ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

অকাল বন্যা ॥ ‘ছোট ছোট দুঃখ’ নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সিলেটে

প্রকাশিত: ০৩:৩৪, ৭ এপ্রিল ২০১৭

অকাল বন্যা ॥ ‘ছোট ছোট দুঃখ’ নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও সিলেটে

বড় বড় দুঃখের খবর আমরা জানি। বস্তুত দৈনিক কাগজভর্তি থাকে বড় বড় দুঃখের খবরে। যানজট, ঢাকা শহরের যানজট একটি বড় দুঃখের খবর। ‘মিডিয়া’ একে নিয়ে সরকারকে দোষারোপ করে কতভাবে। এ ধরনের বড় বড় দুঃখ নিয়ে কত স্টোরি হচ্ছে প্রতিদিন। কত সেমিনার, ওয়ার্কশপ, ‘টকশো’ হচ্ছে। কিন্তু পাশাপাশি ছোট ছোট দুঃখের খবর কী খবরের কাগজে সেভাবে স্থান পাচ্ছে? আমি নিশ্চিত নই। বলি, একটি ছোট্ট দুঃখের কথা। আমার এক বন্ধুর অফিসে বসে চা খাচ্ছি। আর কিছুক্ষণ থাকলে ও আমাকে ভাল ‘লাঞ্চ’ খাওয়াবে বলে লোভ দেখিয়েছে। কিন্তু সেটা সম্ভব নয় শারীরিক কারণে। হচ্ছে মৃদু রাজনীতি আর খোশগল্প। এতে এসে জল ঢেলে দিল তার ড্রাইভার। পাঁচ হাজার টাকা ধার দিতে হবে। বন্ধুটির গলা চড়া। তুমি আগের ধারই পরিশোধ করতে পারনি, আবার ধার। কোন জওয়াব নেই ড্রাইভারের মুখে। বলল, স্যার বড় বিপদে আছি। আমার জমি অকাল জলের তোড়ে ডুবে গেছে। কোথাকার লোক সে? প্রশ্ন করে জানতে পারলাম ড্রাইভারের বাড়ি হালুয়াঘাট অঞ্চলে। শুধু তার নয়, আশপাশের গ্রামের লোকের জমিরও একই অবস্থা। একটু নিচু জমি যাদের তাদের বোরো এবার গেছে। ড্রাইভারের অর্ধেকের বেশি জমির ফসল তলিয়ে গেছে। এতে তার ক্ষতি কী? সে জমি তার বাপের, তাতে দুই ভাইয়ের ভাগ। এক ভাগে ও ধান পেত ৩০ মণ। এতে তার বছরের চাল হয়ে যেত। ঢাকায় বাসাÑ মা, স্ত্রী ও একটি পুত্র এই ধানে তার সংসার চালানো পুষিয়ে যেত। যে বেতন তা দিয়ে বাসা ভাড়া ও দৈনন্দিন খরচ চলে যেত। ইদানীং আবার খরচ বেড়েছে পুত্রের জন্য। ছেলেকে সে স্কুলে ভর্তি করেছে। এখন ‘যোগ’ হচ্ছে কোচিং খরচ। অকাল বন্যায় বা আগাম বন্যায় সে এখন চোখেমুখে অন্ধকার দেখছে। যে বোরো নষ্ট হয়েছে তা আর করা যাবে না করতে হবে আগামী বছর। এখন তার দুশ্চিন্তা চালের খরচ বাড়বে। আগের ঋণ শোধ করতে হবে। ছোট বোনের স্বামী হাসপাতালে। তাকে সাহায্য করতে হয়। ছেলেটির এই মুহূর্তে জ্বরÑ ঘরে ঘরে জ্বর। ডাক্তার-ওষুধ খরচও হাজার টাকার ওপর। বৃদ্ধা মাতার ‘আর্থ্রাইটিস’। এমতাবস্থায় আবার ঋণের আবদার মালিকের কাছে। বন্ধুটি গাল-মন্দ করে ড্রাইভারকে ৫ হাজার টাকা দিয়ে দিল। সমস্ত ঘটনার