ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

রমজানের আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে পাল্লা দিয়ে

প্রকাশিত: ০৫:৪৬, ৭ এপ্রিল ২০১৭

রমজানের আগেই নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে পাল্লা দিয়ে

এম শাহজাহান ॥ ভোগ্যপণ্যের দাম বাড়বে না ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে এমন আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। সরকারের পক্ষ থেকেও ভোক্তাকে আশ্বস্ত করা হয়েছিল জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। কিন্তু রমজান শুরুর আগে পাল্লা দিয়ে বেড়ে যাচ্ছে নিত্যপণ্যের দাম। রমজানে সবচেয়ে বেশি চাহিদা তৈরি হয় এমন পাঁচ পণ্য ছোলা, ডাল, চিনি, ভোজ্যতেল ও খেজুরের দাম এখন উর্ধমুখী। এর সঙ্গে চাল, গরু, খাসির মাংস এবং রসুনের অতিরিক্ত দাম বাড়তি অস্বস্তি এনে দিয়েছে। দেশীয় উৎপাদন বৃদ্ধি এবং আমদানি পরিস্থিতি ভাল হওয়ার কারণে স্বাভাবিক দামে বিক্রি হচ্ছে পেঁয়াজ। এক্ষেত্রে কৃষক ন্যায্যদাম না পেলেও মধ্যস্বত্বভোগীর পোয়াবারো বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে। হিসাবে করে দেখা গেছে, রমজানে চাহিদা তৈরি হবে এমন পাঁচ পণ্যের দাম কয়েক দিনে কেজিতে বেড়েছে ১০-১৫ টাকা পর্যন্ত। প্রতিকেজি ছোলা বিক্রি হচ্ছে ৮০-৯০ টাকা। এক্ষেত্রে দাম বৃদ্ধির হার প্রায় ১০ শতাংশ পর্যন্ত। এক বছরে ২৮ শতাংশ দাম বেড়ে চিনি বিক্রি হচ্ছে ৬৮-৭০ টাকায়। নতুন মসুর ডাল বাজারে ওঠার পরও তা বিক্রি হচ্ছে ১৩৫-১৫০ টাকায়। রমজান সামনে রেখে মসুরের দাম বৃদ্ধির আশঙ্কা করা হচ্ছে। পাঁচ লিটারের বোতলজাত ভোজ্যতেল বিক্রি হচ্ছে ৪৯০-৫২০ টাকায়। এক্ষেত্রে এক বছরে দাম বেড়েছে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত। অথচ এক বছরে আন্তর্জাতিক বাজারে ভোজ্যতেলের দাম সবচেয়ে বেশি হ্রাস পেয়েছে। জাত ও মানভেদে প্রতিকেজি খেজুর বিক্রি হচ্ছে ১০০-৪০০ টাকায়। এক্ষেত্রে দাম বেড়েছে প্রায় ১৭ থেকে ৫০ শতাংশ পর্যন্ত। শুধু দাম কমে পেঁয়াজ বিক্রি হচ্ছে ২০-২৬ টাকায়। উৎপাদন ভাল হওয়ায় এক বছরে পেঁয়াজের দাম কমেছে ১৭ শতাংশ পর্যন্ত। এছাড়া দাম বেড়ে গরু ৪৮০-৫০০ এবং খাসির মাংস বিক্রি হচ্ছে ৭০০-৭৫০ টাকায়। এ যাবতকালের মধ্যে এটিই সর্বোচ্চ দাম। এছাড়া মসলাজাতীয় পণ্যের মধ্যে রসুন সবচেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ১৮০-২০০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে প্রতিকেজি রসুন। রমজান সামনে রেখে জিনিসপত্রের দাম বাড়ায় উদ্বিগ্ন সরকার। বিশেষ করে মোটা চালের দাম হু হু করে বেড়ে যাওয়ায় দ্রব্যমূল্য নিয়ে ভোক্তার মধ্যে অস্বস্তি দেখা দিয়েছে। এছাড়া আমিষের প্রধান উৎস গরু, খাসি ও ব্রয়লার মুরগির দাম না কমলে সাধারণ ভোক্তার কষ্ট আরও বাড়বে। এই পরিস্থিতিতে