্তু মোদিজির বডিল্যাঙ্গুয়েজ দেখে বুঝেছি সত্য ভাষণের আন্তরিক প্রকাশ। মহান মুক্তিযুদ্ধে শহীদ ভারতীয় সেনাদের সম্মাননা দিয়ে শেখ হাসিনাও দেখিয়েছেন চির অম্লান রক্তের বন্ধের প্রতি প্রগাঢ় আস্থা। যেখানে দাঁড়িয়ে নিশ্চিত হওয়া যায় যে ভারত বিশ্বাস করে শেখ হাসিনার আমলে দশ ট্রাক অস্ত্রের মতো ভয়াবহ ঘটনা কখনও ঘটবে না। বিচ্ছিন্নতাবাদীরা ভারতের নিরাপত্তায় বারবার আঘাত করার সুযোগ পাবে না। ভারতের মহামান্য রাষ্ট্রপতির সফরের সময় অনাবশ্যক হরতাল ডেকে বোমাবাজি করে ত্রাস সৃষ্টির অপচেষ্টা হবে না। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর শুরু হওয়ার দিন থেকেই দেখেছি বন্ধুত্বের প্রতি সম্মান জানানোর দৃষ্টান্ত। বিমানে ওঠার আগ মুহূর্তে শেখ হাসিনা জেনেছেন দিল্লীর পার্ক স্ট্রিটের নাম বদল করে বঙ্গবন্ধুর নামে নামকরণ করা হচ্ছে। আর দিল্লী বিমানবন্দরে অবতরণ করেই পেলেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির উষ্ণ ও আন্তরিক অভ্যর্থনা। দুই দেশের গণমাধ্যম যাকে ‘চমক’ হিসেবে উল্লেখ করেছে। যদ্দুর জানি, মার্কিন এবং চীনের প্রেসিডেন্টের পর প্রধানমন্ত্রী মোদি বোধহয় শেখ হাসিনাকেই নিজে বিমানবন্দরে এসে অভ্যর্থনা জানালেন। সবশেষে বলি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের ভারতের সফরের মধ্য দিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক উঠেছে এক ঐতিহাসিক উচ্চতায়। শেখ হাসিনা ও বাংলাদেশের বৈদেশিক নীতির অনন্য সাফল্যের যে মাইলফলক এবারের সফরে তৈরি হলো সেখান থেকেই শুরু হোক নতুন পথের শুভযাত্রা। লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব
×