ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

খাল রক্ষায় কোন ভূমিকা রাখতে পারছে না ঢাকা জেলা প্রশাসন

ভরাট হয়ে যাচ্ছে রামচন্দ্রপুর খাল

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৮ এপ্রিল ২০১৭

ভরাট হয়ে যাচ্ছে রামচন্দ্রপুর খাল

স্টাফ রিপোর্টার ॥ সবার চোখের সামনে ভরাট হয়ে যাচ্ছে রাজধানীর মোহাম্মদপুরের রামচন্দ্রপুর খাল। কখনও ট্রাকস্ট্যান্ড, কখনও গরুর খামার, কখনওবা থানা ভবন নির্মাণের নামে ভরাট করে ফেলা হয়েছে খালের বিশাল অংশ। চলছে কয়েকটি হাউজিং কোম্পানির দখলবাজি। দুদিক থেকেই ভরাট হয়ে যাওয়ায় খালটি পরিণত হয়েছে সরু নালায়। স্থানীয় বাসিন্দাদের আশঙ্কা, এ নালাও বেশিদিন টিকবে না। তাদের অভিযোগ, খাল রক্ষায় তেমন কোন ভূমিকাই রাখতে পারছে না ঢাকা জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্টরা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানিয়েছেন, ৩০ বছর আগেও মোহাম্মদপুর ও রায়েরবাজারের পানি নিষ্কাশনের প্রধান মাধ্যম ছিল রামচন্দ্রপুর ও কাটাসুরের দুই খাল। বসিলা এলাকায় খাল দুটি সংযুক্ত হয়ে পশ্চিম দিকে তুরাগ নদে গিয়ে মিশেছে। কিন্তু নব্বই দশকের গোড়ায় পুরান ঢাকার বাবুবাজার থেকে লালবাগ, হাজারীবাগ, গাবতলী ও ধউর হয়ে উত্তরার আবদুল্লাহপুর পর্যন্ত বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণ করায় রামচন্দ্রপুর খাল দু’ভাগ হয়ে যায়। বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধ নির্মাণের পর রামচন্দ্রপুর খালের একাংশ পড়েছে বাঁধের ভেতর মূল শহরের মোহাম্মদপুর-রায়েরবাজার এলাকায়। অন্য অংশ বাঁধের বাইরে বসিলাসংলগ্ন এলাকায় পড়েছে। শহরের ভেতর খালের প্রবাহ থেমে যাওয়ায় ঢাকা ওয়াসা সাইনবোর্ড টাঙিয়ে জানিয়ে দিয়েছে, ‘এখানে একদা খাল ছিল।’ এরপর ‘ভূমিদস্যু’দের আগ্রাসন শুরু হয় বন্যা নিয়ন্ত্রণ বাঁধের বাইরে প্রবহমান খালের ওপর। এ আগ্রাসনও এখন শেষ পর্যায়ে। গত শনিবার সরেজমিন দেখা গেছে, বসিলা থেকে গাবতলীমুখী সড়কের পাশে গড়ে উঠেছে একটি ট্রাকস্ট্যান্ড। এক বছর আগেও এ ট্রাকস্ট্যান্ডের পাশে ছিল রামচন্দ্রপুর খাল। এখন আর নেই। রাবিশ মাটি দিয়ে খালের প্রায় এক হাজার ফুট অংশ ভরাট করে ফেলা হয়েছে। এ সময় ট্রাকচালক কামাল বলেন, ‘আশপাশে কোথাও ট্রাক রাখার জায়গা নেই। আগে মোহাম্মদপুর আল-করীম মসজিদের সামনে ট্রাক রাখা হতো। সেখান থেকে বসিলায় পাঠানো হয়। বসিলায় কবরস্থান হওয়ায় ট্রাকস্ট্যান্ড পাঠানো হয়েছে এ জায়গায়। এ স্ট্যান্ডে প্রায় ২০০ ট্রাক থাকে।’ কারা তাদের এখানে পাঠিয়েছে জানতে চাইলে তার উত্তর দিতে পারেননি কামাল। ট্রাকস্ট্যান্ডের পশ্চিম দিকে খাল দখল করে পাকা ভবন নির্মাণ করছেন স্থানীয় এক ব্যক্তি। এখানে খালের জমিতে বস্তিও নির্মাণ হয়েছে বিনা বাধায়। ট্রাকস্ট্যান্ডের উত্তর পাশে রয়েছে জাকের ডেইরি ফার্ম। স্থানীয়দের অভিযোগ, এ ফার্মের মাধ্যমেই রামচন্দ্রপুর খালের দখল শুরু হয়। সামান্য জমির মালিক হয়ে ডেইরি ফার্ম মালিক দখল করেছেন খালের বিশাল অংশ। এ বিষয়ে ফার্ম মালিক আনোয়ার হোসেন বলেন, ‘খালের কিছু জমি আমার দখলে আছে। সরকার চাইলে দিয়ে দেব।’ ডেইরি ফার্মের দখলের পর উত্তর দিকে খালের কিছু অংশ অবশিষ্ট ছিল। এটাও দখল হয়ে গেছে। বর্তমানে এ অংশে নতুন থানা ভবনের নির্ধারিত স্থান লেখা সাইনবোর্ড টাঙানো আছে। এর পাশেই খাল ভরাট করে দোকানপাট নির্মাণ করেছেন এক প্রভাবশালী। রামচন্দ্রপুর খালের পশ্চিমাংশে বাগানবাড়ির পর একটি ত্রিমোহনী রয়েছে। খালের দুটি শাখা একত্রিত হয়ে সোজা পশ্চিমে চলে গেছে তুরাগ নদের দিকে। এ ত্রিমোহনী থেকে তুরাগ নদ পর্যন্ত খালের মরণদশা চলছে। নবীনগর হাউজিং ও দয়াল হাউজিং কোম্পানির মধ্যে যেন প্রতিযোগিতা চলছে খাল দখলের। রাবিশ মাটি ফেলে ১০০ ফুট প্রস্থের খালকে ইতোমধ্যে ২০ ফুট প্রস্থে নিয়ে আসা হয়েছে। এ দুটি কোম্পানি ছাড়াও খাল দখলে যোগ দিয়েছে চাঁদ হাউজিং, রাজধানী হাউজিং, বসিলা গার্ডেন সিটি ও চন্দ্রিমা হাউজিং। ঢাকার খালগুলো এভাবে দখল হয়ে যাওয়ায় ভীষণ চিন্তিত পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান। তিনি বলেন, ‘প্রাকৃতিক খালগুলো সংরক্ষণ করতে না পারলে ঢাকায় বিপর্যয় নেমে আসবে। এ কারণে আমরা বারবার বলছি খালগুলো রক্ষা করতে। এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীও আন্তরিক। কিন্তু কেন যেন দখলদারদের ঠেকানো যাচ্ছে না।’ তিনি আরও বলেন, ‘রামচন্দ্রপুর খাল আমিও দেখেছি। খুব খারাপ অবস্থায় আছে খালটি। এখনই এটাকে সংরক্ষণ করা না হলে এ খাল আর পাওয়া যাবে না।’ রামচন্দ্রপুল খাল দেখভালের দায়িত্বপ্রাপ্ত ঢাকা জেলা প্রশাসন কোন ভূমিকাই রাখতে পারছে না এ ব্যাপারে দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা এ নিয়ে কথা বলতে রাজি নন। জেলা প্রশাসনের সার্ভেয়ার শফিউল আলম অবশ্য কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, ‘রামচন্দ্রপুর খাল নিয়ে সর্বশেষ রিপোর্ট আমাদের কাছে নেই। শীঘ্রই সেখানে উচ্ছেদ অভিযান হবে কি-না সেটাও আমার জানা নেই।’ জানা গেছে, ২০১২ সালে ঢাকা জেলা প্রশাসন এবং পানি উন্নয়ন বোর্ডের উদ্যোগে রামচন্দ্রপুর ও কাটাসুর খালের দু’দিকে সীমানা পিলার স্থাপন করা হয়। কিন্তু দখলদাররা এ পিলার উপেক্ষা করেই দখলবাজি অব্যাহত রাখে। ফলে ২০১৩ সালে উচ্ছেদ অভিযান চালানো হয়। এরপরও অব্যাহত থাকে দখলবাজি।
×