জিনিসপত্রের দাম কিভাবে নাগালের আনা যায় সেজন্য বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে সংশ্লিষ্ট স্টেক হোল্ডার, আমদানিকারক, পাইকার, মিলমালিক এবং খুচরা ব্যবসায়ীর সঙ্গে বৈঠক আহ্বান করা হয়েছে। আগামী ১২ এপ্রিল বুধবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সিনিয়র সচিব শুভাশিষ বসুর সভাপতিত্বে প্রথম বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে শুভাশিষ বসু জনকণ্ঠকে বলেন, রমজান সামনে রেখে জিনিসপত্রের দাম নিয়ে যাতে কোন কারসাজি না হতে পারে সেজন্য ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বৈঠক করা হবে। ভোক্তাস্বার্থ নিশ্চিত করতে সরকারের পক্ষ থেকে সব ধরনের উদ্যোগ থাকবে। তিনি বলেন, রমজান সামনে রেখে ইতোমধ্যে কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়েছে। এ ব্যাপারে খোঁজখবর নেয়া হচ্ছে। তবে আমদানি পরিস্থিতি, অভ্যন্তরীণ মজুদ এবং ঋণপত্র খোলার পরিসংখ্যান বলছে, রমজানে জিনিসপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণের মধ্যে থাকবে। রমজানে ডাল, ছোলা, চিনি, পেঁয়াজ, রসুন, খেজুর ও ভোজ্যতেলের চাহিদা থাকে সবচেয়ে বেশি। এর মধ্যে পেঁয়াজ ছাড়া সব পণ্যের দাম বেড়েছে। সম্প্রতি বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের দ্রব্যমূল্য পর্যালোচনা কমিটির বৈঠকে ব্যবসায়ীরা পণ্য সরবরাহ ঠিক রেখে দাম না বাড়ানোর অঙ্গীকার করেন। বৈঠকে বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ বলেছিলেন, নিত্যপণ্যের কৃত্রিম সঙ্কট সৃষ্টি করে দাম বাড়ানো হলে ব্যবস্থা নেয়া হবে। পণ্যবাজার স্থিতিশীল রাখার জন্যও তিনি ওই সময় ব্যবসায়ীদের প্রতি অনুরোধ করেছিলেন। এরই মধ্যে কয়েকটি পণ্যের দাম বেড়ে গেছে। এ বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে কঠোর কোন পদক্ষেপ দেখা যায়নি। সরকারী সংস্থা টিসিবির তথ্য মতে, পেঁয়াজ ছাড়া রমজানে ব্যবহার হয় এমন সব পণ্যের দাম এখন বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে। ভোজ্যতেল নিয়ে ব্যবসায়ীদের তেলেসমাতি ॥ গত বছর ডিসেম্বরে বিশ্ব বাজারে প্রতিটন অপরিশোধিত সয়াবিনের মূল্য ছিল ৮০০ ডলার বা ৬২ হাজার ৪২০ টাকা। আর মার্চের শেষদিকে বিশ্ব বাজারে পণ্যটি বিক্রি হয়েছে ৭১০ ডলার বা ৫৫ হাজার ৩৮০ টাকায়। অর্থাৎ চার মাসের ব্যবধানে বিশ্ব বাজারে প্রতিটন সয়াবিন তেলের দাম কমেছে ৯০ ডলার। টাকার অঙ্কে যা ৭ হাজার । অথচ দেশের বাজারের চিত্র ঠিক তার উল্টো। ভোজ্যতেলের দাম কমানোর কোন লক্ষণ তো নেই-ই বরং এ সময়ের মধ্যে দুই দফা দাম বাড়ানো হয়েছে। আমদানি মূল্যের দ্বিগুণ দামে বিক্রি করে ভোজ্যতেল ব্যবসায়ীরা লুফে নিচ্ছে বাড়তি মুনাফা। আন্তর্জাতিক বাজারে ভোগ্যপণ্যের মূল্য তদারকি সংস্থা ‘ইনডেক্স মুন্ডির’ তথ্য অনুযায়ী বর্তমানে বিশ্ব