ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

চারদিকে ব্যাপক নির্মাণযজ্ঞ

পদ্মা সেতুর ৪৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন, নদীশাসন কাজও গতি পেয়েছে

প্রকাশিত: ০৫:২৯, ৮ এপ্রিল ২০১৭

পদ্মা সেতুর ৪৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন, নদীশাসন কাজও গতি পেয়েছে

মীর নাসিরউদ্দিন উজ্জ্বল, মাওয়া থেকে ফিরে ॥ বিশাল পদ্মায় বন্ধন তৈরির কর্মযজ্ঞে বিশেষ এক ছন্দ তৈরি হয়েছে। সেতু বন্ধনের ছন্দটি যেন গোটা এলাকায় ছড়িয়ে পড়েছে। সবখানেই কাজ আর কাজ। মাওয়া থেকে জাজিরা পুরো পদ্মা এপার ওপার শুধু নয়, তীরে এবং আশপাশের সবখানেই নির্মাণযজ্ঞ। যেন চারিদিকে বিশেষ নির্মাণ মেলা। পদ্মার প্রবাহ, স্রোতধারা, ঢেউয়ের শব্দ, তারই মাঝে যান্ত্রিক নানা নৌ যানের শব্দের মাঝে নির্মাণ মেলার এই শব্দ এখানে বিশেষ শব্দ তৈরি হচ্ছে। আশপাশের লোকজনের কাছে এই শব্দ পরিচিত। রাত গভীর হলে এই শব্দ দূর জনপদেও ছড়িয়ে পড়ে আরও স্পষ্ট হয়েছে। ঢাক ঢাক শব্দের ছন্দে এই অঞ্চলের মানুষের ঘুম আসে। আর ঘুম ভাঙ্গে পাখির কিচির মিচির শব্দে। আর গত কয়েক দিনের টাপুর টুপুর বৃষ্টির শব্দেও থেমে যায়নি সেতু তৈরির শব্দ। রোদ-বৃষ্টি-বর্ষা উপেক্ষা করেই রাত দিন চলছে পদ্মার বন্ধনের এই কর্ম। পদ্মায় মূল সেতু তৈরির কাজে এখন বিশেষ ব্যস্ততা। নদী ও নদী তীরে তাই দুই শতাধিক ছোট-বড় ক্রেন আর ভারি ভারি যন্ত্রপাতির ব্যস্ততা। দু’পারে দুটি বিশাল হ্যামার অনবরত পাইল স্থাপন করছে নদীর তলদেশে। মাওয়া প্রান্তের ৫ নম্বর পিলারে ছয়টি পাইলই স্থাপনা হয়ে গেছে। আর ৩ নম্বর পিলারে বসেছে দুটি পাইল। ৪ নম্বর পিলারে পাইল স্থাপনের পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষর সময় এই পয়েন্টে পাইপ নদীর তল দেশে ছিল। সেটি উদ্ধার করা হয়েছে। এখন ৪ নম্বর পিলারেও পাইল স্থাপন শুরু হচ্ছে। জাজিরা প্রান্তের ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের মতো ৩৯, ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারও সম্পূর্ণ হতে যাচ্ছে। সব মিলিয়ে নদীতে পাইল বসেছে ৫২টি। আর তীরের ৪২ নম্বর পিলারের বসেছে আরও ৯টি পাইল। সবমিলিয়ে মূল সেতুর পাইল স্থাপন হয়েছে ৬১টি। আর জাজিরা প্রান্তের ভায়াডাক্টের পাইল বসেছে ৭৩টি। মূল সেতুর কাজ ইতোমধ্যেই প্রায় ৪১ শতাংশ সম্পন্ন হয়েছে। এই সময় টার্গেট ছিল প্রায় ৪৩ শতাংশ। নদী শাসনের কাজেও পেয়েছে নতুন গতি। নদী তীরে স্থান সংকুলান না হওয়ায় এক থেকে দুই কিলোমিটার দূরে তৈরি করা হচ্ছে নদী শাসনের জন্য কোটি কোটি ব্লক। কুমারভোগ, শিমুলিয়া, সাতঘড়িয়া ও জসলদিয়াসহ আশপাশে নদী শাসনের ব্লক তৈরি করে তা স্তূপ করে রাখা হচ্ছে। আর নদীতে ফেলা হচ্ছে বিশেষ বালুর বস্তা। নদীর তলদেশ সমতল করতে ড্রেজিংও চলছে। এসব কাজের পরই ফেলা হবে ব্লক। আর এই ব্লক দিয়ে নদীর তীরও বাঁধাই করা হবে। কীর্তিনাশা পদ্মাকে সেতু এলাকায় বশ মানাতে চীনা সিনো হাইড্রো