সাক্ষী আমি। সাক্ষী ছোট দুঃখটির। এই দুঃখ কী ব্যতিক্রমী কোন দুঃখ, অস্বাভাবিক কোন দুঃখ? এই দুঃখ কী শুধু হালুয়াঘাটের ড্রাইভারের? না, অনুমান করতে অসুবিধে নেই এই ছোট ছোট দুঃখের খবরে ভর্তি হচ্ছে খবরের কাগজ। একটি কাগজে দেখলাম এক কলামের ছোট একটি খবর। এর শিরোনাম : ‘আগাম বন্যায় পানির নিচে বোরো’। বলা বাহুল্য, এখন চৈত্র মাস। ইংরেজী এপ্রিল। ১৪ এপ্রিল আমাদের পহেলা বৈশাখ, শুভ নববর্ষ। এই সময় আবার ‘বোরো’ ফসল তোলার সময়। যারা আগে বোরো লাগিয়েছেন তাদেরটা এখন পেকেছে, কোথাও কোথাও আধাপাকা ধান। দুইদিন পর শুরু হবে পুরো ফসল তোলার উৎসব। ঢাকার রিক্সওয়ালারা প্রস্তুতি নিচ্ছে ‘দেশে’ যাওয়া। উত্তরাঞ্চল, শেরপুর, জামালপুর, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জসহ দেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের প্রচুরসংখ্যক রিক্সাওয়ালা ‘দেশ’Ñঢাকা করে। ফসলের সময় ‘দেশে’, তোলার সময় ‘দেশে’, বাকি সময় ঢাকায়- কিছু ‘ক্যাশ’ সংগ্রহের সংগ্রামে। সবারই চোখে-মুখে হাসি। ফসল আসছে। তিন-চার-পাঁচ মাসের কষ্টের ফসল, পরিশ্রমের ফসল। কারও জন্য সারা বছরের খাবার, কারও জন্য বেশতি কয়টা টাকা, কারও জন্য সঞ্চয়ের মাধ্যম। এই সময়েই আসছে দুঃসংবাদ। ছোট দুঃখের সংবাদ। বড় বন্যা নয়। সময়ের বন্যা নয়। অকাল জলের তোড়, অকাল বন্যা। ওপর থেকে নামছে পাহাড়ী ঢল, অসম অঞ্চল থেকে। ভেসে যাচ্ছে নেত্রকোনার কেন্দুয়া অঞ্চলের গ্রামাঞ্চল, ফসলি জমি। মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরি, নাসিরনগর, অষ্টগ্রাম, মিঠামইন, ইটনা, করিমগঞ্জ ও নিকলীর বিস্তীর্ণ অঞ্চলের অনেক জমি এখন জলের তলে। নেত্রকোনার মোহনগঞ্জের কংস নদীর সøুইসগেট ভেঙ্গেছে। একই জেলার মদন, মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরি, কলমাকান্দা, দুর্গাপুর ও পূর্বধলার অনেক জমি প্রবল বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে ডুবে গেছে। ঢাকায় বৃষ্টি নেই। কিন্তু ওইসব অঞ্চলে বৃষ্টি আর বৃষ্টি বলে খবর আসছে। নাসিরনগরের জমিও জলের তলায়। জলের ঢল আসছে হবিগঞ্জ থেকে। মদন উপজেলার কৃষকদের মধ্যে আহাজারি শুরু হয়েছে বলে খবর আসছে। কৃষি দফতরের কর্মকর্তারা ধানের ক্ষতির হিসাব দিচ্ছেন। এতে বিশাল ও অভূতপূর্ব ক্ষতি হয়েছে তা নয়। কিন্তু যার ক্ষতি তার জন্য সেটা শতভাগ ক্ষতি। জাতি ও দেশ হিসেবে বর্তমান বন্যায় যে ক্ষতি এখন হলো তা হয়ত আমরা পুষিয়ে নেব; কিন্তু যে ক্ষুদ্র ও মাঝারি