বাজারে প্রতিটন সয়াবিনের মূল্য ৭১০ ডলার বা ৫৫ হাজার ৩৮০ টাকা (১ ডলার=৭৮ টাকার হিসাবে)। অর্থাৎ প্রতি কেজির দাম পড়ে ৫৫ টাকা ৩৮ পয়সা। এর সঙ্গে ভ্যাট, জাহাজ ভাড়া, বন্দর এবং রিফাইন খরচসহ অন্যান্য খরচ যুক্ত হবে আরও প্রায় ৪ টাকা। সে হিসেবে এক কেজি সয়াবিন তেলের মূল্য পড়ছে ৫৯ টাকা ৩৮ পয়সা। অথচ খুচরা বাজারে বোতলজাত প্রতি লিটার সয়াবিন বিক্রি হচ্ছে ১০৫ থেকে ১০৭ টাকায়। আর খোলা সয়াবিন প্রতি কেজি বিক্রি হচ্ছে ৯০ থেকে ৯৫ টাকায়। সে হিসেবে দেখা যাচ্ছে, আমদানি মূল্যের প্রায় দ্বিগুণ দামে বিক্রি হচ্ছে সয়াবিন তেল। সুতরাং, বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের ব্যাপক মূল্য হ্রাসের প্রকৃত সুবিধা পাচ্ছে না ভোক্তা। অবশ্য আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তারা বলছেন, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম কমায় দেশেও পাইকারি পর্যায়ে দাম কমানো হয়েছে ভোজ্যতেলের। কিন্তু খুচরা পর্যায়ে এখনও দাম কমেনি। ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআইয়ের সাবেক প্রথম সহসভাপতি আবুল কাশেম আহমেদ জনকণ্ঠকে বলেন, সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগের ফলে ভোগ্যপণ্যের আমদানি পরিস্থিতি ভাল। এর পরও দু’একজন ব্যবসায়ীর কারসাজির কারণে জিনিসপত্রের দাম বাড়তে পারে। তবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় নিয়মিত বাজার মনিটরিং এবং সরকারী সংস্থা টিসিবি পণ্য বিক্রি কার্যক্রম শুরু করলে পণ্যমূল্য বাড়ানোর সুযোগ পাবে না অসাধু ব্যবসায়ীরা। আশা করছি, বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে যথাসময়ে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেয়া হবে। চিনি ও ভোজ্যতেল নিয়ে ইতোপূর্বে অনেক কারসাজি হয়েছে। কিন্তু সরকারী তৎপরতায় আবার তা নিয়ন্ত্রণের মধ্যে এসেছে। ভোজ্যতেলের অন্যতম শীর্ষ আমদানিকারক ও সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ সয়াবিনের এক শীর্ষ কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, বিশ্ব বাজারে ভোজ্য তেলের দাম কমায় আমরা সম্প্রতি প্রতি লিটারে ৫ টাকা দাম কমিয়েছি। যদি দাম কমা অব্যাহত থাকে তাহলে হয়ত আবারও কমানো হতে পারে। অবশ্য পাইকারি পর্যায়ের দাম কমার প্রভাব এখনও খুচরা বাজারে পড়েনি। হয়ত কয়েক দিনের মধ্যেই খুচরা বাজারেও সয়াবিন তেলের মূল্য সমন্বয় করা হবে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা মনে করেন, বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের ব্যাপক দাম কমায় দেশের বাজারেও দাম কমা দরকার। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পাইকারি ভোজ্যতেল ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক আবুল হাশেম জানান, ভোজ্যতেলের দাম আরও কম হওয়া দরকার। কিন্তু মিল মালিকরা না কমানোয় বাজারেও কমছে না। কারণ, বিশ্ব বাজারে এখন ভোজ্যতেলের দাম অনেক কম। প্রতি মাসেই বিশ্ব বাজারে ভোজ্যতেলের দাম কমছে। কিন্তু দেশের বাজারে খুচরা পর্যায়ে এখনও কমানো হয়নি। টিসিবির যত প্রস্তুতি ॥ চলতি বছর রমজানে নিত্যপণ্যের বাজার স্থিতিশীল রাখতে তালিকাভুক্ত পণ্য মজুদের কাজ শুরু করেছে সরকারী বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশ (টিসিবি)। এ লক্ষ্যে অস্ট্রেলিয়া থেকে ২ হাজার টন মসুর ডাল ও ২ হাজার টন ছোলা আমদানি করা হচ্ছে। স্থানীয় বাজার থেকেও কেনা হচ্ছে ১ হাজার টন ভোজ্যতেল। এর জন্য টিকে গ্রুপের সঙ্গে টিসিবির সমঝোতা চুক্তি সই হয়েছে। খেজুরও কেনা হবে স্থানীয় বাজার থেকে। তবে এর পরিমাণ এখনও পরিষ্কার করা হয়নি। জানা গেছে, এবার টিসিবির লক্ষ্য হচ্ছে শব-ই-বরাতের পর দিন থেকে কার্যক্রম শুরু করার। রাজধানীসহ সারা দেশে ১৭৪টি স্থানে ৫০ থেকে ১০০ কিলোমিটার দূরত্বে ৈৈদনিক ১ হাজার ৫০০ কেজি বা লিটার সমপরিমাণ টিসিবির পণ্য বিক্রি করা হবে। যা ঈদের আগের দিন পর্যন্ত অব্যাহত রাখা হবে। আমদানি প্রক্রিয়া সম্পন্ন হওয়া মসুর ডাল ও ছোলার প্রথম চালান চলতি মাসেই চট্টগ্রামে এসে পৌঁছবে। দ্বিতীয় চালান আসবে এপ্রিলের মাঝামাঝি। ভোজ্যতেল চাওয়া মাত্র সরবরাহ দেবে টিকে গ্রুপ। আর টিসিবির চাহিদাকৃত চিনির নিরাপদ মজুদ আগেভাগেই নিশ্চিত করা হয়েছে। এ লক্ষ্যে বাংলাদেশ চিনি ও খাদ্য শিল্প কর্পোরেশনের সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে বছর কয়েক আগেই। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে টিসিবির চেয়ারম্যান ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আবু সালেহ মোহাম্মদ গোলাম আম্বিয়া জানান, রমজানকে কেন্দ্র করে টিসিবির বিক্রিযোগ্য পণ্যের বিপুল মজুদ গড়ে তোলা হচ্ছে। ইতোমধ্যে সে মজুদের কেনাকাটার প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। তিনি দাবি করেন, শীঘ্রই সেই বাফার মজুদ নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কোন অসাধু চক্র বাজার যাতে অস্থিতিশীল করতে না পারে, এ লক্ষ্যে টিসিবির মজুদ সরবরাহের মাধ্যমে স্থিতিশীল করার সর্বাত্মক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। জানা গেছে, প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের সময় এবার টিসিবি প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতীয় রাষ্ট্রীয় সংস্থা স্টেট ট্রেডিং কর্পোরেশন অব ইন্ডিয়ার সঙ্গে সমঝোতা স্মারক সই করবে। এর মাধ্যমে ভারত থেকে আপদকালীন সরাসরি ভোগ্যপণ্য আমদানি করতে পারবে। দেশে ভোগপণ্যের ব্যবসায়ীদের সিন্ডিকেশন নিয়ন্ত্রণ এবং ট্রেডিং কর্পোরেশন অব বাংলাদেশকে (টিসিবি) শক্তিশালী করতে সরকার এ সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
×