কোম্পানি রাত দিন কাজ করছে। তবে নদী শাসনের কাজ পিছিয়ে আছে ৪ শতাংশ। এই সময়ে ৩৮ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হওয়ার টার্গেট থাকলেও এখন পর্যন্ত সম্পন্ন হয়েছে ৩৪ শতাংশ। এই কাজও এগিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। সব মিলিয়ে পদ্মা সেতুর গড়ে এ পর্যন্ত প্রায় ৪৩ শতাংশ কাজ সম্পন্ন হয়ে গেছে। পদ্মা সেতুর মূল কাজে বিশেষ বাধা সৃষ্টি হয়েছিল নদীর তলদেশের মাটির বৈচিত্রের কারণে। সেই চ্যালেঞ্জ জয় করার পর এখন বিশেষ গতি পেয়েছে সেতুটির কাজে। সেতুর পাইলের কংক্রিটিংয়ের কাজে নতুন মেশিন ব্যবহার করা হচ্ছে। দুটির স্থলে একই সঙ্গে ছয়টি পাইপে গ্রাউন্ড (সিমেন্ট দ্রবণ) পুশ করা হচ্ছে। এতে নদীর তলদেশের প্রায় ৪শ’ মিটার নিচে পাইলের ছিদ্র দিয়ে এই সিমেন্ট বের হয় পাইলের সঙ্গে বিশেষ শক্তি সঞ্চয়ের ভিত তৈরি করছে। বিশেষ জেলও ব্যবহার করা হচ্ছে। প্রথম দফায় প্রায় ৬০ শতাংশ থাকছে। তাই দ্বিতীয় দফায় আবার গ্রাউন্ড পুশ করা হচ্ছে। এতে টার্গেট ফিলাপ হচ্ছে। এর আগে দুটি পাইপে এই গ্রাউন্ড পুশ করে পরে কিছুই অস্তিত্ব পাওয়া যাচ্ছিল না। তাই পাইল স্থাপন চ্যালেঞ্জে পড়ে। পরে বিশেষজ্ঞদল এসে নতুন কর্মকৌশল তৈরি করে সফলতা পায়। গ্রাউন্ড তৈরি হচ্ছে ৭০ শতাংশ সিমেন্ট এবং ৩০ শতাংশ পানির মিশ্রণে। মূল পিলারের ডিজাইন অনুমোদনেও অগ্রগতি হয়েছে। ৬ নম্বর থেকে ৩৬ নম্বর পর্যন্ত ৩১টি পিলারের ডিজাইন এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এটি এখন অনুমোদনের জন্য পরামর্শক প্রতিষ্ঠানের কাছে রয়েছে। এদিকে জাজিরা প্রান্তে ৩৭ নাম্বার থেকে ৪১ নম্বর পিলার পর্যন্ত ৫টি পিলারের ডিজাইন অনুমোদন হয়ে গেছে। প্রতিটি পিলার ১২২ মিটার মাটির নিচে থাকছে। আর উপরে থাকছে ৬ মিটার। সবমিলিয়ে এই ৫টি পিলার হচ্ছে ১২৮ মিটার দীর্ঘ। অন্যদিকে মাওয়া প্রান্তে ২ নম্বর থেকে ৫ নম্বর পিলার পর্যন্ত চারটি পিলারের ডিজাইনের চূড়ান্ত অনুমোদন মিলেছে। এই পাঁচটি পিলারের প্রতিটি ১২০ মিটার দীর্ঘ। এর মধ্যে মাটির নিচে থাকছে ১১৪ মিটার এবং উপরের অংশে ৬ মিটার করে। এই ২ থেকে ৪১ পর্যন্ত এই ৪০টি পিলারের প্রতিটিতে ছয়টি করে পাইল থাকছে। এছাড়া ৪২ নম্বরের পিলারে ডিজাইন আগেই চূড়ান্ত হয়েছে। জাজিরা প্রান্তে ৪২ নম্বর পিলার ৮০ মিটার মাটির নিচে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই পিলারের ৮টি পাইল সম্পন্ন হয়ে গেছে। এই পিলারে বসবে মোট ১৬টি পাইল। বাকি পাইল স্থাপন দ্রুত সময়ের মধ্যে শেষ হবে। মাওয়া প্রান্তের ১ নম্বর পাইলের কাজ এখনও শুরু হয়নি। এদিকে আরও ৩৭ ও ৩৮ নম্বর পিলারের কংক্রিটিং সম্পন্ন হয়েছে। বটম পাইল পুরোপুরি শেষ করে এখন টপ পাইলের কাজ শুরু হচ্ছে। এই টপ পাইল খুব অল্প সময়ের মধ্যেই দৃশ্যমান হবে। টপ পাইলের উপরেই বসবে স্প্যান। স্প্যানটিও পুরোপুরি প্রস্তুত। আরও দুটি স্প্যানের ফিটিংও চূড়ান্ত পর্যায়ে। মাওয়ার কুমারভোগের ওয়ার্কশপে প্রায় ছয়টি