চাষী, বর্গাচাষীরা ক্ষতিগ্রস্ত হলো তাদের কী হবে? যে দোকানদার, ড্রাইভার, দোকান কর্মচারী, পিয়ন-চাপরাশি জাতীয় লোকেরা তাদের ফসল হারাল তারা তাদের ক্ষতি কীভাবে পুষিয়ে উঠবে? তাদের এই ছোট ছোট দুঃখের খবরে আমরাইবা কতটুকু ব্যথিত? সবচেয়ে বড় কথা, অনেকে আমরা হয়ত জানিই না এই দুঃখের কথা। বড় বড় দুঃখে আমরা কাতর। কিন্তু ছোট ছোট দুঃখ যে এক, দুই, তিন করে শত হচ্ছে, হাজার হচ্ছে, লাখ হচ্ছে তার খবর কী আমাদের আছে? আমার মনে হয় সেভাবে নেই। অথচ সারাদেশে নানাভাবে, নানা কারণে, নানা সময়ে লাখ লাখ ছোট ছোট দুঃখের জন্ম হচ্ছে। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন অসহায় লোক। সৃষ্টি হচ্ছে নতুন নতুন ভূমিহীন লোক। কেউ কেউ চাকরি হারাচ্ছে মধ্য বয়সে। কে কার খবর রাখে? রাখা কী সম্ভব? একমাত্র পুত্রকে অসময়ে হারিয়ে এক বিধবা হয়েছেন পথের ভিখারীÑ এই দুঃখ কী আমাদের পীড়িত করে? লাখো কোটি টাকার বাজেটে কী তার কথা থাকে বা থাকবে আগামী দিনে? একজন দোকান কর্মচারী যে হাজার টাকার অভাবে তার বাচ্চার ওষুধ কিনতে পারছে না এই ছোট্ট দুঃখ কী খবরের কাগজের খবর হয়? হয়ত হয়, হয়ত হয় না। বাসাবাড়ির বুয়া চার জায়গায় কাজ করে, খায় আর কিছু টাকা জমাবার চেষ্টা করেÑ সামনে মেয়ের বিয়ে। বুয়া রোগেশোকে বিছানায় দুই মাস, তার স্বামী চিররোগী। বাসার মালিকরা কী তাকে ভরণপোষণ করবে? আমি নিশ্চিত নই। বস্তুত সারাদেশের লাখো কোটি লোক ছোট ছোট আর্থিক দুঃখে ভারাক্রান্ত। এরা একবার দারিদ্র্যসীমার উপরে ওঠে। দুই বেলা খায়। কিন্তু পরক্ষণেই দরিদ্র হয়। কারণ, ক্ষেতের ধান নষ্ট হয়, ফসল নষ্ট হয়Ñ খরায় ও বন্যায়। অনেকদিন উপেক্ষা করে, আধা উপোসে দিন কাটায়। এই সংসারে যারা পারে তারা আসে ঢাকায়। ধরে রিক্সা। কিছু ‘ক্যাশ’ উপার্জন করে। সেই টাকায় ধারদেনা শোধ করে, বন্ধকী জমি মহাজনের কাছ থেকে ছুটিয়ে আনে। কিছুদিন ভাল থাকে। একটু ‘সুখ’ পায় জীবনে। হয়ত আবার সে দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে যায়। মেয়ের বিয়ে, তালাকপ্রাপ্ত মেয়ের ভরণপোষণ, বৃদ্ধ পিতা-মাতার দেখাশোনা, হঠাৎ অসুস্থতা, বড় অসুস্থতা মানুষকে প্রতিদিন নতুন নতুন বিপদে ফেলছে। কামার, কুমার, তাঁতি, জেলে, মাঝি ও দিনমজুরের ছোট ছোট দুঃখের খবর কে রাখে? নদী নেই, নদীতে জল নেই। নদী এখন কৃষি জমি। মাছ নেই। মাছ ধরার জালও নেই। অথচ এই জেলের তো অন্য জীবন হচ্ছে না। নতুন নতুন টেকনোলজি, তাও আবার কৃষিতে এই প্রৌঢ় জেলেকে