ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ৩ বৈশাখ ১৪৩১

দিনেশ মাহাতো

দারিদ্র্য বিমোচনে গাভী পালন

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৯ এপ্রিল ২০১৭

দারিদ্র্য বিমোচনে  গাভী পালন

অনাদিকাল থেকেই এ দেশের মানুষ তাদের জীবন-জীবিকার তাগিদে গবাদিপশু-পাখি লালন-পালনে সম্পৃক্ত রয়েছে। জিডিপিতে প্রাণিসম্পদ খাতের অবদান ২.৫%। আমাদের জনসংখ্যার প্রায় ২২% সরাসরি এবং ৫০% পরোক্ষভাবে প্রাণিসম্পদ খাতের ওপর নির্ভরশীল। বাংলাদেশ কৃষি প্রধান দেশ। এ দেশের বেশিরভাগ মানুষ গ্রামে বাস করে। অনেক মানুষ আছে যাদের নিজের কোন জমি নেই। তারা অন্যের বাড়িতে কাজ করে। এ থেকে তারা যা উপার্জন করে তা দিয়ে তাদের সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হয়। ফলে দিনমজুর কৃষকের সন্তানদের পড়াশোনার সুযোগ তেমন হতো না বললেই চলে। কিন্তু বর্তমানে এ অবস্থার পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। আর এ পরিবর্তনের অন্যতম কারণই হচ্ছে গ্রামাঞ্চলে বা দিনমজুর কৃষকদের বাড়িতে গরু পালন ও অন্যান্য পশু পালন বৃদ্ধি পেয়েছে। উন্নত প্রযুক্তি উদ্ভাবন, এর ব্যবহার, উন্নত চিকিৎসা ব্যবস্থার ফলে গরু পালন এখন অনেক লাভজনক। গবাদিপশু পালনে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারে খামারিদের মাঝেও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে যা দেশে দুধ, মাংস উৎপাদনে প্রতিফলিত হচ্ছে। এমনকি যাদের গরু কেনার সামর্থ্য নেই তারাও অন্যের গরু পালন করেন এবং কয়েক মাস বা বছর পর বিক্রি করে যা লাভ হয় তার অর্ধেক পান। তা দিয়ে অনেক সময় একটি গরু কেনা হয়ে যায়। এভাবেও অনেকে গরুর মালিক হয়েছেন এবং কয়েক বছরের মধ্যে একাধিক গরুর মালিক হন। তাছাড়া বর্তমান বাজারে গরুর মূল্যও অনেক। একটি দেশী গরুর দামও প্রায় ৫০ থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত। গরুর দাম প্রতিনিয়ত বৃদ্ধির কারণে অনেকে অন্যের বাড়িতে কাজ না করে নিজে কয়েকটি গাভী পালন করছেন এবং দুধ বিক্রি করে সংসার চালাচ্ছেন। গ্রামের শিক্ষিত ছেলেরাও অনেকে গরুর খামার দিয়েছেন। এর ফলে বেকারত্বের হার কমে আসছে। এ ক্ষেত্রে দিনাজপুর জেলার চিরিরবন্দরের শাহীন সরকারের কথা উল্লেখ করা যেতে পারে। তিনি গরুর খামার করার পর মাত্র ১৫ বছরে কোটিপতি হয়েছেন। তিনি ২০০০ সালে মাত্র একটি গাভী দিয়ে খামার শুরু করেন। এ রকম অসংখ্য ব্যক্তি আছে যারা গরু পালনে তাদের নিজের ভাগ্যকে বদলে ফেলেছেন। গ্রামেও এখন অতি সহজে গরুর নানা ধরনের খাদ্য, ওষুধসহ যাবতীয় জিনিসপত্র পাওয়া যায়। প্রযুক্তি গ্রাম ও শহরের ব্যবধানও কমিয়েছে। আধুনিকতার এই যুগে ব্যয় সবার বেড়েছে, গ্রামেও সবার হাতেই প্রায় স্মার্টফোন। সকাল-সন্ধ্যা চায়ের সরগরম থাকে। কয়েক বছর আগেও গ্রামে মোটরসাইকেল খুব কম দেখা যেত আর এখন প্রায় বাড়িতেই দেখা যায়। কেননা একটি গরু বিক্রি করেই একটি মোটরসাইকেল পাওয়া যায়। একসময় গরুকে হাল চাষে ও গাড়িতে মাল বহন করার কাজে বেশি ব্যবহার করা হতো। এখন গরুর গাড়ি প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু প্রযুক্তির এ যুগে গরু চাষাবাদের জন্য তেমন একটা দরকার পড়ছে না। তবে জীবনের গতিশীলতা আনতে বা আর্থিক সচ্ছলতা আনতে গরু পালন বৃদ্ধি পেয়েছে। কোরবানির ঈদে দেশের গরু দিয়েই চাহিদা মেটানোর কথা বলা হয় কেননা আগের চেয়ে গ্রামাঞ্চলে এখন গরু পালন অনেক বেড়ে গেছে। গ্রামের মানুষের দৈনন্দিন সচ্ছলতা আনতেও বড় ভূমিকা রাখছে। অনেক বাবা-মা গরু-ছাগল পালন করে এবং বিশেষকরে কন্যার বিয়েতে তা বিক্রি করে বিয়ের খরচ যোগায়। এমনকি মেয়ের বিয়ের পর দুধ খাওয়ার জন্য বাবার বাড়ি থেকে গাভীও দিতে দেখা যায় অনেক সময়। এখন গ্রামে চিকিৎসার অভাবে কেউ মারা যায় না। কেননা একটি গরু বা ছাগল বিক্রি করে অনায়াসে সুচিকিৎসার ব্যয়ভার মেটানো সম্ভব। গ্রামে প্রায় সব এলাকাতেই বিদ্যুত রয়েছে, রয়েছে ডিস লাইন সংযোগ ফলে একজন দিনমজুরের বাড়িতেও রয়েছে টেলিভিশন। দেশ-বিদেশে কখন কি হচ্ছে শহরের লোকের মতোই সঙ্গে সঙ্গে পেয়ে যাচ্ছে। বিদ্যুত বিল, মোবাইল বিল, প্রত্যহ হাটবাজার, স্কুলপড়ুয়া ছেলেমেয়ের খাতা কলম, প্রাইভেটের খরচ সবকিছুর খরচ আসছে গাভীর দুধ বিক্রির মধ্য দিয়ে। তাই গবাদিপশু পালন বৃদ্ধির ফলে গ্রামের দারিদ্র্য যেমন কমছে তেমনি বাড়ছে শিক্ষার হার। ফলে বাংলাদেশ ক্ষুধামুক্ত, দারিদ্র্যমুক্ত ডিজিটাল দেশ হিসেবে এগিয়ে যাচ্ছে।
×