ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

বনদস্যুদের হামলার শিকার বনরক্ষী

মধুপুরে হুমকির মুখে বন্যপ্রাণী

প্রকাশিত: ০৪:১২, ৯ এপ্রিল ২০১৭

মধুপুরে হুমকির মুখে বন্যপ্রাণী

ইফতেখারুল অনুপম, মধুপুর থেকে ফিরে ॥ চার দশক আগে মধুপুর বনে বাঘ ছিল। হরিণ, বন্য শূকর ঘুরে বেড়াত। গাছে গাছে লাফালাফি করত হনুমান। রাতে বন এলাকায় থাকা মানুষের বাড়ির গোয়াল থেকে বাঘ এসে গরু-ছাগল ধরে নিয়ে যেত। দেখতে দেখতে বাঘ, হরিণ, শূকর হারিয়ে গেছে। এখন যে দু-চারটি বানর ও হনুমান আছে, তাও বিলুপ্তের পথে। কথাগুলো বলছিলেন মধুপুর বনাঞ্চলের প্রবীণ ব্যক্তি অজয়। ছোটবেলায় তার নিজ গ্রাম পীরগাছা এবং আশপাশের এলাকায় বন্যপ্রাণীদের বিচরণের স্মৃতি রোমন্থন করে বলেন, সে সময় বনজুড়ে পশুপাখির থাকার জায়গা ও খাবারের অভাব ছিল না। বন ধ্বংস এবং বিদেশী গাছ লাগানোর পর থেকে পশুপাখির খাবারের অভাব শুরু হয়। ফলে দিনদিন হারিয়ে যাচ্ছে বন্যপ্রাণী। বনাঞ্চলের অধিবাসীরা বলেন, মূলত সত্তরের দশকে মধুপুর বন ধ্বংস শুরু হয়। দস্যুরা সে সময় নির্বিচারে শাল ও গজারি গাছ নিধন শুরু করে। তখন থেকে পশুপাখির খাদ্য ও আবাসনের সঙ্কট শুরু হয়। ১৯৮৯ সালে এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের সহায়তায় শালবনে সামাজিক বনায়ন শুরু হয়। এ প্রকল্পের আওতায় বিদেশী প্রজাতির আকাশমণি, মেনজিয়াম, ইউক্যালিপটাস প্রভৃতি বিদেশী প্রজাতির গাছ লাগানো হয়। পরিবেশবিদরা বলেন, এসব গাছ দ্রুত বর্ধনশীল হলেও এগুলো জীববৈচিত্র্যবান্ধব নয়। এসব গাছের গোড়ায় ঝোপজঙ্গল হয় না। ফলে বন্যপ্রাণী বিচরণ করতে পারে না। ডালে পাখিও বসে না। তাছাড়া এসব গাছের পাতা কোন প্রাণী খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করে না। সাধারণত গজারি গাছের কচি পাতা খেয়ে বানর ও হনুমান জীবন ধারণ করে। শাল ও গজারি গাছের জায়গায় বিদেশী প্রজাতির গাছ রোপণ করায় বন্যপ্রাণীর মধ্যে খাদ্যের অভাব দেখা দেয়। ফলে গত ২৫ বছরে এ বনে বানর, হনুমান হ্রাস পেয়েছে। আগে বনের প্রায় সব এলাকাতেই বানর ও হনুমানের দেখা মিলত। এখন দু-একটি জায়গায় হাতে গোনা কিছু বানর ও হনুমান দেখা যায়। বন বিভাগ থেকে এ বছর প্রকাশিত মধুপুরের বন্যপ্রাণী র্শীষক প্রকাশনায় উল্লেখ করা হয়েছে, বিগত ১৯৭৭ সালে হোসেন এ্যান্ড হক পরিচালিত জরিপে এ বনাঞ্চলে ১৪০ প্রজাতির পাখির দেখা পাওয়া যায় মর্মে উল্লেখ করা হয়েছে। এছাড়া ওই সময় বনে প্রায় সাত হাজার বানর ছিল। ১৯৮২ সালে যুক্তরাষ্ট্রের কারড্রিপ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক গিটিস পরিচালিত জরিপে এই বনে ২১ প্রকার বন্যপ্রাণীর অস্তিত্বের কথা বলা হয়। ওই জরিপে বনাঞ্চল সাবাড়, অবৈধভাবে বন্যপ্রাণী শিকার এবং লোকালয় সম্প্রসারিত হওয়ায় বন্যপ্রাণীদের এ দুরবস্থা হয়েছে বলে উল্লেখ রয়েছে। তাছাড়া ওই প্রকাশনায় আরও উল্লেখ করা হয়েছে, গত বছরের ডিসেম্বরে মধুপুর বনে আট হাজার একর এলাকায় (যেখানে এখনও প্রাকৃতিক বনের অস্তিত্ব রয়েছে) বন বিভাগ পরিচালিত জরিপে এখানে ১৭ প্রজাতির বন্যপ্রাণী এবং ৪৭ প্রজাতির পাখির অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। সম্প্রতি মধুপুর বনের রসুলপুর, গায়রা, জলই, রাজাবাড়ী, জলছত্র, বেরিবাইদ, থানারবাইদ, টেলকী, চুনিয়া, ঘুঘুর