ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

ওলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলনে আওয়াজ ॥ জঙ্গী দমনে এক হোন

প্রকাশিত: ০৫:৪০, ৭ এপ্রিল ২০১৭

ওলামা মাশায়েখ মহাসম্মেলনে আওয়াজ ॥ জঙ্গী দমনে এক হোন

স্টাফ রিপোর্টার ॥ ইসলামের নামে চলা জঙ্গীবাদীদের তৎপরতার বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ আওয়াজ উঠল ঢাকায় অনুষ্ঠিত ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলন থেকে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কিংবা সৌদি আরবের পবিত্র মসজিদে নববীর খতিব ও ইমাম এবং মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী কর্তৃপক্ষের ভাইস প্রেসিডেন্ট থেকে শুরু করে মহাসম্মেলনে আসা লাখ লাখ মুসল্লির কণ্ঠে ছিল জঙ্গী-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে লড়ার অঙ্গীকার। প্রধানমন্ত্রী যেমন দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে উচ্চারণ করেছেন তার জঙ্গীবিরোধী অবস্থানের কথা, তেমনি মসজিদে নববীর খতিব ও মসজিদে নববীর ভাইস প্রেসিডেন্ট জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়তে বিশ্বের সব মুসলমানের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। জঙ্গী দমনে শেখ হাসিনার প্রশংসা করে তারা বলেছেন, যিনি দেশ চালাচ্ছেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে তার হাতকে মজবুত করা ইসলামের নির্দেশ। বাংলাদেশে গত কয়েক বছরের ধর্মের নামে জঙ্গীবাদী তৎপরতার অব্যাহত ঘটনা ও জনমনে উদ্বেগ, জঙ্গীদের বিরুদ্ধে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অবস্থানের প্রেক্ষাপটে বৃহস্পতিবার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আয়োজিত ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলনের দিকে বিশেষ নজর ছিল পুরো দেশবাসীর। তবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের ৪২তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত ওলামা-মাশায়েখ মহাসম্মেলনে আলোচনার কেন্দ্রে ছিলেন সৌদি আরব থেকে আগত দুই অতিথি মসজিদে নববীর খতিব ও ইমাম শায়েখ ড. আব্দুল মহসিন বিন মোহাম্মদ আল কাশেম এবং মসজিদুল হারাম ও মসজিদে নববী কর্তৃপক্ষের ভাইস প্রেসিডেন্ট শায়খ ড. মুহাম্মদ বিন নাসের আল খুযাইম। তাদের একবার সচক্ষে দেখা ও তারা কী বলেন তা শোনার জন্য অধীর আগ্রহে ছিলেন দেশের মানুষ, বিশেষত সারাদেশ থেকে আসা ওলাম-মাশায়েখসহ লাখ লাখ মুসল্লি। জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে তারা কী দিকনির্দেশনা দেন সেদিকে বিশেষ নজর ছিল সচেতন জনগোষ্ঠীর। সারাদেশ থেকে মহাসম্মেলনে আসা মুসল্লিরা যেমন বলছিলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রী আহ্বান জানিয়েছেন তাই তার কথা শোনার জন্য এসেছি। তিনি দেশের উন্নয়নে কাজ করছেন। আমরা তার কথা শুনতে এসেছি।’ আবার প্রত্যেকেই একই সঙ্গে বলেছেন, ‘কোনদিন হয়ত সৌদি আরবে গিয়ে পবিত্র মসজিদের ইমাম ও খতিবকে দেখার সৌভাগ্য হবে না। তাদের কথা শোনার সুযোগ হবে না। তাই এসেছি তাদের দেখতে। তারা কী নির্দেশ দেন তা শুনতে।’ ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবারই প্রথমবারের মতো বাংলাদেশে আসেন মসজিদে নববীর ইমাম ও খতিব ড. আবদুল মুহসিন আল কাশেম এবং মক্কার হারাম শরীফের দ্বিতীয় প্রশাসনিক প্রধান ভাইস প্রেসিডেন্ট ড. মুহাম্মাদ বিন নাসের আল খুযাইম। মহাসম্মেলনে তাদের দুজনের কণ্ঠেই ছিল ইসলামের নামে চলা জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে মুসলিম বিশ্বকে সোচ্চার হওয়ার আহ্বান। তারা দুজনেই বলেছেন, বাংলাদেশ হচ্ছে বিশ্বের অন্যতম দেশ, যারা জঙ্গী দমনে সফলতা দেখিয়েছে। এ সম্মেলন দুই দেশের সম্পর্ক জোরদার ছাড়াও জঙ্গীবাদবিরোধী লড়াই জোরদারে সহায়তা করবে বলেও মন্তব্য করেন তারা। বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের সম্পর্ক আরও শক্তিশালী হবে বলে আশার কথা বলেছেন মক্কার মসজিদুল হারামের ইমাম মুহাম্মদ বিন নাসের আল খুযাইম। তিনি বলেছেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে দুই দেশ ঐক্যবদ্ধভাবে লড়ছে। এ লড়াই আরও কার্যকরভাবে চালিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকারও করেছেন তিনি। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ ইসলামের শিক্ষা নয় জানিয়ে মুহাম্মদ বিন নাসের আল খুযাইম বলেছেন, যারা জঙ্গীবাদ ছড়াতে ইসলামের নাম ব্যবহার করছে, তাদের মুখোশ খুলে দিতে তার দেশের বাদশাহ কাজ করছেন। আমি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও সৌদি বাদশাহ সালমান বিন আবদুল আজিজকে মোবারকবাদ জানাচ্ছি, যারা ঐক্যবদ্ধ হয়ে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নিয়েছেন। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ধন্যবাদ জানান মক্কা শরীফের ইমাম। তিনি বলেন, তিনি (শেখ হাসিনা) দুই দেশের সম্পর্ক স্থাপনে অনেক উত্তম পদক্ষেপ নিয়েছেন। আমার বিশ্বাস, এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশ ও সৌদি আরবের মধ্যে সুসম্পর্ক স্থাপিত হবে। মুহাম্মদ বিন নাসের আল খুযাইম বলেন, আমাদের বাদশাহ অঙ্গীকার করেছেন, যেসব দেশে ইসলামের নামে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ ছড়ানো হচ্ছে তাদের মুখোশ খুলে দেবেন। ইসলামে নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করা বড় অপরাধ বলে জানিয়েছেন সৌদি আরবের মসজিদুল হারাম ও মসজিদুন নববী কর্তৃপক্ষের ভাইস প্রেসিডেন্ট শায়খ ড. মুহাম্মদ বিন নাসের আল খুযাইম। তিনি বলেন, হে মুসলমান ভাইয়েরা, নিরপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা ইসলামে বড় অপরাধ। আমরা নিরাপরাধ ব্যক্তিকে হত্যা করতে পারি না। কোন মুসলমানকে কোন মুসলমান হত্যা করতে পারে না। বিধর্মীকেও অন্যায়ভাবে হত্যা করতে পারে না। অন্যায়ভাবে হত্যা করলে হাশরের ময়দানে জাহান্নামের আগুন রয়েছে। এ আগুন থেকে কেউ তাকে বাঁচাতে পারবে না। মসজিদে নববীর ইমাম ড. আব্দুল মহসিন বিন মোহাম্মদ আল কাশেম বলেন, যারা মানুষ হত্যা করে তাদের জন্য জাহান্নাম রয়েছে। যারা দেশের শান্তি বিনষ্ট করতে চায়, দেশে অশান্তি নিয়ে আসতে চায়, যারা জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পর্কিত তারা জাহান্নামে যাবে। মনে রাখবেন, ইসলামে কয়েকটি হারাম কাজের মধ্যে যারা মানুষক ভয়ভীতি দেখায়, যারা সন্ত্রাস-জঙ্গী কর্মকা- করে এদের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তারা দুজনই স্পষ্ট করেছেন, ইসলামের নামে যারা সন্ত্রাসী কর্মকা- চালাচ্ছে তারা ইসলামের বিরুদ্ধে কাজ করছে। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেখানে ছাত্রদের গোমরাহ করার জন্য দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে ব্যবহার করা হয়। তাদের বলুন, তাদের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। যেসব মাদ্রাসায় জঙ্গী ট্রেনিং হয় সেগুলো ইসলামী মাদ্রাসা নয়। এদের পরিচয় জঙ্গী মাদ্রাসা। এসব বিষয়ে শতর্ক থাকার জন্য আলেম-ওলামা-মাশায়েখদের প্রতি আহ্বান জানান তারা। মহাসম্মেলনে আসা লাখ লাখ মুসল্লিকে উদ্দেশ করে তারা বলেন, জঙ্গীরা ইসলামের মর্যাদাকে নষ্ট করছে। ওরা ইসলামের কেউ নয়। কিন্তু ইসলামের ভাবমূর্তি তারা নষ্ট করছে। তাই জঙ্গী-সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে লড়তে বিশ্বের সব মুসলমানকে এখন নামতে হবে। লড়তে হবে। মুসল্লিদের প্রতি ইসলামের ব্যাখ্যা তুলে ধরেন তারা দুজনেই। বলেন, যারা দেশে অশান্তি নিয়ে আসতে চায়, যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদের সঙ্গে সম্পৃক্ত তারা ওয়েল জাহান্নামে (সর্বনিকৃষ্ট দোযখ) যাবে। ইসলামে কয়েকটি হারাম কাজ বলা আছে। যারা মানুষকে ভয়ভীতি প্রদর্শন করে, যারা হত্যা করতে চায়, যারা সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ সৃষ্টি করতে চায়, তাদের জন্য আজাব রয়েছে। তাদের সঙ্গে ইসলামের কোন সম্পর্ক নেই। তাদের বক্তব্যের পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ওলামা-মাশায়েখদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ইসলামে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদের কোন স্থান নেই বলে পবিত্র মক্কা শরীফ ও মসজিদে নববীর দুই খতিব যে বক্তব্য দিয়েছেন, তা সবার কাছে পৌঁছে দিতে হবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, অতিথিরা তাদের বক্তব্যে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ইসলাম হলো শান্তির ধর্ম। ইসলাম কখনও নিরীহ মানুষকে হত্যায় বিশ্বাস করে না। ইসলাম সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদকে স্থান দেয় না। ইসলাম শান্তি ও ভ্রাতৃত্বের ধর্মে বিশ্বাস করে উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বাংলাদেশ মুসলিম অধ্যুষিত রাষ্ট্র। এখানকার ৯০ ভাগ মানুষ মুসলমান। কিন্তু অন্য ধর্মের মানুষও আছেন এ ভূখ-ে। ইসলামের প্রকৃত শিক্ষা সবার সঙ্গে বন্ধুত্ব এবং সব ধর্মের মানুষ তার ধর্ম পালন করবে। আমরা এটা পালন করতে পেরেছি। সব ধর্মের মানুষ স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করছে। আমাদের ধর্ম পবিত্র ধর্ম, শান্তির ধর্ম। এ ধর্মে নিবেদিতরা যেন ঠিকভাবে সব পালন করতে পারেন সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছি। আমরা চাই ধর্মকে কেউ যেন হেয় না করে। মুসলমান ভাই ভাই হিসেবে বসবাস করবে। সন্ত্রাসবাদী-জঙ্গীবাদী কর্মকা-ে অস্ত্র ব্যবসায়ীরাই লাভবান হয় জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমাদের শান্তি প্রতিষ্ঠায় কাজ করতে হবে। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের প্রতি আহ্বান জানিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, যেখানেই সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদ মাথাচাড়া দেবে, সেখানে আপনাদের ব্যবস্থা নিতে হবে। এদিকে মহাসম্মেলনে আসা সাধারণ মুসল্লিদের মধ্যেও ছিল জঙ্গী-সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের মনোভাব। চট্টগ্রামের সিতাকু-ু থেকে এসেছেন মসিজিদভিত্তিক পাঠাগারের তরুণ শিক্ষক আবদুল্লাহ। তিনি বলছিলেন, হয়ত সৌদি আরবে গিয়ে পবিত্র মসজিদের ইমামদের দেখার সৌভাগ্য হবে না। এসেছি তাদের দেখতে। তারা ইসলাম নিয়ে কী বলেন তা শুনতে। ইসলামে জঙ্গীবাদের ঠাঁই নেই অনেকেই বলেন। কিন্তু আজ যাদের কাছ থেকে শুনলাম তারা অনেক বড়মাপের মানুষ। এখন গিয়ে এটা সবাইকে জানাব। দিনাজপুরের শিক্ষক সরোয়ার হোসেন বলছিলেন, প্রধানমন্ত্রী প্রথমবারের মতো আমাদের ডেকেছেন। তাকে ধন্যবাদ। তার প্রতি কৃতজ্ঞ। তবে সৌদি আরবের ইমাম সাহেবরা আমাদের ইসলাম সস্পর্কে কী বলেন তা শোনার ইচ্ছা ছিল।
×