স্প্যান রয়েছে। এছাড়াও আরও দুটি স্প্যান পথে রয়েছে। বাংলাদেশের পথে থাকা এই স্প্যানবাহী মাদার ভেসেল সিঙ্গাপুর বেশ কিছুদিন অবস্থানের পর আবার সমুদ্র পথে বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হয়েছে। ৩৯ নম্বর পিলারেও ছয়টি পাইল বসে গেছে। তাই এই পিলারেও কংক্রিটিং কাজ শুরু হয়েছে। এছাড়া ৪০ ও ৪১ নম্বর পিলারেও ছয়টি করে পাইল স্থাপনের কাজ এগিয়ে চলেছে। জাজিরা প্রান্তে ভায়াডাক্টের (সংযোগ সেতু) কাজও চলছে হরদম। ১৯৩ পাইলের মধ্যে ৭৩টি পাইল স্থাপন হয়ে গেছে। তবে এখনও মাওয়া প্রান্তের সংযোগ সেতুর কাজ শুরু হয়নি। মূল সেতুর কাজের এই গতি আরও বাড়িয়ে রেখে জুলাইতে তাক লাগিয়ে দেয়ার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। এখন অনেকেই আসছেন সেতুর কাজ দেখতে। বাঙালী গর্বের এই সেতুর অগ্রগতি আর হুলস্থুল কাজ দেখে বিস্মিত হয়েছেন নানা বয়সী মানুষ। এই সেতুটির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন ছাড়াও গোটা দেশের অগ্রগতির নতুন দিগন্ত তৈরি হবে। জিডিপি বেড়ে যাবে। ঢাকা থেকে কাজ দেখতে আসা মোঃ নজরুল ইসলাম জানান, সেতুটি দেশের অগ্রযাত্রার নতুন সিঁড়ি হিসেবে যুগে যুগে বিবেচিত হবে। এমন অনেকেই আসেন মাওয়ায়। তারা পদ্মা সেতুর কাজে নিয়োজিত ভারি ভারি যন্ত্রপাতি আর দু’প্রান্তে এবং নদীতে দেশী-বিদেশীদের ব্যস্ততা দেখে বিস্মিত হন। সেতুর জাজিরা প্রান্তে কাজের ব্যাপকতা চলছেই। ট্রানজেকসন পিলার, ভায়াডাক্ট এবং আশপাশের পিলারগুলোতে কাজ আর কাজ। জাজিরা প্রান্তের ৩৭, ৩৮, ৩৯, ৪০, ৪১ ও ৪২ নাম্বার পিলারেই বেশি ব্যস্ততা লক্ষ্য করা গেছে। এদিকে মাওয়া প্রান্তে এই পিলার তৈরির কাজ প্রসারিত করা হয়েছে। ওয়ার্কশপেও স্প্যান ফিটিং এবং অন্যান্য কাজ হরদম চলছে। সেতুর বেজ গ্রাউন্ড সমস্যার সমাধানের পর ক্রমেই সব কাজে গতি বেড়ে যাচ্ছে। সেতু কর্তৃপক্ষের সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা জানান, কাজের এই গতিতে সন্তুষ্ট সকলে। এখন দ্রুত সময়ের মধ্যে আরও এগিয়ে যাবে। সেতুর ভিতই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কাজ। সেই পাইল স্থাপনে অর্থাৎ বৈচিত্র্যময় পদ্মায় বেজ গ্রাউন্ডের কাজে নতুন চ্যালেঞ্জ আসে। সেই চ্যালেঞ্জ সফল মোকাবেলার পর পুরো প্রকল্পে বিশেষ প্রশান্তি বিরাজ করছে। এদিকে পদ্মা সেতু নির্মাণ প্রকল্পে উপ-প্রকল্প পরিচালক (কারিগরি) পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হচ্ছে একজন অভিজ্ঞ প্রকৌশলীকে। এই পদে নিয়োগ পাচ্ছেন প্রকৌশলী মোঃ কামরুজ্জামান। সড়ক ও জনপথ অধিদফতরের এই প্রকৌশলী গত ৩ মার্চ অবসরে যান। পদ্মা সেতু প্রকল্পেই সর্বশেষ প্রেষণে নিযুক্ত ছিলেন তিনি। আগামী দু’বছরের জন্য তাকে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে। এদিকে পদ্মা সেতু পুনর্বাসন কেন্দ্রে ৪টি স্কুল চালু পর এখন চালু হয়েছে ৫টি স্বাস্থ্য কেন্দ্র। তাই পুনর্বাসন কেন্দ্রগুলোতেও পূর্ণতা পেয়েছে।
×