ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

বাংলাদেশে এর মধ্যেই পাওয়া যায় উৎসবের সুবাস

হাজার মেলার দেশ

প্রকাশিত: ০৫:৪৯, ৮ এপ্রিল ২০১৭

হাজার মেলার দেশ

মেলা নামের মধ্যেই খুঁজে পাওয়া যায় উৎসবের সুবাস। বাঙালীর জীবনে লৌকিক ও লোকজ ধারায় মাটির গন্ধের আবহ ফুটে তোলে মেলা। বাংলা ভাষায় মেলা শব্দটি অনেক বাক্যের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে। যেমন মিলনমেলা। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর কাব্যে সঙ্গীতে গল্প কবিতা উপন্যাসে মেলা শব্দটি ব্যবহার করেছেন নানা ব্যঞ্জনায়। ‘ভাঙল মিলন মেলা ভাঙল...’ রবীন্দ্রনাথের এই গানের কথাতেই মেলার সঙ্গে সকল মানুষের মেলবন্ধনের বিষয়টি মালার মতো গেঁথে আছে। মেলা এই মিলনকেই গেঁথে রেখেছে বহুকাল ধরে। মেলাকে ঘিরেই মানুষের জীবনপ্রবাহ আবর্তিত। বঙ্গীয় বদ্বীপে মেলার উৎপত্তি কবে-কীভাবে এসেছে তা নিয়ে আজও গবেষণা হয়। যুগে যুগে মেলার অনেক রকমফের ঘটেছে। তবে বাঙালীর জীবনে লোকজ সংস্কৃতির গভীরে গ্রামীণ মেলার আবহ আজও টিকে আছে। লোকজ সংস্কৃতির অন্যতম অনুষঙ্গ মেলা। মেলার সঙ্গে নদীর আত্মিক সম্পর্ক লক্ষ্য করা যায়। অধিকাংশ মেলা বসে নদী তীরে কোন পাথারে। কোন বট-পাকুড়ের তলায়। বাংলাদেশে বৈশাখ থেকে মেলা শুরু হয়ে বছর শেষে চৈত্র সংক্রান্তিতে গিয়ে শেষ হয়। চৈত্রের এই আবহ বৈশাখে গিয়ে ঠেকে। এই দেশে কত মেলা তার সঠিক হিসাব নেই। বলা হয়, অন্তত আড়াই শ’ মেলার সঙ্গে শাখা-প্রশাখা জুড়ে তা হাজারের বেশিতে গিয়ে ঠেকে। ষড়ঋতুর এই দেশে বাংলা মাসের নামে ও ঋতুর নামে মেলা জীবনঘনিষ্ঠ। যেমন চৈত্র সংক্রান্তির মেলা, বৈশাখী মেলা, পৌষ মেলা, বসন্ত মেলা, আষাঢ় মেলা, অগ্রহায়ণে নবান্ন মেলা। গ্রামীণ মেলা হৃদয়ের গভীরে পৌঁছে ধরা দেয়। নগরীর মেলা অনেকটা কৃত্রিম। ষাটের দশকে দেশের শহরগুলোতে কৃষি, শিল্প, শিক্ষা, স্বাস্থ্য প্রদর্শনী হতো। ইংরেজীতে পরিচিতি ছিল ‘এক্সিবিশন’। গ্রামের লোক এই মেলার নাম দেয় ‘শখের মেলা’। স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর সত্তর দশকের মধ্যভাগ পর্যন্ত শহরগুলোতে এ ধরনের মেলা ছিল। পরবর্তীতে এই ধরনের প্রদর্শনী পরিবর্তিত রূপ নেয় নানা নামে। মেলা এক ধরনের আনন্দ-বিনোদনের সঙ্গে বাণিজ্য। বর্তমানে বাণিজ্যের লক্ষ্য নিয়ে মেলার নামকরণ হয়। বাণিজ্য মেলা, রফতানি মেলা, তাঁত মেলা, বস্ত্র মেলাসহ বিভিন্ন পণ্যের, ব্র্যান্ডের ও প্রতিষ্ঠানের নামে মেলা শব্দটি চালু হয়েছে। যে ধারা নগরীর মেলা ও গ্রামীণ মেলাকে পৃথক করে দেয়ার সঙ্গে মেলার উৎসব ও মিলন বন্ধনের আমেজকে কিছুটা হলেও খাটো করেছে। লোকজ ধারার বাঙালী সংস্কৃতির