ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

পাড় বাঁধাইয়ে দখল দূষণ কমছে, বিনোদনের জন্য ভিড়

বদলে যাচ্ছে ঢাকার চার নদী পারের মানুষের জীবনযাত্রা

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৭ এপ্রিল ২০১৭

বদলে যাচ্ছে ঢাকার চার নদী পারের মানুষের জীবনযাত্রা

শাহীন রহমান ॥ ঢাকার চার নদীর বিভিন্ন স্থানে পাড় বাঁধাইয়ের কারণে বদলে যাচ্ছে নদী পাড়ের দৃশ্য। পাশাপাশি বদলে যাচ্ছে নদীপাড়ের জীবনও। ২০০৯ সালে আদালতের রায় মেনে বিআইডব্লিটিএর পক্ষ থেকে বুড়িগঙ্গা, তুরাগ ও শীতলক্ষ্যা নদীর অনেক স্থানেই এখন পাড় বাঁধাই করা হয়েছে। নির্মাণ করা হয়েছে ওয়াকওয়ে ও বসার স্থান, নদী ঘাট ও বনায়ন। নদীর পাড় বাঁধাইয়ের পাশাপাশি ওয়াকওয়ে নির্মাণের কারণে নদী দৃশ্যপট পাল্টে যাচ্ছে। মানুষ সাময়িক বিনোদনের জন্য নদীপাড়ে আসছেন। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদীর তীর সংরক্ষণ করে পাড় বাঁধাই করা হলে ঢাকার কোটি মানুষের অন্যতম বিনোদনের কেন্দ্রে পরিণত হবে ঢাকার চার নদী। পাশাপাশি দখল রোধে এবং নদীর তীর সংরক্ষণে পাড় বাঁধাই করা জরুরী। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নগরীর জনগণের মানুষের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য নদীর তীর বা পাড় অন্যতম বিনোদনের মাধ্যম। শারীরিক সুস্থতার জন্য এবং শিশুদের মানসিক বিকাশের জন্য নদীর তীর একটি আদর্শ জায়গা। কিন্তু ঢাকার চার নদী দখল হয়ে যাওয়ার কারণে এবং নদী দূষণের কারণে নদী পাড় যথাযথভাবে ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তারা বলেন, মানুষের বিনোদনের জন্যই নদীর তীর সংরক্ষণ ও পাড় বাঁধাই করা জরুরী। পরিবেশ অধিদফতরের সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক আব্দুস সোবহান জনকণ্ঠকে বলেন, চার নদীর তীর সংরক্ষণ করে পাড় বাঁধাই করা জরুরী। কিন্তু আদালতের রায় থাকলেও নদীর তীর যথাযথ সংরক্ষণ করার উদ্যোগ এখনও নেয়া হয়নি। আদালতের রায়ের পর নদীর তীর সংরক্ষণে পিলার দেয়া হলেও প্রায় ৩ হাজার পিলার নদীর মধ্যেই রয়েছে। এ অবস্থায় তীর সংরক্ষণ করা কঠিন হবে। তিনি বলেন পৃথিবীর সব উন্নত দেশেই নদীর তীর সংরক্ষণ করে পাড় বাঁধাই করে দেয়া হয়েছে। তারা বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে এটিকে ব্যবহার করেন। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলেও রাজধানীর ঢাকার চারপাশ দিয়ে চারটি নদী বয়ে গেলেও দখল ও দূষণের কারণে ভয়াবহ পরিবেশ বিপর্যয়ের শিকার। এটি রোধ করে নদীকে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা জরুরী বলে উল্লেখ করেন। সরেজমিনে এবং খোঁজ নিয়ে জানা গেছে নদীর যে অংশে পাড় বাঁধাই করে দেয়া হয়েছে সে অংশে দখলের পরিমাণ অন্য অংশের চেয়ে অনেক কম। আর যেসব এলাকায় পাড় বাঁধাই করে দেয়া হয়েছে সেসব অংশে মানুষ নদী পাড়কে এখন বিনোদন স্থান হিসেবেও ব্যবহার করছে। রাজধানী গাবতলীর ব্রিজের পাশে তুরাগ নদীর যে অংশে পাড় বাঁধাই করা হয়েছে দখল যেমন কম রয়েছে তেমনি মানুষ এ অংশকে এখন বিনোদনের মাধ্যম হিসেবও ব্যবহার করছেন। এছাড়া ওয়াকওয়ে থাকায় অনেকে হাঁটাহাঁটির জন্যও নদীর পাড় ব্যবহার করছেন। পাড় বাঁধাইয়ের পাশাপাশি ঘাট বাঁধাই করার জন্য বর্ষায় নদীপাড়ের লোকজন ও শিশুরা নদীতেই গোসল সারে। তবে নিরাপত্তা ব্যবস্থার অভাব ও পরিষ্কার, পরিচ্ছন্ন না রাখার ফলে সম্ভাবনা থাকলেও বাইরে থেকে কেউ নদীর পাড়ে বিনোদনের জন্য আসছেন না। তবে যারা নদীর পাড়ে বসবাস করছেন তাদের বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম এখন নদী পাড় এলাকা। সকাল সন্ধ্যায় এখন অনেক মানুষ নদীর পাড়ে ভিড় করে। বর্ষার সময় নদীর পাড়ের মানুষা মূলত নদীতেই গোসল করে থাকে। গোসলের জন্য বিভিন্ন অংশে আলাদা ঘাটও তৈরি করা হয়েছে। তবে শুষ্ক মৌসুমে পানি শুকিয়ে যাওয়া ও দূষণের কারণে কালো রং ধারণ করায় পানিতে কম মানুষ গোসল করে থাকে। তবে বিনোদনপ্রেমী মানুষের ভিড় ঠিকই রয়েছে। বছিলায় নদীর পাড়ের কয়েকজন বাসিন্দা জানান, বর্ষায় মূলত পানির দূষণ কম থাকায় নদী পাড়েই সবাই গোসল ও অন্য কাজের নদীর পানি ব্যবহার করে থাকেন। কিন্তু শুষ্ক মৌসুমে পানি দূষণ বাড়তে থাকায় পানি ব্যবহার উপযোগী থাকে না। তারা বলেন, নদীর দূষণ রোধ করা গেলে নদীপাড়ে বসবাসকারীদের ওয়াসার পানির ওপর নির্ভর করতে হত না। গাবতলী ব্রিজের দক্ষিণ থেকে বছিলা পর্যন্ত নদীর পাড় বাঁধাইয়ের কারণে এ এলাকায় কর্মচাঞ্চল্য আগের চেয়ে বেড়ে গেছে। বিশেষ করে পাড় বাঁধাইয়ের আগে নদীর এই অংশে দিনের বেলায় কেউ আসতে সাহস করত না। সরেজমিন দেখা গেছে বিআইডব্লিটিএর লঞ্চঘাট থেকে শুরু করে সøুইস গেট পর্যন্ত প্রতিদিন কয়েকশ’ জাহাজ ভিড়ছে। জাহাজ থেকে মাল খালাস করছে কয়েক হাজার শ্রমিক। অথচ আগে কেউ এই এলাকায় আসত না বললেই চলে। সরেজমিন চার নদীরপাড় ঘুরে দেখা গেছে নদীর অনেক জায়গায় পাড় বাঁধাইয়ের পাশাপাশি নির্মাণ করা হয়েছে হাঁটা পথ, গোসলের জন্য নদীঘাট, বসার স্থানও নির্মাণ সম্পন্ন করা হয়েছে। যেসব এলাকায় নদীরপাড় বাঁধাইয়ের কাজ সম্পন্ন হয়েছে সেসব এলাকার দৃশ্যপট বদলে গেছে। তবে এর বাইরে যেসব এলাকায় নদীরপাড় চিহ্নিত করা হয়নি এবং বাঁধাইয়ের কোন উদ্যোগ নেয়া হয়নি সেসব এলাকায় দখলের চিহ্ন রয়েছে ব্যাপক। বিশেষ করে মিরপুর এলাকার তুরাগে যে অংশে বাঁধাই করা হয়নি সেসব বালু ব্যবসায়ীদের দখলে চলে