বাজার, লুহুরিয়াসহ আরও কয়েকটি এলাকা ঘুরে শুধু লুহুরিয়া ও জলই এলাকায় কয়েকটি হনুমান ও বানর চোখে পড়ে। বন বিভাগ জানায়, মধুপুর বনে কতসংখ্যক বন্যপ্রাণী আছে, তাদের কাছে সে তথ্য নেই। তবে বনের লুহুরিয়া এলাকায় বন বিভাগের উদ্যোগে হরিণ প্রজননকেন্দ্র রয়েছে। এখানে ৭০টি হরিণ ও কিছু বানর রয়েছে। বিভাগীয় বন র্কমর্কতা মাসুদ রানা বলেন, এসব হরিণ ও বানরের খাবারের জন্য মাসে পাঁচ হাজার টাকা বরাদ্দ রয়েছে, যা খুবই অপ্রতুল। বর্ষা মৌসুমে হরিণগুলো ঘাস পায়, কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে এগুলো খাদ্যাভাবে পড়ে। মধুপুর বন প্রভাবশালী ভূমিদস্যুদের আগ্রাসনে আজ নিশ্চিহ্ন হওয়ার পথে। ওষুধি, বনজ ও ফলদ বৃক্ষের সঙ্গে শাল, সেগুন, লোহা, বহেরার ও ঝুপড়ি বনে সমৃদ্ধ সুন্দর এ প্রাকৃতিক বনটি নির্বিচারে উজাড় করে নির্বিঘেœ ভূমি দখল করে আবাদি জমিতে পরিণত করা হচ্ছে। প্রকাশ্যে উজাড় করা হচ্ছে মূল্যবান এ প্রাকৃতিক বন। বন ধ্বংস করে একরের পর একর বনভূমিতে আবাদ করা হচ্ছেÑ কলা, আনারস। বন বিভাগ এ ধ্বংসযজ্ঞ ও ভূমি জবর দখলের নীরব দর্শক। তাদের চোখের সামনেই চলছে বন ধ্বংসের তা-ব। এসবের নেপথ্যে রয়েছে রাঘব-বোয়ালরা। বন বিভাগ তাদের সামনে অসহায়। বাঁধা দেয়ার সাহস নেই। দু’একটি মামলা দিয়েই তারা ক্ষ্যান্ত। ক্ষমতার প্রভাবে সে মামলারও কোন তদন্ত বা কার্যকারিতা নেই। মাত্র ক’বছরেই শত একর জমির বন উজাড় করে আবাদি জমিতে পরিণত করে কলা, আনারস চাষ হচ্ছে। অব্যাহতভাবে চলছে বন ধ্বংসের মহাযজ্ঞ। জাতীয় উদ্যান সদর রেঞ্জের কাকড়াগুনী এলাকায় লোহড়িয়া বিটের কাছে রাস্তার পাশে তিন মাইলের খুঁটির উত্তরপাশে গজারি বন ধ্বংস করে শত একর বনভূমিতে কলা, আনারস চাষ হচ্ছে। এদিকে প্রকাশ্যে বনদস্যুদের হামলায় মধুপুর বনাঞ্চলে দায়িত্বরত ছয় বনপ্রহরী আহত হয়েছে। গত ১৯ মার্চ বিকেলে ময়মনসিংহের ফুলবাড়ীয়া উপজেলার চাঁনপুর গ্রামের বনদস্যু হাবুল ও বাবুলের নেতৃত্বে ৩০-৪০ জন মধুপুর সদর বিটের বটচতল এলাকায় বন কাটছিল। এ সংবাদ পেয়ে বনপ্রহরী ও সিএফডাব্লিওর কর্মীরা ঘটনাস্থলে গিয়ে বাধা প্রদান করে। একপর্যায়ে বনদস্যুরা বনপ্রহরী ও সিএফডাব্লিওর কর্মীদের ওপর ধারালো অস্ত্র দিয়ে হামলা চালায়। এতে ঘটনাস্থলে বনপ্রহরী কার্তিক চন্দ্র দাস, আতিক মিয়া, সিদ্দিক হোসেন, আব্দুল লতিফ, উসমান গণি, শহীদুল ইসলাম আহত হয়। এদের মধ্যে গুরুতর আহত কার্তিক ও লতিফকে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ ব্যাপারে সহকারী বন সংরক্ষক এম এ হাসান বলেন, বন কাটার কথা শুনে ঘটনাস্থলে বনপ্রহরীদের পাঠাই। বাধা দিলে বনদস্যুরা বনপ্রহরীদের ওপর হামলা চালায়। সংবাদ পেয়ে পুলিশের সহায়তায় ঘটনাস্থল থেকে আহত বনপ্রহরীদের উদ্ধার করি। অরণখোলা ফাঁড়ির ইনচার্জ এসআই আমিনুল ইসলাম জানান, বন কাটাকে কেন্দ্র করে বনপ্রহরী ও বনদস্যুর মাঝে সংঘর্ষ হয়। সংবাদ পেয়ে ঘটনাস্থল থেকে আহত বনপ্রহরীদের উদ্ধার করে স্থানীয় হাসপাতালে পাঠানো হয়েছে। বনদস্যুরা পালিয়েছে। এ ব্যাপারে মামলা হয়েছে। টাঙ্গাইল বন বিভাগ উত্তরের সহকারী বন সংরক্ষক এসিএফ হাসান আলী জানান, বিভিন্ন বিষয়ে থানায় মামলা দেয়া হয়েছে। কিন্তু কোন কার্যকারিতা নেই।
×