ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিকত্ব ও নিরাপত্তা নিয়ে তীব্র প্রতিক্রিয়া

রোহিঙ্গা নির্যাতন প্রশ্নে সুচির বক্তব্য স্রেফ আইওয়াশ

প্রকাশিত: ০৫:৩০, ৮ এপ্রিল ২০১৭

রোহিঙ্গা নির্যাতন প্রশ্নে সুচির বক্তব্য স্রেফ আইওয়াশ

মোয়াজ্জেমুল হক/ এইচএম এরশাদ ॥ মিয়ানমারে সংখ্যালঘু মুসলিম অধ্যুষিত রাখাইন রাজ্যে জাতিগত দাঙ্গার বিষয়টি যখন প্রমাণিত সত্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে তখন সে দেশের এনএলডি নেত্রী আউং সান সু চি গত বৃহস্পতিবার যে বক্তব্য দিয়েছেন তা প্রকৃত সত্যকে আড়াল করতে স্রেফ আইওয়াশ বলে অভিহিত হয়েছে। উল্লেখ্য, বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাতকারে আউং সান সু চি বলেছেন, রাখাইন রাজ্যে সংখ্যালঘু মুসলিমদের নিয়ে জাতিগত নির্মূলের কোন ঘটনা ঘটেনি। যা ঘটেছে তার মতে, সেটি ব্যাপক সহিংসতা। এছাড়া তিনি আরও দাবি করেছেন, রাখাইন প্রদেশে মুসলিমরা মুসলিমদের মারছে। তার এ বক্তব্য বৃহস্পতিবার ইলেকট্রনিক মিডিয়াম এবং শুক্রবার দেশী বিদেশী বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়ামে প্রচারিত হওয়ার পর এর তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়েছে বাংলাদেশে বৈধ ও অবৈধভাবে শরণার্থী জীবনে থাকা রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর মাঝে। উল্লেখ্য, বছরের পর বছর ধরে জাতিগত দাঙ্গায় সংখ্যালঘু রোহিঙ্গা মুসলিমরা বর্বর নির্যাতনের শিকার। হত্যা, ধর্ষণ, ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে ভিটেমাটি ছাড়া করাসহ অমানবিক ঘটনার শিকার হয়ে রোহিঙ্গারা সে দেশ থেকে দলে দলে দেশান্তরি হয়েছে, যার অধিকাংশ এসেছে সীমান্তসংলগ্ন বাংলাদেশে। ১৯৬২ সালে তৎকালীন আরাকান প্রদেশের স্বায়ত্তশাসন রহিত হওয়ার পর থেকে জাতিগত দাঙ্গার সূত্রপাত ঘটে। তখন থেকে রোহিঙ্গাদের দেশান্তরি হওয়া শুরু। গত বছরের অক্টোবর মাসে সেখানকার একটি সীমান্ত চৌকিতে হামলা ও অস্ত্রশস্ত্র লুটপাটের ঘটনাকে নিয়ে রোহিঙ্গাদের ওপর যে বর্বরতা নেমে এসেছে তা নজিরবিহীন। ফলে বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এ ব্যাপারে বিশ্ব দরবারের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। এ প্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মানবাধিকার, দাতা সংস্থা এমনকি শেষ পর্যন্ত জাতিসংঘের পক্ষ থেকেও বিষয়টি সরেজমিনে তদন্ত করে বক্তব্য দেয়া হয়েছে। এসব বক্তব্যে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, রোহিঙ্গারা সে দেশে জাতিসংঘ দাঙ্গার শিকার। শুধু তাই নয়, বংশানুক্রমে বসবাস করে আসার পরও রোহিঙ্গাদের সে দেশের নাগরিকত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। উল্টো মিয়ানমার সরকার দাবি করে আসছে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়। তারা বাংলাদেশ থেকে সে দেশে অবৈধভাবে বসতি স্থাপন করেছে। এদিকে, আউং সান সু চির বৃহস্পতিবারের সর্বশেষ বক্তব্যে প্রকারান্তরে শিকার করে নেয়া হয়েছে রাখাইন প্রদেশে ব্যাপক সহিংসতা ঘটেছে। এ কারণে ঘরবাড়ি ফেলে যাওয়া রোহিঙ্গা সে দেশে ফিরে যেতে চাইলে স্বাগত জানানো হবে। একদিকে মিয়ানমার সরকার বলছে রোহিঙ্গারা সে দেশের নাগরিক নয়, অর্থাৎ বহিরাগত। পক্ষান্তরে আউং সান সু চি বলেন, রোহিঙ্গারা ফিরে গেলে স্বাগত জানাবেন। তার এ বক্তব্য নিয়ে বাংলাদেশে আশ্রিত রোিহঙ্গাদের মাঝে তীব্র ক্ষোভের সৃষ্টি হয়েছে। শুক্রবার উখিয়া ও টেকনাফে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের বিভিন্ন সূত্রে দাবি করা হয়েছে, সু চির এ বক্তব্য স্রেফ আইওয়াশ। রাখাইন প্রদেশ থেকে দলে দলে যারা দেশান্তরি হয়েছে তারা সংখ্যালঘু মুসলিম সম্প্রদায়ের। আর বর্বরতা চালিয়েছে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী মৌলবাদী গ্রুপের সদস্যরা। তাদের সহযোগিতা দিয়েছে সে দেশের সেনাবাহিনী, সীমান্তরক্ষী এমনকি পুলিশ বাহিনীও। বর্বরতার সচিত্র প্রতিবেদন প্রতিনিয়ত বিশ্ব মিডিয়ায় এসেছে। এ প্রেক্ষিতে যারা দেশান্তরি হয়েছে তারা সকলেই সংখ্যালগু রোহিঙ্গা। দেশান্তরিদের মাঝে কোন বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী সম্প্রদায়ের সদস্য নেই। সঙ্গত কারণে প্রশ্ন উঠেছে, রোমহর্ষক যেসব ঘটনা রাখাইন প্রদেশে ঘটেছে সেটা সুনির্দিষ্টভাবে ক্ষুদ্র একটি জাতিগোষ্ঠী এবং এরা সকলেই মুসলিম রোহিঙ্গা সম্প্রদায়ের। এছাড়া রোহিঙ্গারা সকলেই মুসলিম। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে কোন রোহিঙ্গা নেই। এ দেশে আশ্রিত রোহিঙ্গাদের প্রশ্ন, সে দেশের গণতান্ত্রিক নেত্রী আউং সান সু চি দীর্ঘদিন নীরবতা পালন করার পর বিশ্বের তীব্র চাপের মুখে এখন বলছেন জাতিগত নির্মূলের কোন ঘটনা ঘটেনি, তবে সহিংসতা হয়েছে। উল্লেখ্য, জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংঘি লি সরেজমিনে রোহিঙ্গা শরণার্থী শিবির পরিদর্শন শেষে জাতিসংঘে রিপোর্ট এবং জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক কার্যালয় থেকে প্রতিবেদন দাখিলের পর জাতিসংঘ এ ব্যাপারে এই বলে মুখ খুলেছে, রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গাদের ওপর যে নির্যাতন চলেছে তা সম্পূর্ণ মানবাধিকার লঙ্ঘনের শামিল। এ নিয়ে মিয়ানমার সরকার তীব্র সমালোচনার মুখে পড়ে। উল্লেখ্য, রোহিঙ্গারা মিয়ানমারের স্থায়ী নাগরিক। কিন্তু সে দেশের সরকার তা বারে বারে অস্বীকার করে আসছে। ১৯৭৮ সাল থেকে ব্যাপক নির্যাতনের শিকার হয়ে রোহিঙ্গাদের ব্যাপকহারে দেশত্যাগ শুরু হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা শরণার্থীদের তালিকাভুক্ত সংখ্যা ৩২ সহস্রাধিক। আর গত অক্টোবর থেকে নতুন করে এসেছে আরও লক্ষাধিক। আরও আগে গত কয়েক দশকজুড়ে এসেছে ৫ লক্ষাধিক। সবমিলে বাংলাদেশে রোহিঙ্গার সংখ্যা ১২ লক্ষাধিক বলে বেসরকারী পরিসংখ্যান রয়েছে। এরা ঠিকানা ও রাষ্ট্রবিহীন জাতিতে পরিণত হয়েছে। রাখাইন প্রদেশে দফায় দফায় রোহিঙ্গা নির্যাতনের ঘটনা নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে সারাবিশ্ব সোচ্চার হয়েছে। এরই প্রেক্ষিতে সে দেশের এনএলডি নেত্রী বৃহস্পতিবার বিবিসিকে যে বক্তব্য দিয়েছে তা সম্পূর্ণ অগ্রহণযোগ্য। তবে তার বক্তব্যে ব্যাপক সহিংসতার কথাটি স্বীকারে এসেছে। এখন রোহিঙ্গাদের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, তাদের সে দেশের নাগরিকত্ব এবং এর পাশাপাশি নিরাপত্তার বিষয়টি নিশ্চিত করা হলে তারা নিজ দেশে ফিরে যেতে আগ্রহী। এ ব্যাপারে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রতিরোধ ও প্রর্তাবাসন সংগ্রাম কমিটির সভাপতি অধ্যক্ষ হামিদুল হক চৌধুরী শুক্রবার সন্ধ্যায় জনকণ্ঠকে তার প্রতিক্রিয়ায় জানান, ২০০৫ সাল থেকে রোহিঙ্গা শরণার্থী প্রত্যাবাসন প্রক্রিয়া বন্ধ রেখেছে মিয়ানমার সরকার। যে কারণে গোটা কক্সবাজার অঞ্চল এবং বান্দরবানের সীমান্ত অঞ্চলগুলোতে রোহিঙ্গাদের অবৈধ বসতি কেবলই বাড়ছে। এছাড়া এসব রোহিঙ্গারা বিভিন্ন অপকর্মে এমনকি জঙ্গী সন্ত্রাসেও লিপ্ত হচ্ছে। যা দেশের জন্য বড় ধরনের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে।
×