ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

নাসরীন মুস্তাফা

জন লাই ও শুভ নববর্ষ

প্রকাশিত: ০৫:৫১, ৮ এপ্রিল ২০১৭

জন লাই ও শুভ নববর্ষ

রানু মিস্ একবার মাত্র চেঁচিয়ে উঠলেন, জন লাই! তারপর পড়ে গেলেন। পেছনে ভাগ্যিস টেবিল ছিল। নইলে দেয়ালে ধাক্কা খেতেন, মাটিতেও পড়ে যেতেন হয়ত বা। খুব অবাক হয়ে তাকালেন। তখন সবাই দেখল, রানু মিস্-এর বাম চোখের চারপাশে কালো দাগ। জন লাই হাঁফাচ্ছিল। ওর হাতের মুঠি তখনও পাকিয়ে ধরা। ব্যাপারটা কি ঘটে গেল, তা বুঝতে খানিকটা সময় লাগল। এরপর সবাই বুঝে গেল, জন লাই রানু মিস-এর বাম চোখের উপর ঘুষি মেরেছে। ক্লাসের সবাইকে নিয়ে খুব মজার কাজ করছিলেন রানু মিস্। সামনে বাংলা নতুন বছর আসছে। রানু মিস্ বলছিলেন, পয়লা বৈশাখ বাংলা নতুন বছরের প্রথম দিন। ঐ দিন স্কুলে অনুষ্ঠান হবে। ওরা ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটি গাইতে শিখছিল দুলে দুলে। জন দুলছিল, গাইছিল না। একটু পর ওর দুই পাশে দুলতে থাকা লারা আর হাফিজকে ঠেলে ফেলে দিয়েছে। সবাই মিলে নানান রঙের মুখোশ বানাচ্ছিল। কেউ পেঁচা। কেউ বাঘ। কেউ হরিণ। ওরা মুখোশ দিয়ে সাজাবে চারদিক, নিজেদের মুখেও পরবে। একটা বিরাট বড় ঘুড়ি বানানো হচ্ছিল। ঘুড়িটা একদম মাছের মতো। এই মাছের আবার লেজটাও ইয়া বড়। লেজটা কী রকম পতপত করে উড়বে, ভাবতেই ভালো লাগছিল। জন লাই কেন যে মাছটার লেজ ধরে টান দিল! ও ছিড়ে নিতে চায় লেজটা। ক্লাসে কখনোই কথা বলে না জন। মাথা নেড়ে হ্যাঁ আর না বোঝায়। কখন ও কথা বলবে, তা ওর নিজের ব্যাপার। এই যেমন, রানু মিস্ যখন ওকে ‘স্টপ’ বলছিলেন মানে থামতে বলছিলেন, তখন জন চেঁচিয়ে বলেছিল, নো! তারপর রানু মিস্ ‘জন লাই’ বলে ডাকলেন, তখন আর কথা বলেনি জন। ঘুষি মেরেছে। সবাই ছুটে গেল রানু মিস্-এর কাছে। তিতি গিয়েছিল জনের সামনে। জনের চোখে অনেক রাগ। তিতির কোন কথারই কোন জবাব দিল না। তিতি মন খারাপ করে বাড়ি ফিরেছিল। কেন যে জনটা এরকম! নিজের মতো থাকে। কোন প্রশ্নের জবাব দেবে না। লিখতে মন চাইলে লিখবে। তিতি ছোট বেলার মতো এখনও ছোট চাচাকে বলে ‘চা’। ছোট চাচা ইফতি বড় বিজ্ঞানী। জন লাইকে নিয়ে তিতির ভাবনা বুঝতে পারে খুব। তিতি বলে, জন লাইয়ের বাবা-মা এসেছিলেন স্কুলে। জনের বাবা ফিন লাই থাইল্যান্ডের মানুষ, বাংলা বলতে পারেন না। তিনি কেবলি মাথাটা নিচু করে ছিলেন। আর ওর মা, শুভ্রা আন্টি রানু মিস্-এর হাত ধরে কেবলি বলছিলেন, ‘স্যরি স্যরি’। রানু মিস্ খুব রাগ করবেন, ভেবেছিল সবাই। তিনি তা করেননি। মন খারাপ করে বললেন, জন কেন যে মজাটা টের পেল না! সবাই আনন্দ করছে ও করতে পারছে না। হয়ত ও-ও করতে চাইছে, মানে মনের ভেতরে চাইছে। কিন্তু, ওর চাওয়াটা আমাদের বোঝাতে পারছে না। তাই রেগে উঠছে। শুভ্রা আন্টি রানু মিস্কে সান্ত¡না দেন। বলেন, ও যে বিশেষ শিশু! ওর সব কিছু বিশেষ। ওর ভাবনাগুলোও