ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

সরোদের সুরে ভোরের রাগালাপে শুরু হবে রমনা বটমূলে ৫০তম বর্ষবরণ

আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও... এবার আবার গাইবে ছায়ানট

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৯ এপ্রিল ২০১৭

আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও... এবার আবার গাইবে ছায়ানট

মনোয়ার হোসেন ॥ প্রতিটি চৈতালী সন্ধ্যায় সুর ঝরছে ধানম-ির ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে। সেই সুরের মাঝে লুকিয়ে আছে বৈশাখের আগমনী বারতা। গানে গানে বলা হচ্ছে সম্প্রীতির কথা, উচ্চারিত হচ্ছে আত্মপরিচয়ের অহংকার। বাঙালীর শেকড়ের সংস্কৃতির কথা বলা প্রতিষ্ঠানটিতে বিরাজ করছে উৎসবের অপরূপ আমেজ। সেই সুবাদে লালরঙা দালানটিতে বইছে প্রাণের উচ্ছ্বাস। আর সকল আনন্দই আবর্তিত হচ্ছে আসন্ন বাংলা নববর্ষ উদ্যাপন কেন্দ্র করে। বিগত বছরের চেয়ে এবারের ছায়ানটের বর্ষবরণ তৎপরতায় রয়েছে বিশেষ তাৎপর্য। আছে ইতিহাসের হাতছানি। ১৯৬৭ সালে পাক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে রমনা বটমূলে প্রথম বর্ষবরণের আয়োজন করেছিল ছায়ানট। বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপনের সেই প্রভাতী সঙ্গীতায়োজনটি ১৪২৪ বঙ্গাব্দে পদার্পণ করবে পঞ্চাশতম বছরে। তাই পঞ্চাশতম বর্ষবরণের প্রস্তুতিতে চিরচেনা ছায়ানট ভবনটি এখন আরও বেশি প্রাণময়। ঐতিহ্যবাহী প্রতিষ্ঠানটির শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা আসন্ন নববর্ষকে রাঙিয়ে দেয়ার প্রয়াসে উজাড় করে দিচ্ছে নিজেদের। প্রতিদিন সন্ধ্যায় নিয়ম করে চলছে পঞ্চাশতম নববর্ষ উদ্যাপন সার্থক করে তোলার মহড়া। বাণীর সঙ্গে সুরের আলিঙ্গনে প্রকাশিত হচ্ছে ‘কায়মনে বাঙালি’ হবার শপথ। বাঙালীর আত্মপরিচয়ের স্বরূপ সন্ধানী পঞ্চাশতম বর্ষবরণ সম্প্রীতির গান গাইবে ছায়ানট। নববর্ষ আবাহনে আনন্দের সঙ্গে উচ্চারিত হবে সাম্প্রদায়িক-তাবিরোধী মানবিকতার সুর। ‘আনন্দ, বাঙালীর আত্মপরিচয়ের সন্ধান ও অসাম্প্রদায়িকতা’ প্রতিপাদ্যে উদ্যাপিত হবে এবারের নববর্ষ। সরোদের রাগ আলাপে শুরু হবে রমনা বটমূলের পঞ্চাশতম বর্ষবরণের আয়োজন। ইতিহাসের সাক্ষী হয়ে থাকা পঞ্চাশতম নববর্ষ উদ্্যাপনকে আনন্দপূর্ণ ও তাৎপর্যময় করতে আয়োজনে থাকছে লোকগানের পৃথক পর্ব। সব মিলিয়ে ঘণ্টা দুয়েকের গান ও পাঠাবৃত্তির মূল পর্ব শেষে পরিবেশিত হবে প্রান্তিক সংস্কৃতির কথা বলা ঘণ্টা ব্যাপ্তির পালাগান। নববর্ষ উদ্্যাপন কেন্দ্র করে জাতীয় উৎসবে পরিণত হওয়া আয়োজনটি এ বছর প্রায় দেড় ঘণ্টা বর্ধিত হয়ে চলবে সকাল দশটা অবধি। এছাড়া পুরো আয়োজনে ভেসে বেড়াবে পঞ্চকবির গান। গাওয়া হবে রবীন্দ্রনাথ, নজরুল, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, অতুল প্রসাদ ও রজনীকান্ত সেনের গান। সেই সঙ্গে মানবিকতার আবাহনে গীত হবে বাউলসাধক লালন সাঁইয়ের