ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

পাকিস্তানী সাংবাদিকের প্রশ্ন ॥ ঢাকায় নাকি ভুট্টো-ইয়াহিয়া ও টিক্কার নামে টয়লেট হয়েছে?

প্রকাশিত: ০৩:৩৮, ৭ এপ্রিল ২০১৭

পাকিস্তানী সাংবাদিকের প্রশ্ন ॥ ঢাকায় নাকি ভুট্টো-ইয়াহিয়া ও টিক্কার নামে টয়লেট হয়েছে?

(৫ এপ্রিলের পর) দেখুন, আমার জায়গায় আপনি হলে, আপনার চোখের সামনে মা-বাবাকে জবাই করলে এবং বোনকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে গেলে আপনি কি করতেন? ঘৃণা জমত নাকি ভালবাসা জমত? - আর বঙ্গবন্ধুর কথা বলছেন, ঘৃণা সব সময়ই ছিল, আছে এবং থাকবে। এ ঘৃণা কোনকালেই মুছে যাবার নয়। বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানে গিয়েছিলেন জনগণের ইচ্ছার বিরুদ্ধে এবং পারিপার্শ্বিক চাপে পড়ে। একটি সদ্য স্বাধীন দেশের মুসলিম বিশ্বের সহযোগিতা ও সমর্থন বাংলাদেশের প্রয়োজন ছিল। তাই বাস্তবতা উপেক্ষা না করেই সেখানে গেছেন। তার অর্থ এই নয় তিনি পাকিস্তানের অতিথি হয়ে গেছেন। তিনি গেছেন মুসলিম বিশ্বের নেতাদের আন্তর্জাতিক সংগঠনের আমন্ত্রণে। এ জন্য আজ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধুর সমালোচনা কম হয় না। বাংলাদেশের মানুষ চায়, পাকিস্তান তার কৃত অপরাধের আন্তরিক অনুশোচনা প্রকাশ ও বাংলাদেশসহ আন্তর্জাতিক মহলের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা এবং লুণ্ঠিত সম্পদসহ যুদ্ধে ক্ষতিগ্রস্ত সম্পদের সার্বিক ক্ষতিপূরণ দান করুক। এ ছাড়া বাংলাদেশের মানুষ চায় না পাকিস্তানের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্ক বহাল থাকুক। বাংলাদেশের মানুষের এ মনোভাব খুব সহজে পরিবর্তন হওয়ার নয়। এছাড়া আগেই আপনি জানতে চেয়েছেন আত্মসমর্পণকারী ৯৫ হাজার পাকি সৈন্য জনতার তীব্র ঘৃণার মুখে কিভাবে সুরক্ষিত থাকল, সে বিষয়ে এই ফাঁকে বলে নেই, আমাদের তৎকালীন উচ্চ পর্যায়ের জাতীয় নেতারা বর্বরতার পথে না গিয়ে জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধীকে সুরক্ষা দেয়ার আইন মেনে চলেছেন। উত্তেজিত জনতাকে ভায়োলেন্স থেকে কঠোরহস্তে বিরত রেখেছেন। - তবে এ ক্ষেত্রেও পাকিস্তান শুধু বাংলাদেশকেই নয় আন্তর্জাতিক চুক্তিকে লঙ্ঘন করে, বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে চরম গাদ্দারি করেছে। ৭৪ সালে ভারতের সিমলায় মুজিব-ইন্দিরা-ভুট্টো সমন্বয়ে যে ত্রিপক্ষীয় বন্দী বিনিময় চুক্তি হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে ৯৫ হাজার যুদ্ধাপরাধী সৈন্যকে পাকিস্তানের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছিল। চুক্তিতে উল্লেখ ছিল, পাকিস্তান তার নিজ দেশে এই যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবে। তারা তা করেনি। এখন বাংলাদেশ তৈরি হচ্ছে এদের বিচার বাংলাদেশের মাটিতে করার