ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

বোস্টন সীফুড শো ও বাংলাদেশ

প্রকাশিত: ০৬:৩০, ৯ এপ্রিল ২০১৭

বোস্টন সীফুড শো ও বাংলাদেশ

মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুট অঙ্গ রাজ্যের রাজধানী বোস্টনে সুদীর্ঘ ৩৭ বছর ধরে ঝবধভড়ড়ফ ঊীঢ়ড় ঘড়ৎঃয অসবৎরপধ (ঝঊঘঅ) নামে মেলা অনুষ্ঠিত হয়। বিশ্বের তাবৎ মৎস্য ও মৎস্যপণ্য উৎপাদনকারী, আমদানিকারক ও রফতানিকারকগণ প্রতিবছর এই মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে। বোস্টন কনভেনসন এ্যান্ড এক্সিভিসন সেন্টারে গত ১৯-২১ মার্চ, ২০১৭ তিন দিনব্যাপী এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এক সময়ে বাংলাদেশের চিংড়ির এক নম্বর আমদানিকারী দেশ ছিল আমেরিকা। এখন আমেরিকার অবস্থান পঞ্চম। আমাদের প্রতিযোগী দেশ তথা ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, ইন্দোনেশিয়া, চিনসহ অন্যান্য দেশ বিপুল পরিমাণ চিংড়ি আমেরিকায় রফতানি করছে। এছাড়া, এ দেশগুলো বিপুল পরিমাণ তেলাপিয়া, পাঙ্গাস ও অন্যান্য মৎস্য পণ্যও রফতানি করে থাকে। বোস্টন আন্তর্জাতিক সিফুড মেলায় এ বছরে বিশ্বের প্রায় ১২০০ প্রতিষ্ঠানের মৎস্য ও মৎস্যপণ্য প্রদর্শনী ও অন্যান্য সেবা প্রদানকারীদের জন্য ৩৫০০ স্টল বরাদ্দ ছিল। এছাড়া ৬-৭টি বিশালাকার কক্ষে এই সময়ে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর ৩৫টি সেমিনার ও কনফারেন্স অনুষ্ঠিত হয়। দুর্ভাগ্যবশত এ বছর বোস্টনে আয়োজিত সীফুড মেলায় বাংলাদেশের হিমায়িত চিংড়ি পণ্য প্রদর্শনের জন্য কোন স্টল নেয়া হয়নি। অথচ এশিয়ার চীন, ভারত, থাইল্যান্ড, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া, মিয়ানমার, মালদ্বীপ, জাপান, কোরিয়া, তাইওয়ান, হংকং, মালয়েশিয়া ও ফিলিপিন্সসহ বিশ্বের কমপক্ষে ৮০টি দেশের সরকারী প্রতিষ্ঠান, ট্রেড এ্যাসোসিয়েশন ও কোম্পানিসমূহ নিজস্ব স্টল নিয়ে মৎস্য, চিংড়ি, কাঁকড়া, ঝিনুকসহ নানাবিধ পণ্য প্রদর্শনী করেছে। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো (ইপিবি) গত বছর এই মেলায় একটি স্টল নিয়েছিল। এ বছর স্টল না থাকায় মেলায় বাংলাদেশের অংশগ্রহণকারীদের জন্য কোথায়ও বসার কোন ব্যবস্থা ছিল না। তাই অনেকেই এশিয়ার বিভিন্ন দেশের স্টলে বসেছেন। বাংলাদেশ বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মৎস্য উৎপাদনকারী এবং চিংড়ি রফতানিতে ১৭তম স্থান অধিকারী দেশ হিসাবে স্বীকৃত। তাই এই বিশাল আন্তর্জাতিক মেলায় কোন স্টল না থাকা দুঃখজনক ও অনভিপ্রেত। মেলায় প্রদর্শিত পণ্যের বিরাট অংশজুড়ে ছিল চিংড়ি, স্যালমন, তেলাপিয়া, পাঙ্গাস, কাঁকড়া, ঝিনুক ও অন্যান্য সামুদ্রিক মৎস্য। এই মেলার অধিকাংশ স্টলেই অধিক উৎপাদনশীল ও কমদামী নতুন প্রজাতির ভেনামি চিংড়ি ব্যাপক প্রদর্শন হয়েছে। বাংলাদেশে উৎপাদিত বাগদা ও গলদা চিংড়ি কোন স্টলেই দেখা যায় নাই। বাংলাদেশে ভেনামি চিংড়ি চাষ হয় না। আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের চিংড়ির চেয়ে ভেনামি চিংড়ির মূল্য পাউন্ড প্রতি প্রায় ১.০০ ডলার কম। বাগদা ও গলদা চিংড়ির তুলনায় ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন কয়েকগুণ বেশি বিধায় বর্তমানে ভারতসহ বিশ্বের প্রায় সকল চিংড়ি উৎপাদনকারী দেশ ভেনামি চিংড়ি উৎপাদন করে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে। ফলে উন্নত বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাহিদা দিন দিন কমে যাচ্ছে। বাগদা ও গলদা চিংড়ির চাহিদা কমে যাওয়ায় ইতোমধ্যে ইউরোপ ও আমেরিকায় আমাদের দীর্ঘদিনের বহু প্রতিষ্ঠিত বায়ার হারিয়েছি। বায়ারদের একটিই কথা ‘ভেনামি চিংড়ি দাও অথবা ভেনামির দরে বাগদা-গলদা বিক্রয় কর। আমরা অর্ডার দিতে রাজি আছি।’ বাংলাদেশের বাগদা-গলদার উৎপাদন ও ক্রয়মূল্য ভেনামির তুলনায় নানাবিধ কারণে অনেক বেশি। তাই ভেনামির সঙ্গে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকা অনেক কঠিন হয়ে পড়েছে। ফলে অনেক সময় বাজার ধরে রাখার স্বার্থে রফতানিকারকগণ কম দামে বাগদা/গলদা বিক্রয় করতে বাধ্য হচ্ছে। বোস্টনে অনুষ্ঠিত মেলায় কাঁকড়ার অনেকগুলো স্টল দর্শনার্থীদের নজর কেড়েছে। কাঁকড়ার প্যাকেজিং অত্যন্ত সুন্দর ও উন্নত হওয়ায় দর্শনার্থীদের নিকট এর প্রতি আলাদা আকর্ষণ দেখা গিয়েছে। আন্তর্জাতিক বাজারে কাঁকড়ার চাহিদা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, ভারত, মিয়ানমার, তাইওয়ান, ইন্দোনেশিয়া ও ফিলিপিন্সে বিপুল পরিমাণ মূল্য সংযোজিত কাঁকড়া রফতানি করছে। বাংলাদেশেও কাঁকড়ার রফতানি ক্রমাগত বৃদ্ধি পাচ্ছে। গত অর্থবছরে বাংলাদেশ হতে ২৩.৮১ মি. ডলারের কাঁকড়া বিদেশে রফতানি হয়েছে। কয়েকটি প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াজাত ও মূল্য সংযোজিত করে কাঁকড়া ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ও কোরিয়ায় রফতানি করছে। তবে এদেশের বেশিরভাগ ব্যবসায়ী জীবিত কাঁকড়া চিন, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, তাইওয়ান, জাপান ও সিঙ্গাপুর ইত্যাদি দেশে রফতানি করে থাকে। দেশের উৎপাদিত কাঁকড়াকে চিংড়ির বিকল্প একটি অত্যন্ত সম্ভাবনাময় রফতানি পণ্য হিসাবে অনেকেই মনে করে থাকেন। তাই টেকসই ও পরিবেশবান্ধব কাঁকড়া চাষ ও অধিক মূল্য সংযোজিত পণ্যে রূপান্তরের কার্যকরী পদক্ষেপ নেয়া একান্ত আবশ্যক। বাংলাদেশের বিশাল উপকূলীয় অঞ্চল কাঁকড়া চাষের জন্য অত্যন্ত অনুকূল। মেলায় আমোরিকায় বসবাসকারী বাংলাদেশী একজন বায়ার এজেন্ট এর সঙ্গে আমাদের কথা হয়েছে। তিনি বলেন প্রাণের টানে বাধ্য হয়ে আমরা বাংলাদেশের চিংড়ি বিক্রয় করছি। আমেরিকায় আমি ভারত, ভিয়েতনাম, থাইল্যান্ড, মিয়ানমারসহ অন্যান্য দেশের শত শত কন্টেইনার ভেনামি চিংড়ি বিক্রয় করে থাকি। দামে সস্তা বিধায় ইউরোপ ও আমোরিকার ক্রেতারা ভেনামি চিংড়ির দিকে ব্যাপকভাবে ঝুঁকে পড়েছে। তিনি অর্গানিক চিংড়ি ও উচ্চতর মূল্য সংযোজিত চিংড়ি উৎপাদনে এগিয়ে আসার জন্য বাংলাদেশী রফতানিকারকদের পরামর্শ দেন। এছাড়া, বাগদা ও গলদা চিংড়িকে ভেনামি চিংড়ির সঙ্গে প্রতিযোগিতা করার জন্য সম-মূল্যে বিক্রয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এই মুহূর্তে ভেনামি চিংড়ি আন্তর্জাতিক বাজারে আমাদের বাগদা ও গলদা চিংড়ির প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী। আমরা ২০০৫ সালে আমেরিকায় ১৬০ মিলিয়ন ডলারের চিংড়ি রফতানি করেছি। আর গত অর্থবছর (২০১৫-২০১৬) এর রফতানির পরিমাণ ছিল মাত্র ৪১ মিলিয়ন ডলার। আমরা বিগত ৫-৬ বছরে ভেনামি চিংড়ির ধাক্কায় ইউরোপ ও আমেরিকায় আমাদের দীর্ঘদিনের অনেক মূল্যবান ক্রেতা হারিয়েছি। তাই আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকতে হলে সরকারের সার্বিক সহযোগিতা ছাড়া আমরা এই সেক্টরকে বাঁচাতে পারব না। এই জন্য সরকারকে অবশ্যই কিছু বাস্তব পদক্ষেপ গ্রহণ করা প্রয়োজন। এ জন্য অর্থ, বাণিজ্য এবং মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয় এর যৌথ উদ্যোগে একটি টাস্কফোর্স গঠন করে প্রচলিত বাগদা চাষের পাশাপাশি অতিদ্রুত ভেনামি চিংড়ি চাষের উদ্যোগ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরী। এছাড়া, আন্তর্জাতিক বাজারে টিকে থাকার জন্য চিংড়িতে প্রকৃত ইনভয়েস মূল্যের উপর ২০% হারে নগদ সহায়তা প্রদান, অধিক উৎপাদনের লক্ষ্যে চিংড়ি চাষে ৫% সুদ হারে ঋণ প্রদান, কাঁকড়া চাষকে উৎসাহ প্রদানের জন্য সুদমুক্ত ঋণ দান এবং বোস্টন ও ব্রাসেলস এ অনুষ্ঠিত মেলায় ১০০ ভাগ সরকারী অনুদানে অংশগ্রহণ এর সুবিধা প্রদান একান্ত আবশ্যক।
×