ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নিরাপত্তার নামে বাড়াবাড়ি নয়

প্রকাশিত: ০৩:৪৩, ৯ এপ্রিল ২০১৭

নিরাপত্তার নামে বাড়াবাড়ি নয়

পহেলা বৈশাখ বাঙালীর প্রাণের উৎসব। আনন্দ ও শান্তির উৎসব। এক কথায় সর্বজনীন ঐক্য, মৈত্রী, সৌভ্রাতৃত্ব ও সম্প্রীতির উৎসব। পহেলা বৈশাখের উৎস বাঙালীর আবহমানকালের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, আহার-বিহার, আচরণ ইত্যাদির সাড়ম্বর পালনোৎসব। সত্যি বলতে কি, এ যেন অনেকটা বাঙালীর একান্ত, নিজস্ব আঙিনায় ঘরে ফেরার আনন্দোৎসব। এদিন শহর-বন্দর-গ্রাম-গঞ্জ নির্বিশেষে বাঙালীর ঘরে ঘরে অপার আনন্দের ফল্গুধারা, ধর্মবর্ণ-জাতপাত নির্বিশেষে অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনার স্ফূরণ। আর এতসব আয়োজন, এত কিছুর অনিবার্য প্রভাবেই পুরনো বছরকে বিদায় জানিয়ে নতুন বছরকে সম্ভাষণ জানাতে নাগরিক সম্প্রদায় বের করে থাকে মঙ্গল শোভাযাত্রা। এই অভিযাত্রা মূলত অশুভ থেকে শুভর দিকে, অশান্তি থেকে শান্তির দিকে, অমঙ্গল থেকে মঙ্গলের দিকে। আনন্দের কথা এই যে, মঙ্গল শোভাযাত্রার এই আয়োজন কয়েক বছর ধরে আরও বিকশিত হয়ে ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য বিভাগীয় শহর-নগর-বন্দরেও। পহেলা বৈশাখের অন্যতম একটি অনুষঙ্গ শুভ হালখাতাÑ বর্ষবিদায় ও শুভ নববর্ষ কম-বেশি আড়ম্বরসহকারে সুদূর মফস্বল ও গ্রামগঞ্জে সেই আদিকাল থেকেই পালিত হয়ে আসছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা তাতে যোগ করে বাড়তি আনন্দমাত্রা। এ যেন অনেকটা নগর জীবনের সঙ্গে গ্রামবাংলার ফেলে আসা স্মৃতিকাতর প্রাণের সংযোগ। তবে অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয়, বাঙালীর একান্ত ঐতিহ্যবাহী এই আনন্দঘন মঙ্গল শোভাযাত্রায় হিংস্র থাবা বসাতে উদ্যত যেন কিছু অশুভ শক্তি। পয়লা বৈশাখ উপলক্ষে উৎসব-শোভাযাত্রা আয়োজনের ব্যাপারে একরকম নিষেধাজ্ঞা সেই পূর্ব পাকিস্তান আমল থেকেই ছিল। পাকিস্তানী সামরিক ও হঠকারী শাসকগোষ্ঠী বাঙালীর এই স্বাদেশিকতা ও স্বাজাত্যবোধ কোন দিনই মেনে নিতে পারেনি। সঙ্গত কারণেই আশা করা গিয়েছিল যে, মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মাধ্যমে সেই অশুভ শক্তির বিনাশ ঘটেছে। বাস্তবে দেখা যাচ্ছে যে তা হয়নি। একাত্তরের পরাজিত শক্তি পাকিস্তানীদের সহায়তাকারী এদেশীয় দালাল-দোসর রাজাকার-আলবদর-জামায়াতে ইসলামী-হেফাজতে ইসলামসহ মৌলবাদী জঙ্গীগোষ্ঠী পুনরায় তৎপর হয়ে উঠছে বাঙালীর এই প্রাণের উৎসবে হিংস্র থাবা বসাতে। কয়েকদিন আগে হেফাজত প্রকাশ্য জনসভা করে মঙ্গল শোভাযাত্রা করা যাবে না বলে হুমকি দিয়েছে। এর আগে তারা ২০০১ সালে রমনা বটমূলে সেই ১৯৬৭ সাল থেকে আয়োজিত ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানেও ভয়াবহ বোমা হামলা চালিয়েছে। সে অবস্থায় বর্ষবরণ অনুষ্ঠান ও মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ঘিরে যখন নিরাপত্তার বিষয়টি অগ্রাধিকার পাচ্ছে তখন একের পর এক আসছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিষেধাজ্ঞা। সর্বশেষ পুলিশী বিবৃতিতে বলা হয়েছে, পহেলা বৈশাখে মোটরসাইকেলে একজনের বেশি চড়া যাবে না। হাতে কিংবা কাঁধে কোন ব্যাগ বহন করা যাবে না। মঙ্গল শোভাযাত্রায় মুখোশ পরে অংশগ্রহণ করা যাবে না। সর্বোপরি বিকেল পাঁচটার পর থেকে খোলা স্থানে কোন ধরনের অনুষ্ঠান করা যাবে না। প্রশ্ন হলো, এতসব নিষেধাজ্ঞার ভিড়ে তাহলে আর থাকল কী? পুলিশ বলছে, কোন ধরনের হামলার আশঙ্কা না থাকলেও নিরাপত্তার স্বার্থেই এই নিষেধাজ্ঞা। মূলত জামায়াত-হেফাজতসহ মৌলবাদী অপশক্তি তো এটাই চাইছে। মঙ্গল শোভাযাত্রা, বর্ষবরণ অনুষ্ঠান না করে বাঙালী ঘরে বসে থাক! পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠীও তা-ই চেয়েছিল। তবে শেষ রক্ষা হয়নি। জামায়াত-হেফাজতের হুমকিতেও কাজ হবে না। আপামর বাঙালী তার প্রাণের উৎসব বর্ষবরণ ও মঙ্গল শোভাযাত্রায় স্বতঃস্ফূর্ত আবেগ-উৎসাহ-আনন্দ নিয়ে অংশগ্রহণ করবেই করবে। অফুরন্ত আলোকের ঝর্ণাধারায় সে ধুয়ে ফেলবে মনের আবর্জনা, পঙ্কিলতা, সাম্প্রদায়িকতার বিষবাষ্প। শিক্ষার আলো দিয়ে আলো জ্বেলে দেবে সবার প্রাণে। পুলিশের কাজ আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করা। পুলিশ বরং সেটাই করুক মনপ্রাণ দিয়ে। সর্বস্তরের মানুষ তাতে সহযোগিতা করবে নিশ্চয়ই। মনে রাখতে হবে যে, ইউনেস্কো বাঙালীর এই মঙ্গল শোভাযাত্রাকে ইতোমধ্যেই বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
×