মেলবন্ধনের মেলায় আছে প্রাণের ছোঁয়া। আবেগ-অনুভূতিতে হৃদয়ের স্পন্দন এনে দেয়। স্বজনদের আগমন, আত্মীয়তার বিকাশ ঘটে মেলাকে ঘিরে। যে চিত্র আদি ভূখ- এই বঙ্গীয় বদ্বীপে লক্ষ্য করা যায়, তা বহুভাবে প-িতগণ তুলে ধরেছেন। প্রাচীন পুঁথি থেকে জানা যায়, ভাটি অঞ্চলে মেলার গোড়াপত্তন বহুকাল আগে। লোকজ কয়েকটি কাব্যে জানা যায়, ময়মনসিংহের ভাটি এলাকা ও বগুড়ার শিবগঞ্জের গাঙনগরে একটা সময় বড় মেলার আয়োজন হতো। প্রাচীন পু-্রবর্ধনভুক্তির রাজধানী পু-্রনগর মহাস্থানগড়ে প্রমত্তা করতোয়া নদী হয়ে যে সওদাগরি বড় নৌকা ভিড়ত, তার সংযোগ ছিল বানারসী বিলে। করতোয়ার এই তীরে প্রতিবছর মেলার আয়োজন করা হতো নানা উপলক্ষ ঘিরে। পৌরাণিক উপাখ্যান থেকে জানা যায়, চাঁদ সওদাগর বেহুলা লখিন্দরের বিয়ের অনুষ্ঠান সাজিয়েছিলেন মেলা বসিয়ে। চাঁদমহুয়া গ্রামে বসেছিল সেই মেলা। এই গ্রামের নাম অপভ্রংশ হয়ে উচ্চারিত হয় চাঁদমুহা। বগুড়া অঞ্চলে যে কয়টি মেলা হয় তার প্রত্যেকটির সঙ্গে একটি করে গল্প রচিত হয়ে আছে বহুকাল ধরে। গাজী পীর আর কালু পীরের কাহিনী নিয়ে বগুড়ার শেরপুরের কেল্লা ও পোশি নামের দুই গ্রামের মধ্যবর্তী বিশাল পাথারে প্রতি বছর জ্যৈষ্ঠ মাসে বসে কেল্লাপোশির মেলা। এই মেলার সঙ্গে যোগ হয়ে আছে গাজী কালু চম্পাবতীর প্রণয় কাহিনী। বগুড়ার ঐতিহ্যের এক মেলা পোড়াদহের মেলা। গাবতলীর মহিষাবান গারিদহ নদীর তীরে ছিল এক জোড়া বটবৃক্ষ। সন্ন্যাসী এসে এই বৃক্ষতলে যোগাসনে বসে ধ্যান করতেন। এক পর্যায়ে শুরু হয় মেলা। প্রতিবছর মাঘের শেষ মঙ্গলবার পোড়াদহের মেলা বসে। গোপীনাথপুরের মেলার সঙ্গে জড়িয়ে আছে মুনি ঋষীদের গল্প। মহাস্থানগড়ে বাউলদের মেলা বসে চৈত্র শেষে। উল্লেখ আছে, ইংরেজদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে ফকির মজনু শাহ এই অঞ্চলে কিছুদিন ছিলেন। ফকিররা এক যুদ্ধে ইংরেজদের পরাভূত করার পর মেলার গোড়াপত্তন করেন। এমনিভাবে বারুণীর মেলা, দাঁড়িয়ালের মেলা, খারুয়ার মেলাসহ ৪০টিরও বেশি মেলার গর্ব নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে বগুড়া। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পুণ্য ¯œানকে কেন্দ্র করে মেলা বসে বিভিন্ন স্থানে। গ্রামীণ মেলাকে ঘিরে যাত্রা-সার্কাস-লোকজ সংস্কৃতির নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন হয়। বৈশাখ মাস আসে মেলাকে সঙ্গে নিয়ে। মেলা বাংলার চিরন্তন লোকজ রূপ। বগুড়া শহরের এডওয়ার্ড পার্কে গ্রামীণ মেলার আবহে গত ৩৬ বছর ধরে বৈশাখী মেলার আয়োজন করছে বগুড়া থিয়েটার। এই সময় মনে হয় শহরের মধ্যে ইতিহাসের পালায় মেলার একটি গ্রাম। Ñসমুদ্র হক, বগুড়া থেকে
×