জন্য। - অপরদিকে জিয়া-এরশাদের রাজনৈতিক দর্শনের কথা আপনাকে আগেই বলেছি। এ বিষয়ে আর নতুন করে ব্যাখ্যা দেয়ার কিছুই নেই। - তাহলে তুমি বলো হোয়াট ওয়াজ দ্য টারনিং পয়েন্ট টু গো ডেসিসিভ এ্যাকশন - বললাম, এ প্রশ্নের উত্তরও আপনার নিশ্চয় জানা আছে। বাংলাদেশের ইতিহাস, শাসন, শোষণ, বঞ্চনা, নিপীড়ন আর রক্ত ঝরার ইতিহাস। ৪৭ এ পার্টিশনের পরেই আমাদের মায়ের ভাষায় কথা বলার দাবি এবং চাপিয়ে দেয়া ভাষা উর্দুকে প্রত্যাখ্যান করার জন্য ৫২ সালে আমাদের গুলি খেয়ে মরতে হয়েছে। তারপর থেকেই রচিত হতে থাকে অবিরাম বঞ্চনা আর রক্তাক্ত নিপীড়নের অধ্যায়। ’৭০ এর নির্বাচনে ক্ষমতা না দিয়ে টালবাহানা করে সময়ক্ষেপণের মধ্য দিয়ে করা হলো পূর্ব বাংলা ম্যাসাকারের ব্লু প্রিন্ট। আর তাই ৭ মার্চ ছিল পাকিস্তানের জন্য আল্টিমেটাম। আমাদের প্রাপ্য দাবি মানলে তোমাদের সঙ্গে আমাদের কোন দফা-রফা নেই। স্বায়ত্তশাসন নিয়ে আমরা আমাদের মতো করেই চলব। স্বাধীনতার দিকে যাব। না মানলে স্বাধীনতার সশস্ত্র যুদ্ধ ছাড়া কোন গতি নেই। সেই চূড়ান্ত দাবি উপেক্ষা করে, এ্যাসেম্বলি বাতিল করে ২৩ মার্চ থেকে যে গণহত্যার সূচনা করা হয়, তখন আর জাতির পিছু ফেরার সুযোগ ছিল না। ২৫ মার্চ রাতের অন্ধকারে হানাদার বাহিনী ঘুমন্ত রাজধানীবাসীর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রাবাসে অসংখ্য ছাত্রসহ দুই লাখ মানুষ হত্যা করে। বাঙালীর আর চুপ করে বসে থাকার সময় ছিল না। বঙ্গবন্ধু চূড়ান্ত স্বাধীনতার ঘোষণা ওয়্যারলেসযোগে পাঠিয়ে দেন। এই বর্বরোচিত গণহত্যা ও স্বাধীনতা ঘোষণার তথ্য ও দলিল । পত্র মার্কিন মুলুকের আর্কাইভেও সংরক্ষিত আছে। আছে পাকিস্তানেও। এসব ইতিহাস নিশ্চয় আপনার অজানা নয়। এখানে আরেকটি বিষয় আমি যোগ করতে চাই। ইতিহাসের এই নারকীয় ও নজিরবিহীন গণহত্যা দিবস ২৫ মার্চকে জাতি গণহত্যা দিবস হিসেবে পালন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পার্লামেন্ট। এখন দিবসটি আন্তর্জাতিকভাবে পালনের স্বীকৃতি লাভের জন্য আমরা কাজ শুরু করেছি। ২১ ফেব্রুয়ারিকে আমরা আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে উদযাপনের স্বীকৃতি লাভ করেছি। আমাদের এ দাবি সমর্থনেও সভ্য দেশগুলো এগিয়ে আসবে বলে আমরা আশাবাদী। - তাহলে বোঝা যাচ্ছে, পাকিস্তানের প্রতি তোমাদের ঘৃণা বেড়েই চলছে? - আপনি জানেন, পৃথিবীর কোন সভ্য মানুষ অপরাধীকে যেমন ক্ষমা করতে পারে না তেমনি তাকে ভালও বাসতে পারে না।