বিশেষ। তিতি বাড়ি ফিরে বলে, চা! যে করেই হোক্, জন লাইয়ের মনের ভেতরে ঢুকতে চাই আমি। ইফতি হা করে তাকিয়ে ছিল তিতির মুখের দিকে। ও ছটফট করে বলছিল, জন সবকিছু পারে না। আমাদের কথা বুঝতে পারে না। আমিও তো সব কিছু পারি না। আমিও তো জনের কথা বুঝতে পারি না। সে তো ঠিকই! জন কেন রেগে গেল, তা তোরা কেউই বুঝতে পারিসনি। ইফতির কথায় সায় দিয়ে বলে তিতিটা, চা! কিছু একটা করো। আমি যা বলব, তা জন যেন পুরোপুরি বুঝতে পারে। জন যা বলবে, আমিও যেন তা পুরোটাই বুঝি। তিতির যে কোন সমস্যার সমাধান করতেই হয় চাকে। নইলে তিতির চেয়েও কষ্ট বেশি পায় চা। দিন কয়েক খাটাখাটুনির পর ইফতি এসে বসল তিতির সামনে। তিতির দুই হাতে হাতমোজার মতো কিছু একটা পরিয়ে দিল। নিজের দুই হাত বাড়িয়ে দিয়ে বলল, র্ধ। তিতি দুই হাত দিয়ে ইফতির দুই হাত ধরতেই চমকে যায় খুব। হাতমোজার কী যে জাদু! কোন কথা না বলেই তিতি টের পাচ্ছিল, চা ওকে কি কি বলছে। চা তিতিকে বলছিল, জন লাইয়ের দুই হাত ধরতে হবে। তখন নাকি তিতি জনের সব কথা বুঝবে। জনও নাকি তিতির সব কথা বুঝবে। জনের দুই হাতের নাগাল পাওয়া কী মুখের কথা! অনেক ঘাম ঝরানোর পর তিতি ধরতে পেরেছিল জনের হাত। আর তক্ষুণি জনের চোখে অন্য রকমের আলো জ্বলে উঠেছিল। জন শান্ত হয়ে তিতির সামনে বসে। তিতিও বসে জনের সামনে। হাতমোজা জনের হাতের ¯œায়ুগুলোর সাথে তিতির হাতের ¯œায়ুর সংযোগ ঘটিয়ে দেয়। হাতমোজা জনের ¯œায়ুকে বলে, তিতির ¯œায়ুগুলো যা বলে, ঠিক তা-ই নিয়ে যাও মস্তিষ্কে। তিতির ¯œায়ুর কথাগুলো পৌঁছে যায় জনের ¯œায়ুতে। আবার জনের ¯œায়ু যা বলে, তা চলে যায় তিতির মস্তিষ্কে। তখন কি হয়? কত কিছু যে হয়! তিতি আর জন খুব খুব বন্ধু হয়ে যায়। তিতি অবাক হয়ে দেখতে পায়, জনের মনের ভেতরে একটা বাগান আছে। সেই বাগানে অনেকগুলো প্রজাপতি, একটা সাদা খরগোশ আর ইয়া বড় একখানা লাল মাকড়শা বাস করে। তিতি সেই প্রজাপতিগুলোর সাথে ছোটাছুটি করেছে। সাদা খরগোশটা কথা বলতে পারে বলে তিতি তার সাথে গপ্প করেছে অনেক। এমনিতে মাকড়শা দেখলে খুব ভয় পায় তিতি। সেই লাল মাকড়শাকে ভয় লাগেনি, অনেক খেলেছে ওর সাথে। তিতি আর জনকে ঘিরে থাকা বাকি বন্ধুরা কিচ্ছু বুঝতে পারছিল না। তখন হাতমোজাটার সাহায্য নিতেই হয়। ওরা সবাই মিলে জনের মনের বাগানটায় ঘুরে আসে। জনের সাথে কথা বলে। ওরা সবাই জনের বন্ধু হয়ে যায়। সত্যিকারের বন্ধু। রানু মিস্ও এলেন। জনের দুই হাত ধরলেন। ওরা সবাই দেখল, জন আর রানু মিস্-এর মুখে কেবলি হাসি। আসলে জন তখন রানু মিসকে বলছিল, স্যরি! আর রানু মিস্ বলছিলেন, জন! শুভ নববর্ষ! জনও শিখে গেল কথাটা। জনও বলল, শুভ নববর্ষ! শুধু এই না! পয়লা বৈশাখের অনুষ্ঠানে ‘এসো হে বৈশাখ’ গানটিও গেয়েছিল জন। সবার সাথে দুলে দুলে গেয়েছে। রানু মিস্ আর ওর বন্ধুরা ওকে যে শিখিয়ে দিয়েছিল গানটা! অলঙ্করণ : আইয়ুব আল আমিন
×