ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন

প্রকাশিত: ০৫:৫০, ৮ এপ্রিল ২০১৭

অসাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির মেলবন্ধন

উপলক্ষ যাই থাক না কেন, বাঙালীর সব উৎসবের মধ্যে সার্বজনীন রূপ আছে। এতে ধর্ম, সম্প্রদায়, জাত-পাত বা ধনী-গরিবের সামাজিক বিভক্তি বাধা হয়ে দাঁড়ায় না। আর এ কারণেই কালের বিবর্তনের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকতার ধরণ পাল্টালেও আবহমান বাংলার সামাজিক উৎসব, পার্বণ বা গণমানুষের মেলবন্ধনের ঐতিহ্য-কৃষ্টি আজও হারিয়ে যায়নি। ‘মেলা’ তেমনি একটি প্রাচীন ঐতিহ্য। মানুষের উচ্ছ্বাস-উল্লাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটে মেলার মধ্য দিয়ে। এটি মানুষের মধ্যে সম্প্রীতির বন্ধন গড়ে তোলে। গ্রাম-বাংলার মেলা তাই হাজার বছরের ঐতিহ্যের মহা সম্মিলন। ধারণা করা হয়, গ্রামীণ হাট থেকেই মেলার উদ্ভব। আগেকার দিনে রাজা-জমিদাররা মেলার আয়োজন বা পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। বারো মাসের তেরো পার্বণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে মেলার ঐতিহ্য। যেমন: বৈশাখের বৈজু মেলা, রাজপুণ্যাহ, রথমেলা, অষ্টমী মেলা, বারুনীমেলা, গাজন মেলা, চড়ক পূজোর মেলা, শিবচতুর্দশীর মেলা, চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, পৌষমেলা, মাঘী পূর্ণিমার মেলা, মহরমের মেলা, মনসার মেলা, চিলাইর মেলা, ঝুলনযাত্রার মেলা, কার্তিক ব্রতের সং মেলা, বুড়াবুড়ির মেলা। এক সময় পীর-ফকির বা সাধু-সন্ন্যাসীদের আস্তানাগুলোও মেলার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়। ধর্মীয় চেতনার বাইরের অন্যান্য সামাজিক বা লৌকিক আচারগুলোও যুক্ত হতে থাকে মেলার সঙ্গে। বাংলাদেশে এমন কোন জেলা বা উপজেলা নেই- যেখানে মেলার আয়োজন হয় না। বলা যায়, বাংলাদেশ মানেই ‘মেলার দেশ’। তেমনি নেত্রকোনার গ্রামগঞ্জেও প্রতি বছর বেশ ক’টি মেলার আয়োজন হয়। এখানকার উল্লেখ্যযোগ্য মেলা হচ্ছেÑ কলমাকান্দার চন্ডীগড় মেলা, খারনৈয়ের চেংনি মেলা, মোহনগঞ্জের বড়ান্তরের অষ্টমী মেলা, মদনপুরের শাহসুলতান কমরুদিন রুমীর (র:) মাজারের উরস মেলা, নেত্রকোনা ও বারহাট্টা সদরের বারুনী মেলা, হাতকুন্ডলির মেলা প্রভৃতি। এসব মেলাকে সামনে রেখে চারু, কারু, দারু ও অন্যান্য কুটির শিল্পী দীর্ঘ সময়ব্যাপী প্রস্তুতি সম্পন্ন করে। কামার, কুমার, ও বাঁশবেতের শিল্পীরা নিপুণ হাতে তৈরি করে আনে নানা জিনিসপত্র। শিশু থেকে বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষের আকর্ষণ থাকে মেলায়। তাই মেলার দর্শকদের প্রস্তুতিও কম থাকে না। অভাব-অনটন যাই থাকুক, মেলার জন্য সকলেরই ছোটখাটো বাজেট থাকে। মেলার আগে বড়রা শিশুদের নগদ টাকা বকশিশ দেয়। দূর-দূরান্তের আত্মীয়স্বজনরাও মানি অর্ডারে বা লোক মারফত পাঠিয়ে দেয় টাকা। নেত্রকোনা অঞ্চলে এ ধরণের উপহারকে বলা হয় ‘মেলার পরবী’। বাহারী পণ্যের পসরা বসে মেলায়। শিশুদের আনন্দ-বিনোদনের জন্য মেলায় পাওয়া যায় মাটির পুতুল, পালকি, ঘোড়া, ষাঁড়, হরিণ, ঘুড়ি, টমটম, লাটিম, গাড়ি, বল, বেলুন, বাঁশিসহ নানান রকমের খেলনা। গায়ের কূলবধূ ও কিশোরীরা মেলা থেকে কিনে আনে আলতা, স্নো, পাউডার, কাঁচের চুড়ি, নাকের নোলক, কানের দুল, চুলের ফিতা, খোপা, ক্লিপসহ দেহাবরণের জিনিসপত্র। হিন্দু রমণীরা মেলা থেকে ফিরে একজন আরেকজনকে সাবান-সিঁদুর উপহার দিয়ে শুভকামনা জানায়। এছাড়া গেরস্থালির জিনিসপত্র যেমন: দা, কাঁচি, কুড়াল, খুন্তি, রান্না-বান্নার সরঞ্জাম, পাখা, ঢাকি, চালনি, ছিপি, জলচৌকি, পিঁিড় থেকে শুরু করে বৃদ্ধদের ছড়িও পর্যন্ত পাওয়া যায় মেলায়। থাকে রসনা তৃপ্তির জিনিসপত্রও। বিশেষ করে মেলায় কেনা জিলিপি, গজা, লবঙ্গ, রসগোল্লা, কদমা, তিলুয়া-বাতাসা, ওখরা, বিন্নি ধানের খৈ ও দই-চিরার স্বাদই আলাদা। কাপড়, মনোহারি, প্লাস্টিক পণ্য, পূজার জিনিসপত্র, ধর্মীয় পোস্টার, ছবি, বাঁশবেতের সামগ্রী, তামা-কাঁসা-পিতলের বাসনপত্র প্রভৃতির দোকানও বসে। Ñসঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে
×