, যতক্ষণ পর্যন্ত না সে নিজের অপরাধ স্বীকার করেছে। অপরাধী স্বীকার তো দূরে থাক, উল্টো পাকিস্তান বাংলাদেশের এই গণহত্যার ঘটনাকে অস্বীকার এবং ডাহা মিথ্যাচার বলেই চালিয়ে আসছে। উপরন্তু জঙ্গী লেলিয়ে দিয়ে বাংলাদেশকে ধ্বংসের সুদূরপ্রসারী তৎপরতা চারিয়েই যাচ্ছে। পাকিস্তানের এই ধৃষ্টতা ও ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের নিয়তকে ঘৃণা না করে কিভাবে ভাল বাসবে? - আপনি কাশ্মীর ও বেলুচিস্তানের স্বাধীনতা প্রসঙ্গে বলেছেন, এক ঘরে দুই ভাইয়ের মধ্যে ছোট ভাইকে সব দিক থেকে বঞ্চিত করা হলে তার আলাদা ছাড়া আর কোন গতি থাকে না। তাহলে আপনার এই ডক্টরিন বাংলাদেশের বেলায়ও কি প্রযোজ্য নয়। - ঠিক আছে, সব কিছুই আমি শুনেছি অনেক জুলুম চলেছে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের ওপর। তবে এর জন্য মূলত সেনাবাহিনী এবং ভুট্টোই দায়ী। এটা আমি স্বীকার করছি। আমি কখনও বাংলাদেশে যাইনি। যাবার খুব ইচ্ছা হয়। তবে শুনেছি পাকিস্তানে প্রতি মানুষের নাকি ভয়ঙ্কর ঘৃণা। আর এটা সত্যি,... শুনেছি ঢাকায় নাকি ইয়াহিয়া, ভুট্টো ও টিক্কা খানের নামে টয়লেটের নাম রাখা হয়েছে? - এই প্রশ্নটা শোনার সঙ্গে সঙ্গেই আমি যেন মিরাকল ঘটার মতো ঘৃণা প্রকাশের দৈবাত একটি অচিন্তনীয় মোক্ষম সূত্র পেয়ে গেলাম। ভাবলাম, এ তথ্য নিশ্চয় সে কোন মহান দেশপ্রেমিক সন্তানের কাছ থেকেই পেয়েছে। নিশ্চয় খোকন রাজাকার কাছ থেকে নয়। সে নিজেই স্বীকার করেছে, স্থানীয় বাঙালীরা পাকিস্তানী বলে তার সঙ্গে মিশতে চায় না। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কোন সাচ্চা সৈনিকের কাছ থেকেই সে এই তথ্যটি পেয়েছে নিশ্চয়। তাই আমি চটজলদি তার পক্ষে অবস্থান নিয়েই বললাম। - হ্যাঁ, বিষয়টি সত্য এটা কেবল ঢাকায় শুরু হয়েছে। গোটা বাংলাদেশেই এটি করার পরিকল্পনা রয়েছে। শুধু তাই নয়, আপনি জানেন, সুইডেনের কালমার শহরে স্থাপিত রক্তপিপাসু অত্যাচারী রাজার আবক্ষ মূর্তির প্রতি সুইডিশরা প্রতিদিন থুতু ও জুতা নিক্ষেপ এবং প্রস্রাব করে যে ঘৃণা প্রকাশ করে, ঠিক তেমন কাজ ইতোমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে বাংলাদেশে পাঁচ বছর আগেই। এই প্রকল্পটির ধারণা পত্রিকার মাধ্যমে আমিই প্রকাশ করেছিলাম। এই ঘৃণাস্তম্ভ এবং সব যুদ্ধাপরাধীর নামে ইউনিয়ন পর্যায় পর্যন্ত টয়লেট নির্মাণের জোর দাবি আমরা মুক্তিযুদ্ধের সন্তানরা জানিয়ে আসছি। আমরা আমাদের এই প্রকল্প দেশব্যাপী বাস্তবায়ন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি। প্রয়োজনে জনগণ নিজেদের অর্থ ব্যয় করে হলেও তা করবে। তাহলে কি শেখ হাসিনা শেখ সাবের মতোই ট্রিম্যান্ডাসলি পপুলার? আমার তো মনে হয় তার পপুলারিটিকে শেখ হাসিনা ছুঁয়ে গেছেন এবং তিনি যতদিন বেঁচে থাকবেন অথবা নাই থাকেন, এটা বৃদ্ধি পেতেই থাকবে। জাতি তাকে ইতোমধ্যেই দেশরত্ন উপাধি দিয়েছে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন আমাদের জাতির পিতা। তারই সুযোগ্য কন্যা শেখ হাসিনা এখন জাতির পরম শ্রদ্ধা ও ভালবাসায় হয়ে গেছেন ল্যান্ডস মাদার। বুঝলেন কিছু? - ওয়াও, ওভারহোয়েল্মিং! - আনডাউটেডলি সি ইজ নাউ আওয়ার ল্যান্ডস আইকোন। (সমাপ্ত) লেখক : সুইডেন প্রবাসী সাংবাদিক
×