ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

নাজনীন বেগম

গ্রাম পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রকল্প

প্রকাশিত: ০৭:০৬, ৭ এপ্রিল ২০১৭

গ্রাম পর্যায়ে নারীর ক্ষমতায়ন ও উদ্যোক্তা তৈরিতে প্রকল্প

কোকাকোলা বাংলাদেশ এবং বিজনেস ইনিশিয়েটিভ ডেভেলপমেন্ট (ইটওখউ)-এর যৌথ উদ্যোগে গ্রামীণ নারীর ক্ষমতায়ন এবং উদ্যোক্তা উদ্বুদ্ধকরণে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় আরও গতিশীল ভূমিকা পালনের ওপর এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়। ২ এপ্রিল হোটেল লেকশোরে অনুষ্ঠিত এ সভায় প্রধান অতিথি ছিলেন শিল্প মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব মোশাররফ হোসেন ভূঁইয়া। বাংলাদেশের খুলনা, জামালপুর, বাগেরহাট থেকে আসা সফল নারী উদ্যোক্তাদের উৎসাহ এবং সম্মাননা প্রদান করে অনুষ্ঠানটির মূল বার্তা দর্শক-শ্রোতাদের কাছে পৌঁছে দেয়া হয়। এমন সব নারী উদ্যোক্তাকে সামনে নিয়ে আসা হয় যারা একেবারে শূন্য অবস্থা থেকে আজকের এই অবস্থানে সফল হিসেবে নিজেকে তুলে ধরেছেন। সমাজের অর্ধাংশ মহিলারা কিভাবে গ্রাম-গঞ্জে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে প্রকল্পের আওতায় প্রশিক্ষণ নিয়ে নিজেদের দক্ষতা এবং যোগ্যতা প্রমাণ করতে পেরেছেন অনুষ্ঠানে তারও একটা স্পষ্ট চিত্র উঠে আসে। এখনও দেশের সিংহভাগ মানুষ গ্রামেই বাস করে। সুতরাং গ্রামের নারীদের উন্নয়নের প্রক্রিয়া থেকে বিচ্ছিন্ন করে কোনভাবেই সামগ্রিক দেশের সমৃদ্ধি আসতে পারে না। মূলত খুলনা এবং জামালপুরের প্রায় ২০ হাজার গ্রামীণ নারীকে ২০১৫ থেকে ২০১৯ পাঁচ বছর মেয়াদি এ প্রকল্পের অধীনে প্রশিক্ষণ এবং ঋণ দিয়ে যোগ্য উদ্যোক্তা গড়ে তুলতে সহায়তা করা হয়। যদিও তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। এখানে মাত্র দুই বছরের কার্যক্রম তুলে ধরা হয়। এ ধরনের একটি উন্নয়নশীল প্রকল্পকে বাস্তবে রূপ দিতে গিয়ে সংশ্লিষ্টরা বিভিন্ন সমস্যার মুখোমুখি হয়েছেন বলে বক্তাদের আলোচনায় উঠে আসে। গতানুগতিক, রক্ষণশীল সমাজ ব্যবস্থায় নতুন কোন শক্তি কিংবা কার্যক্রমকে মেনে নেয়া অত সহজ হয় না। আর দুর্বল, অসহায় এবং পিছিয়ে পড়া গোষ্ঠী হিসেবে নারীদের অবস্থা হয় আরও করুণ। যেহেতু এই প্রকল্প মূলত গ্রামীণ নারীদের নিয়ে সেখানে এর বাস্তবায়নের জায়গায় ভিন্নমাত্রার কোন নীতিমালা প্রণয়ন করা হয়েছে কিনা সে প্রসঙ্গও উঠে আসে। তবে বিইউআইএলডির সিইও মিসেস ফেরদৌস আরার বক্তব্যে স্পষ্ট হয় আসলে যতই সমস্যা আসুক না কেন মেয়েদের জন্য আলাদা কোন নীতিমালা নেই। নারীর ক্ষেত্রে এ ধরনের কর্মযোগে প্রথম বাধাটা আসে পরিবার থেকেই। ক্রমান্বয়ে তা পাড়া, মহল্লা, গ্রাম এমনকি পুরো সমাজ ব্যবস্থার কঠিন আবর্তে পড়তে হয় গ্রাম সমাজের অসহায়, নির্বিত্ত, পিছিয়ে পড়া অর্ধাংশ এই গোষ্ঠীকে। তার পরেও এ প্রচেষ্টা অব্যাহত থাকে এবং কিভাবে গ্রামীণ নারীদের সামগ্রিক উন্নয়ন পরিকল্পনায় যুক্ত করা যায় সেই উদ্যোগ আর উদ্যমে সংশ্লিষ্টরা এগিয়ে যেতে থাকেন। প্রকল্পের শুরুতেই এমন পেশায় নারীদের আনার চেষ্টা করা