গান। ১৪২৪ বঙ্গাব্দের বর্ষবরণে ছায়ানটের শিল্পী শিক্ষক ও শিক্ষার্থী শিল্পীদের কণ্ঠে পরিবেশিত হবে দশটি সম্মেলক গান। একক কণ্ঠে গাওয়া হবে চৌদ্দটি গান। সব মিলিয়ে পরিবেশনায় অংশ নেবে ১৬০ কণ্ঠশিল্পী। পহেলা বৈশাখ ভোর ছয়টা ১০ মিনিটের সরোদিয়া রাজরূপা চৌধুরীর সরোদের সুরে ভোরের রাগালাপে শুরু হবে আপন সংস্কৃতির পথরেখা মেলে ধরা বটমূলের ৫০তম বর্ষবরণ। ১৯৬৭ সালের প্রথম বর্ষবরণে পরিবেশিত হয়েছিল ‘আলোকের এই ঝর্ণাধারায় ধুইয়ে দাও/আপনাকে এই লুকিয়ে রাখা ধুলার ঢাকা ধুইয়ে দাও’। মনের মলিনতা ঘুচিয়ে সুন্দরের পথে চলার বার্তাবহ সেই গানটি সম্মেলক কণ্ঠে গাওয়া হবে পঞ্চাশতম বর্ষবরণেও। এছাড়াও বাঙালিত্বের গৌরবগাথার স্মারক এই নববর্ষের অনুষ্ঠানে সম্মেলক ও একক কণ্ঠে গাওয়া হবে ‘আনন্দধ্বনি জাগাও গগনে’, ‘ওরে বিষম দরিয়ার ঢেউ’, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘ভোরের হাওযায় এলে ঘুম ভাঙাতে’, ‘একি অপরূপ রূপে মা তোমায় হেরিনু পল্লী জননী’ ও ‘উদয়শিখরে জাগে মাভৈ মাভৈ’সহ অনেকগুলো গান। একক কণ্ঠে গান শোনাবেন চন্দনা মজুমদার, খায়রুল আনাম শাকিল, মিতা হক, ইফ্্ফাত আরা দেওয়ান, মহিউজ্জামান চৌধুরী ময়না, নাসিমা শাহীন ফ্যান্সিসহ খ্যাতিমান শিল্পীরা। সুরের আশ্রয়ে মানুষের মাঝে মঙ্গলের বারতা ছড়ানো আয়োজনটিকে গানের সঙ্গে থাকবে কবিতার শিল্পিত উচ্চারণ। সব মিলিয়ে দুই ঘণ্টাব্যাপী চলবে গান ও পাঠাবৃত্তিতে সাজানো অনুষ্ঠানটি। এরপর শুভেচ্ছা কথনে মঞ্চে আসবেন ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুন। তাঁর শুভেচ্ছা কথন শেষে কিছুটা বিরতি দিয়ে শুরু হবে বর্ষবরণের পঞ্চাশ বছর পূর্তির বিশেষ আয়োজন। বাংলার লোকসংস্কৃতির ঐতিহ্যের আলোয় ‘দেওয়ানা মদিনা’ শীর্ষক পালাগান পরিবেশন করবেন নেত্রকোনার দিলু বাউল। রমনার বটমূলে পঞ্চাশতম বর্ষবরণ প্রসঙ্গে ছায়ানটের সাধারণ সম্পাদক লাইসা আহমদ লিসা জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে যখন নতুন করে দেশের জঙ্গীবাদ ও উগ্রপন্থা মাথাচাড়া দিয়েছে সেই অস্থির সময়ে এবারের নববর্ষে উচ্চারিত হবে সম্প্রীতির বারতা। মনের আনন্দে আবাহন করা হবে বাঙালীর আত্মপরিচয়ের গৌরবকে। সেই পরিপ্রেক্ষিতে আত্মশক্তিতে বলীয়ান হয়ে উঠতে এ বছরের নববর্ষ উদ্যাপনটি আমাদের কাছে বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আয়োজনটি সাধারণ মানুষের কাছে আরও বেশি হৃদয়গ্রাহী করে তুলতে মূল অনুষ্ঠানের সঙ্গে রয়েছে বিশেষ আয়োজন। এই বিশেষ আয়োজনে যুক্ত হয়েছে ‘দেওয়ানা মদিনা’ শিরোনামের পালাগান। দেশের আবহমান লোকসংস্কৃতির সঙ্গে সম্পর্কটি আরও আত্মিক করতে রাখা হয়েছে এ পর্বটি। আশা করছি, এ বছরের নববর্ষে জনসমাগম অতীতের তুলনায় অনেক বেশি হবে। টেলিভিশন বা বেতারে নববর্ষের অনুষ্ঠান উপভোগ না করে ইতিহাসের সাক্ষী হতে হাজির হবেন পঞ্চাশতম বর্ষবরণে। পঞ্চাশতম বর্ষবরণের প্রস্তুতি প্রসঙ্গে লাইসা আহমদ লিসা বলেন, এবারের নববর্ষ উদ্্যাপনকে আমরা স্মরণীয় করে রাখতে চাই। অনুষ্ঠানকে সফল করতে নিয়মিত অনুশীলন চলছে ছায়ানট ভবনে। প্রতিদিন সন্ধ্যায় শিক্ষক শিল্পীদের নিবিড় পরিচর্যায় শিক্ষার্থী শিল্পীরা অংশ নিচ্ছে মহড়ায়। আমিসহ গানগুলো শিক্ষার্থীদের কণ্ঠে তুলে দিচ্ছেন শাহীন সামাদ, খায়রুল আনাম শাকিল, বিমান চন্দ্র বিশ্বাসসহ শিক্ষক শিল্পীরা। গানের যথার্থ বাণী, অন্তরা, সুর ও তালের ভুল হলে সেই ত্রুটিগুলো শুধরে নেয়া হচ্ছে। এভাবেই নববর্ষ আবাহনে অংশ নেয়া বাছাইকৃত শিক্ষার্থীদের মহড়া চলছে। অনুশীলন থেকে গানের পরিপূর্ণতা প্রাপ্তির পর সেটি আবার চূড়ান্তভাবে দেখে দিচ্ছেন ছায়ানট সভাপতি সন্্জীদা খাতুন। পঞ্চাশতম বর্ষবরণের অনুশীলন পর্বটি চলবে ১৩ এপ্রিল পর্যন্ত। বরাবরের মতো এবারও রমনা বটমূলে বাংলা নববর্ষ উদ্্যাপনের অনন্য অনুষ্ঠানটি সরাসরি সম্প্রচার করবে বাংলাদেশ টেলিভিশন ও বাংলাদেশ বেতার। এছাড়া বর্ষবরণের অনুষ্ঠানটি সরাসরি দেখা যাবে ছায়ানটের ওয়েবসাইটে। বটমূলে বর্ষবরণের পঞ্চাশ বছর পূর্তি স্মরণীয় করে রাখতে চলছে চার পর্বে সজ্জিত ছায়ানটের মাসব্যাপী বিশেষ অনুষ্ঠান। ২৪ মার্চ সংবাদ সম্মেলন ও সঙ্গীতানুষ্ঠানের মাধ্যমে এ আয়োজনের সূচনা হয়। এরপর ৩১ মার্চের আয়োজনে ছায়ানট ভবন সাজানো হয় নববর্ষ উদ্্যাপনের অভিযাত্রার স্মারণিক প্রদর্শনী দিয়ে, যেখানে ঠাঁই পেয়েছে আলোকচিত্র ও পেপার কাটিংয়ে সাজানো ১৯৬৭ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত বর্ষবরণের ধারাবাহিক বিবরণ। সেই সঙ্গে সেদিনের আয়োজনে ছিল নৃত্য, শুদ্ধসঙ্গীত, পাঠাবৃত্তি ও গান। তৃতীয় অনুষ্ঠানটি হয়ে গেল ৭ এপ্রিল। এদিন বর্ষবররণের ৫০ বছর পূর্তি উপলক্ষে ১৪২৪ বঙ্গাব্দের বিশেষ বর্ষপঞ্জি প্রকাশের পাশাপাশি অনুষ্ঠিত হয়েছে সেমিনার ও সঙ্গীতানুষ্ঠান। চতুর্থ অনুষ্ঠানটি হবে ১৩ এপ্রিল চৈত্রসংক্রান্তির সন্ধ্যায়। সেদিন ২০০১ সালের নববর্ষ অনুষ্ঠানে বোমা হামলায় রমনা বটমূলে নিহত নিরীহ দর্শক-শ্রোতাদের স্মরণ করা হবে কথা, গান ও প্রদীপ প্রজ্বালনের মাধ্যমে। ১৯৬১ সালে রবীন্দ্রজন্মশতবার্ষিকী উদ্্যাপন কেন্দ্র করে যাত্রা শুরু করে ছায়ানট। তৎকালীন পাকিস্তানী আমলের বৈরী পরিবেশে বাঙালী জাতিসত্তাকে জাগিয়ে তোলা ও আপন সংস্কৃতিতে আলিঙ্গনের অভিপ্রায় নিয়ে শুরু হয় এই অভিযাত্রা। ছায়ানট বাংলা বছরকে আবাহন জানানোর প্রথম প্রয়াসটি নেয় ১৯৬৭ সালে। ‘কায়মনে বাঙালি’ হবার শপথ নিয়ে সেই থেকে, গত পাঁচ দশক ধরে নতুন বাংলা বছরের প্রথম প্রভাত অর্থাৎ পহেলা বৈশাখের ভোরে রমনার বটমূলে সঙ্গীতায়োজন করে আসছে সংগঠনটি। ভালবাসা ও সম্প্রীতির বন্ধনে পরস্পরকে আবদ্ধ করবার এই উদ্যোগ আপামর বাঙালীকে প্রাণিত করেছে। ২০০১ সালে উগ্রবাদীদের বোমা হামলাও রুখতে পারেনি এ আয়োজনকে। বরং অশুভকে পদদলিত করে কল্যাণের পথযাত্রার দিশা দেয়া নববর্ষের এ প্রভাতী আয়োজনে আরও বেশি সম্পৃক্ত হয়েছে সাধারণ মানুষ।
×