গেছে। বিআইডবিটিএর পক্ষ থেকে বারবার অভিযান চালিয়েও উচ্ছেদ করা সম্ভব হচ্ছে না মূলত প্রভাবশালীদের কারণে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন দখল দূষণ রোধ করে তীর সংরক্ষণ করতে ঢাকার চার নদীরপাড় যদি এমনি করে বাঁধাই করা যেত তাহলে নদীর নান্দনিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হত ঢাকার চার নদী। তারা বলছেন যেসব এলাকায় ইতোমধ্যে নদীপাড় বাঁধাই করা হয়েছে সে সব এলাকায় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেয়া গেলে এখনই হাতিরঝিলের মতো এসব জাগায়গাও বিনোদন কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহার করা যাবে। সদরঘাট লঞ্চঘাটের দুপাশের চিত্রও এখন অনেকটা বদলে গেছে। দখলদারিত্ব উচ্ছেদ করে এখন পাড় বাঁধাইয়ের পাশাপাশি, ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও বনায়নের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। ফলে অনেকে সাময়িক বিনোদনের জন্য এ এলাকা এখন ব্যবহার করছেন। তবে এর আশপাশে এখনও অনেক দখলদারিত্ব রয়েছে। নদীর পাড়েও এখনও আবর্জনা ফেলতে দেখা যায়। এছাড়া বিভিন্ন শিল্প কলকারখানার দূষিত পানি এখনও আগের মতোই নদীতে পড়ছে। এ বিষয়েও আদালতের রায় থাকলেও দূষণ রোধে কোন কর্যকর উদ্যোগ নেয়া হয়নি। বিশেষজ্ঞরা বলছেন নদীর দূষণ রোধ করতে হলে আগে হাজারীবাগের ট্যানারি শিল্প সরিয়ে নেয়া জরুরী। তুরাগ বুড়িগঙ্গার পাশাপাশি নারায়ণগঞ্জে শীতলক্ষ্যার তীরে হাঁটার রাস্তা (ওয়াকওয়ে), ইকোপার্ক তৈরি ও বৃক্ষরোপণের কারণে ফলে বদলে যাচ্ছে নদীপাড়ের দৃশ্য। সরেজমিন দেখা গেছে ধীরে ধীরে বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত হচ্ছে নদী তীর। তীরের অনেক অংশ দখলমুক্ত হয়েছে। তবে ভয়াবহ দূষণে এখনও মুমূর্ষু শীতলক্ষ্যা। হাইকোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী গত ৭ বছরে নদীতীরের অবৈধ অনেক স্থাপনা উচ্ছেদ হয়েছে। তবে পরিবেশবিদরা মনে করেন, তীরে জনসমাগম অব্যাহত রাখতে নদী দূষণমুক্ত করা প্রয়োজন। এ জন্য প্রয়োজন সমন্বিত পদক্ষেপ। নদী খননের পাশাপাশি তীরে আরও ব্যাপকভাবে সবুজায়নের বিকল্প নেই। ২০১১ সালে প্রায় ৯ কোটি টাকা ব্যয়ে শীতলক্ষ্যার ৬০ কিলোমিটার এলাকায় ৫ হাজার ৪১টি পিলার স্থাপন করা হয়। যদিও পিলার স্থাপন নিয়ে প্রথম থেকেই বিতর্ক রয়েছে। ভুলভাবে পিলার স্থাপনের কারণে নদী দখলকে সহজ করে দেয়া হয়েছে। ২০১২ সালে নারায়ণগঞ্জ নদীবন্দরসংলগ্ন এলাকায় ওয়াকওয়ের পাশে সৌন্দর্যবর্ধনে ফুলের বাগান করে বিআইডব্লিউটিএ। ৫ কিলোমিটার এলাকায় নদীর তীর রক্ষায় পাকা স্থাপনা নির্মাণ, ওয়াকওয়ে নির্মাণ ও গাছ লাগানোর কাজ শুরু হয়। নারায়ণগঞ্জ লঞ্চ টার্মিনালের দক্ষিণ পাশ থেকে নিতাইগঞ্জ খালঘাট পর্যন্ত প্রায় পৌনে তিন কিলোমিটার ওয়াকওয়ে নির্মাণ করা হয়। সিদ্ধিরগঞ্জের শিমরাইল, কাঁচপুর, রূপগঞ্জের তারাব ও ডেমরায় নদীতীরে অবৈধ বালু ও পাথরের ব্যবসা স্থায়ীভাবে বন্ধে ১০ লাখ টাকা ব্যয়ে বিভিন্ন গাছের ৮ হাজার চারা রোপণ করে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ। এছাড়া শীতলক্ষ্যার তীরে শহরের বরফকল এলাকায় একটি বেসরকারী পার্কও গড়ে তোলা হয়েছে। সরেজমিন দেখা গেছে ওয়াকওয়ে নির্মাণ, বৃক্ষরোপণে বদলে গেছে নদী তীরবর্তী এলাকার লোকজনের জীবনযাত্রা। ওয়াকওয়েতে হাঁটাহাঁটি করতে পারায় খুশি তীরবর্তী এলাকার লোকজন। দূর-দূরান্ত থেকে লোকজনও আসছেন সেখানে। ওয়াকওয়ে ঘিরে জমে উঠতে শুরু করেছে ব্যবসা। নদীপাড়ে বসছে নানা পণ্যের সমাহার। বিআইডব্লিউটিএ এক কর্মকর্তা বলেন ওয়াকওয়ে নির্মাণের পাশাপাশি নদীতীরে বৃক্ষরোপণ ও ফুলের বাগান তৈরির মাধ্যমে নদীতীরকে বিনোদন কেন্দ্রে পরিণত করার প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে। নদীর উভয় তীরে আরও ওয়াকওয়ে নির্মাণের পরিকল্পনা রয়েছে। এটি হলে দুই তীরের চিত্র সম্পূর্ণ বদলে যাবে। এদিকে বুড়িগঙ্গাকে দৃষ্টিনন্দন হাতিরঝিলের আদলে সাজানোর পরিকল্পনা করেছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। এ জন্য ২ হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও নেয়া হয়েছে বলে জানা গেছে। এ প্রকল্পের মধ্যেমে নদীকে দখল ও দূষণমুক্ত করে তীর সংরক্ষণের মাধ্যমে নদীকে আগের অবস্থায় ফিরে আনা হবে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে বুড়িগঙ্গার তীর ঘেঁষে হাজারীবাগ হইতে পাগলা পর্যন্ত দখলমুক্ত করার কাজ হাতে নিয়েছে তারা। প্রকল্পের মধ্যে থাকিবে অবকাশ যাপনের জন্য নদীরতীরে বিলাসবহুল রিসোর্ট, হাঁটার জন্য ওয়াকওয়ে পার্ক, বসার স্থান, নদীঘাট, পর্যটকদের জন্য প্রমোদতরী, ভাসমান বিনোদন কেন্দ্র ও রেস্তোরাঁ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন প্রতিদিন কাজের প্রয়োজনে রাজধানী ঢাকায় মানুষের ভিড় বাড়ছে। কিন্তু তাদের বিনোদনের কোন পরিসর বাড়ছে না। প্রায় দেড় কোটি মানুষের বিনোদনের জন্য কোন ব্যবস্থা নেই বলা চলে। ফলে অবসরেও তাদের নিরস ঘরে বসেই থাকতে হয়। অথচ চার নদীকে দখল-দূষণমুক্ত করে বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করা গেলে মানুষের মানসিক ও শারীরিক বিকাশের পরিধি তৈরি হবে। সেই সঙ্গে বেড়ে যাবে নদীপাড় ঘিরে অর্থনেতিক কর্মকা-। পৃথিবীর বহুদেশে নদীপাড় ঘিরে বিনোদনের ব্যবস্থা রয়েছে। অথচ ঢাকার চারদিকে চারটি নদী থাকার পর দিনে দিনে ঢাকার বিনোদনের পরিবেশ সঙ্কুচিত হয়ে আসছে।
×