হয় যার সঙ্গে ইতোমধ্যে গ্রামীণ নারীরা প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে যুক্ত আছে। প্রথমেই কৃষি অর্থনীতিতে নারীর ক্ষমতায়ন এবং উদ্যোক্তার প্রেক্ষাপটে তাদের বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ ও আর্থিক সহযোগিতা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। ফসল রোপণ থেকে আরম্ভ করে ঘরে তোলা পর্যন্ত নারীদের আরও দক্ষতার সঙ্গে নিজের অবস্থানে যোগ্যতম হিসেবে গড়ে ওঠার আগ্রহ তৈরি করা হয়। যে সব গ্রামীণ নারীকে প্রকল্পের মাধ্যমে প্রশিক্ষণ দেয়ার পর তারা যেভাবে নিজেদের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে তা সত্যিই অভাবনীয়। এক্ষেত্রে তারা পুরুষের থেকেও অনেকখানি এগিয়ে। চাষাবাদ থেকে আরম্ভ করে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র শিল্প-কারখানায় মহিলাদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ এবং কর্মপ্রক্রিয়া যেভাবে নারীর সামনের দিকে এগিয়ে যাওয়ার পথকে সুনিশ্চিত করছে একইভাবে দেশের সামগ্রিক সমৃদ্ধিতেও এর প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। বাংলাদেশের মাত্র ২/৩টা জেলার ওপর এই প্রকল্প বাস্তবায়নের প্রয়াস চালানো হলেও এই মহিলাদের দেশের প্রতিনিধি কিংবা নমুনার অংশ হিসেবে ধরে নিলে সারা বাংলাদেশের গ্রাম-গঞ্জে এর সুফল পাওয়া মাত্র সময়ের ব্যাপার। এর জন্য আরও উদ্যোগ, প্রয়োজনীয় আর্থিক সহযোগিতা থেকে শুরু করে বিভিন্ন রকম সাহায্য প্রদান করলে অর্ধাংশ নারীরা এগিয়ে আসবে। দেশ ও তার উন্নয়নের সঠিক লক্ষ্যমাত্রায় পৌঁছতে দেরি করবে না। সুতরাং আলোচনায় এমন প্রসঙ্গের অবতারণা করে এ ধরনের সুযোগ-সুবিধা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামের মহিলাদের হাতের নাগালে নিয়ে আসার উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়। এই কারণে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানসমূহ বিভিন্ন কর্মপ্রক্রিয়ায় যুক্ত হলে সারাদেশের পিছিয়ে পড়া নারীরা নতুন উৎসাহ আর উদ্দীপনায় সামনের সারিতে চলে আসতে বেশি দেরি হওয়ার কথা নয়। নারী শ্রমের বৈষম্যকরণের ওপরও সভায় আলোকপাত করা হয়। বিশেষ করে নারীর অনেক শ্রমের কোন মূল্যায়নই হয় না। কাকডাকা ভোর থেকে রাত অবধি পরিবারে নারীরা যে পরিমাণ শ্রম দেয়Ñ সেখানে তাদের মূল্য একেবারে শূন্যের কোঠায়। আর কর্মক্ষম স্বামীর পাশে সে ক্ষেতমজুর কিংবা শিল্প শ্রমিকই হোক না কেন সেখানে স্ত্রী হিসেবে নারীর যে কর্মযোগ সেটাও অনেক ক্ষেত্রে উপেক্ষিত থাকে। আমাদের যে চিরায়ত ধারণা ইচ্ছে থাকলে উপায় হয়Ñ সেখানেও নারীরা অনেক পিছিয়ে। তাদের ইচ্ছা-অনিচ্ছার আকাক্সক্ষা এবং বিরোধ এতই তীব্র সেখানে এক পা এগুলে দুই পা পেছাতে হয়। এসব বাধাকে অতিক্রম করতে না পারলে নিজেদের পায়ে দাঁড়ানো একেবারে অসম্ভব। গ্রাম-গঞ্জে তো এই প্রচেষ্টা আরও সুদূর পরাহত। সুতরাং শিক্ষাই অন্যতম প্রধান মাধ্যম যা নির্ণায়কের ভূমিকা পালন করে নারীদের কয়েক ধাপ এগিয়ে নেবে। বিভিন্ন প্রতিযোগিতামূলক শিক্ষা কার্যক্রমে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার হার ছেলেদের তুলনায় এখন বেশি। এটাও নারীর ক্ষমতায়ন এবং যোগ্যতাকে নতুন মাত্রা দিচ্ছে বলে আলোচকরা অভিমত ব্যক্ত করেন। তবে বিভিন্ন আঞ্চলিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে সমন্বয়হীনতা পুরো কর্মপরিকল্পনার বড় ধরনের প্রতিবন্ধকতা। দেশের সামগ্রিক উন্নয়নকে লক্ষ্যমাত্রা ধরে বিভিন্ন কর্মউদ্যোগের সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনার নিরিখে এক ধরনের অবিচ্ছিন্ন যোগাযোগ সারাদেশের আগ্রহী নারীদের মধ্যে যে কর্মদ্যোতনা সৃষ্টি করবে তা আরও ফলপ্রসূ এবং যুগান্তকারী হতে পারে। আর তাই ‘আমার দেশ, আমার গ্রাম’ এই বার্তা নিয়ে গ্রামীণ মহিলাদের এক অভিন্ন কর্মযোগে শামিল করতে হবে যাতে তারা শুধু নিজেদেরই তৈরি করবে না দেশও গতিশীল হবে। মেয়েরা আগে স্বপ্ন দেখত স্বামী-সন্তানসহ এক সুখী সংসারের। কিন্তু সময়ের দাবিতে মেয়েদের এই সীমাবদ্ধ স্বপ্ন দেখায় এক ধরনের জোয়ার এসেছে। যে স্রোতে তারা নিজেকে যোগ্য এবং উপযুক্ত নাগরিক হিসেবে দেশের সমৃদ্ধিতে তাদের আবশ্যকীয় ভূমিকা পালন করতে চায়। এখানে নিজের আর্থিক সাফল্য থেকে আরম্ভ করে উন্নয়নের গতিধারায় সম্পৃক্ত হয়ে দেশ ও জাতিকে একটি বিশেষ মাত্রায় পৌঁছে দেবে। তথ্যপ্রযুক্তিতেও গ্রামীণ নারীরা এগিয়ে যাচ্ছে। তারা মোবাইল ব্যাংকিং থেকে শুরু করে কম্পিউটার পর্যন্ত ব্যবহার করতে পারে। তৃণমূল থেকে উঠে আসা নারীদের প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযুক্তির ব্যবহারে পারদর্শী করে তোলা হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ কোটি মহিলার জন্য এ্যাকাউন্ট করে দিয়েছেন যাতে তারা মেয়েদের উপবৃত্তির টাকা মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে তুলে নিতে পারে। বর্তমান মহিলারা সেভাবেই মেয়েদের উপবৃত্তির টাকা তুলে নিচ্ছেন। প্রতিবছর ৩০ লাখ লোকের নতুন কর্মসংস্থান তৈরি হয় সেখানে নারীদের সমান সংখ্যক অংশগ্রহণ নারীর ক্ষমতায়ন এবং উদ্যোগের এক বিশেষ সংযোজন। শিল্প সচিবের বক্তব্যে উঠে আসেÑ নারীরা সব সময় ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ব্যবসার সঙ্গে জড়িত ছিল। তখনকার দিনে কৃষিনির্ভর পল্লীবালারা নিজেদের পালন করা গরুর দুধ বাজারে বিক্রি করত। ক্ষেতে যদি প্রয়োজনের অতিরিক্ত শাক-সবজি ফলানো হতো সেখান থেকেও উদ্বৃত্ত অংশ বাজারে চলে যেত। আর হাঁস, মুরগি পালনের ব্যাপার তো ছিলই। প্রয়োজনে তা বাজারজাতও করা হতো। ঘরে পালা হাঁস-মুরগির ডিমের চাহিদা আজও গ্রাম-বাংলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে দৃশ্যমান। জমি থেকে আসা চাল, ডাল, গম, মরিচ সবই বাজারে বিক্রির জন্য পাঠানো হতো। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে গ্রামের গৃহিণীরাই এই দায়িত্ব পালন করতেন। তাদের প্রতিদিনের সামান্য হাত খরচ এসব বিক্রি করা অর্থ থেকেই মিটে যেত, সুতরাং এসব ক্ষুদ্র কর্মযোগ আজ ব্যাপকভাবে কৃষিসহ ক্ষুদ্র এবং মাঝারি শিল্প-কারখানায় ছড়িয়ে পড়ছে এবং গ্রামীণ নারীরা সমাজের বৃহত্তর আঙিনায় ও পুরো অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে।
×