ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

মেলা মানেই বাঙালিয়ানা

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৮ এপ্রিল ২০১৭

মেলা মানেই বাঙালিয়ানা

বৈশাখী মেলা বাঙালিয়ানার হাজার বছরের লালিত ইতিহাস। আবহমান বাংলা ও বাঙালী সংস্কৃতির ঐতিহ্য। লোকসংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাঙালী মনের আনন্দ-খুশিকে প্রাণবন্ত করতেই মেলা বসে শহর থেকে গ্রামাঞ্চলে। মেলা বলতে আনন্দ-উল্লাস আর আবেগঘন মনের খোরাক এবং প্রাণের মেলা হিসেবে পরিগণিত হয়ে আসছে দীর্ঘদিন ধরে। মাদারীপুর অঞ্চলে বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রেক্ষাপটে মেলার আয়োজন করা হয়। বাংলা নববর্ষের প্রথম সকালে মঙ্গল শোভাযাত্রার মধ্য দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিকতা। ঘটা করে পান্তা-ইলিশ, বিচিত্র পোশাকের বৈচিত্র্যতা, সারাদিনের হৈ-হুল্লোড়, বাড়ি বাড়ি রকমারি খাবার, আলোচনা সভা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান মনে করিয়ে দেয় বাঙালীর বাঙালিপনা। মাদারীপুর অঞ্চলে শুধু বৈশাখী মেলাই যে বৈচিত্র্য বহন করে এমন নয়। বৈশাখী মেলার পাশাপাশি খাঁটি বাংলা ও বাঙালীর পরিচয় বহন করে মধুমাসের মেলা, ঈদের মেলা, কুম্ভমেলা (জেলার সর্ববৃহৎ গণেশ পাগলের মেলা), চড়ক পূজার মেলা, বাজিতপুরের মেলা, বসন্তবরণ মেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, নীল পূজার মেলা, জন্মাষ্টমীর মেলা, দুর্গাপূজার মেলা, কু-ুবাড়ি কালিপূজার মেলা (জেলার দ্বিতীয় বৃহত্তর মেলা), পৌষমেলা, মাঘী পূর্ণিমার মেলা, স্বাধীনতা দিবসের মেলা, বিজয় দিবসের মেলা, একুশের মেলা, রথযাত্রার মেলা ইত্যাদি। বারো মাস কোন না কোন দিবস বা উৎসব উপলক্ষে কোথাও না কোথাও মেলা বসে। বহুকাল আগে বটগাছ তলা, নিমগাছ তলায় মেলা বসত। এখন আর বটগাছ তলা, নিমগাছ তলার মেলা চোখে পড়ে না। বাংলা নববর্ষে মাদারীপুর স্বাধীনতা অঙ্গনসহ শহর অঞ্চলে জমজমাট বৈশাখী মেলা বসে। এ মেলায় আনন্দ-বিনোদনের কোন কমতি থাকে না ঠিকই, কিন্তু ঐতিহ্যগত আবেদন খুঁজে পাওয়া যায় না। গ্রামগঞ্জে অনুষ্ঠিত মেলায় প্রাণের আবেদন ও বাঙালিপনার ছোঁয়া পাওয়া যায়। এসব মেলার কোন কমিটি থাকে না। শুধু আনন্দ-উল্লাস উপভোগ করার জন্য মেলা বসে। খোলা জায়গায় একশ্রেণীর শৌখিন দোকানি পসরা সাজিয়ে বসে। বাঁশ-খুঁটি পুঁতে তাঁবু বা পলিথিন টাঙিয়ে মাটির পুতুল, পাতার বাঁশি, রং-বেরঙের খেলনা সাজিয়ে ছোট্ট ছোট্ট ছেলেমেয়েকে আকৃষ্ট করে। বাঁশি আর ঝুনঝুনি বাজিয়ে মানুষকে মেলায় আসার আহ্বান জানায়। এভাবেই ভিড় বাড়তে থাকে এবং শুরু হয় লোকসমাগম। মানুষের কলরবে এবং নানা ধরনের বাঁশি, ভেঁপু আর ঝুনঝুনির শব্দে মুখরিত হয়ে ওঠে মেলা প্রাঙ্গণ। মেলায় ঘুরতে আসা সব শ্রেণীর মানুষ নানা পণ্য কেনাকাটা করে। সব ধর্ম-বর্ণের মানুষের সমাগম ঘটে গ্রামীণ মেলায়। এখানে খুঁজে পাওয়া যায় খাঁটি বাঙালী প্রাণের স্পন্দন। অঞ্চলভেদে মেলাকে নানা নামে অভিহিত করা হয়। কোথাও গলইয়্যা, কোথাও আড়ং, কোথাও বান্নি নামে ডাকা হয়। যে নামেই ডাকা হোক না কেন মেলা বাঙালীর সার্বজনীন উৎসব। বিশেষ করে বৈশাখী মেলা ধর্ম-বর্ণ-নির্বিশেষে বাঙালীর প্রাণের উৎসব। যা ভ্রাতৃত্বের সেতুবন্ধন তৈরি করে বাঙালীকে অসাম্প্রদায়িক চেতনার জাতি হিসেবে গড়ে তুলতে সহায়তা করে। অনেকে মেলাকে ধর্মীয় প্রেক্ষাপটে বিচার করতে চায়। কেউ কেউ মেলাকে ‘হিন্দুয়ানি’ আচার-অনুষ্ঠান বলে থাকে। কিন্তু এ কথার কোন বৈজ্ঞানিক ভিত্তি নেই। মেলা, গলইয়্যা, আড়ং ও বান্নি সবই বাঙালিয়ানার পরিচয় বহন করে। মেলার আবেদন আবহমানকালের এবং তা বাংলার লোকজ সংস্কৃতির ঐতিহ্য ধারণ করে আসছে যুগ যুগ ধরে। মাদারীপুরে মেলা বসে নতুন শহর স্বাধীনতা অঙ্গনে হরেক রকম পসরার দোকান সাজিয়ে। অন্যান্য উপজেলার গ্রামে-গঞ্জে, হাটে-বাজারে, খোলা জায়গায়, নদীর পারে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মাঠে মেলা বসে। অসাম্প্রদায়িক চিন্তা-চেতনায় অনুষ্ঠিত মেলায় ধর্ম-বর্ণের কোন ভেদাভেদ থাকে না। সকল ধর্ম ও বর্ণের মানুষ মেলায় অংশগ্রহণ করে। মাদারীপুর অঞ্চলের মেলা সাধারণত এক থেকে সাত দিনের জন্য বসে। তবে কোন কোন মেলা তিন দিনের বেশি থাকে না। দোকানিদের ওপর নির্ভর করে মেলার সময়সীমা বাড়ানো-কমানো। সবকিছু ছাপিয়ে জেলায় সর্ববৃহৎ দু’টি মেলা অনুষ্ঠিত হয় রাজৈর ও কালকিনিতে। প্রতিবছর বাংলা মাসের ১৬ জ্যৈষ্ঠ রাজৈর উপজেলার কদমবাড়ি শ্রীশ্রী গণেশ পাগলের আশ্রমের ৩২ একরের বিশাল আঙিনায় অনুষ্ঠিত হয় কুম্ভমেলা। কোন কোন বছর মেলার স্থান সঙ্কুুলান না হওয়ায় আশপাশের সড়ক ও ফসলের মাঠে বিস্তৃতি ঘটে। একে এক রাতের মেলা বলা হয়। একটা সময় ছিল যখন বিকেলে মেলা বসে সারা রাত চলত। রাত পোহানের সঙ্গে সঙ্গে তা ভেঙ্গে যেত। দ্বিতীয় বৃহৎ মেলা অনুষ্ঠিত হয় কালকিনি উপজেলার গোপালপুরে। প্রতিবছর কু-ুবাড়ির দিপান্বিতা কালী পূজায় দিপাবলী উপলক্ষে এ মেলা বসে। কু-ুবাড়ির মেলা নামে খ্যাত এ মেলা হয় সাত দিনব্যাপী। Ñসুবল বিশ্বাস, মাদারীপুর থেকে
×