করছে বেকার। জেলের ছেলে তরুণ জেলে হয়ত খুঁজছে জীবিকা। কিন্তু বাবাকে কে খাওয়াবে? বাবার রোগশোক আছে। তার খরচ কে মেটাবে? ঘরে রয়েছে ছোট বোন। তার বিয়ের ব্যবস্থা কী? একটা বিয়েতে এখন অনেক খরচ। পঞ্চাশজন লোককে খাওয়াতেই বিশাল খরচ। কিছু সোনার দরকার হয়। অনেক বর সাইকেল চায়, ক্ষেত্র বিশেষে মোটরসাইকেল চায়। লক্ষাধিক টাকা দিয়ে বিয়ের কাজ সারতে হয়। এমনিতেই সংসার চলে না। চারদিকে ধারদেনা। তার ওপর ছোট বোনের বিয়ের খরচ; এই টাকা কে জোগাবে? আজকাল চালু হয়েছে ‘বাকিতে বিয়ে’। অর্থাৎ সাইকেল দেয়ার কথা, এখন দেয়া যাচ্ছে না। এক বছর, ছয় মাস পরে দেয়া হবে। কিন্তু এখানে বড় একটা অসুবিধা। দিতে ব্যর্থ হলে জুলুম হবে মেয়েটির ওপর। ফেরত পাঠিয়ে দেবে বাপের বাড়ি। তাকে কে দেখবে? ও ‘দেশের’ বাড়িতে কী কাজ করবে? কী কাজ আছে ‘দেশে’। আগে ‘গার্মেন্টসে’ চাকরি হতো। এখন শোনা যাচ্ছে ‘গার্মেন্টসে’ চাকরির সুযোগ হ্রাস পেয়েছে গত তিন বছরে। এই খাতে নতুন চাকরির কোন সুযোগ সৃষ্টি হয়নি। এই সেলাই কারখানায় বসছে আধুনিক মেশিন, তাই লোকের দরকার নেই, বসছে ‘রোবট’Ñ নারী শ্রমিক আর দরকার নেই। কৃষিতেও একই অবস্থাÑ ফসল লাগানো, ফসল তোলা, নিড়ানি, কীটনাশক দেয়া, ধান ভানা ইত্যাদি প্রায় সকল কাজেই এখন মেশিন-যন্ত্র। ছোট ছোট দুঃখীরা কোথায় যাবে? যার জমির ফসল অকাল বন্যায় নষ্ট হলো, বোরো ঘরে তুলতে পারল নাÑ ও এখন কী খাবে, কী পরবে? ছেলে-মেয়ের কী হবে? ফসলের জন্য তো কোন বীমা নেই। কত কথা শুনলাম এতদিন ধরে, কত বক্তৃতা শুনলাম, কত অঙ্গীকার করা হলো। কিন্তু বীমা, ফসল বীমার খবর কী? না, কোন খবর নেই। থাকলে এ ছোট ছোট দুঃখীদের একটা ব্যবস্থা হতো। না, তা নেই। এমতাবস্থায় কী ব্যবস্থা হবে? ‘দেশে’ কী কর্মসংস্থানের কোন ব্যবস্থা আছে? সবাই তো বলে ‘দেশে’ কাজের লোক পাওয়া যায় না। শ্রমের মজুরি মাত্রাতিরিক্ত। তাহলেই প্রশ্ন, দলে দলে ঢাকায় লোক এসে রিক্সা ধরে কেন? রিক্সা চালনা কী কষ্টের কাজ তা গ্রামের লোকেরাও বোঝে। জমির কাজ আর রিক্সা চালনার কাজের মধ্যে অনেক তফাৎ। অবস্থার বিপাকে পড়ে সে রিক্সা ধরে। এক মাস কাজ করে, এক মাস বিশ্রাম করে। এর জন্যই সে ঢাকায় আসে তাই কী মনে হয়? গ্রামাঞ্চলে কাজ থাকলে সে কী ঢাকায় এসে রিক্সা ধরত? উত্তরটা খোঁজা দরকার। দেখা যায় ফসলের সময়, কাজের সময় তারা গ্রামে চলে যায়। শেষ হলে আবার চলে আসে। এই মুহূর্তে ঢাকার রিক্সাওয়ালাদের অনেকেই গ্রামে যাচ্ছে, ‘দেশে’ যাচ্ছে। এখন বোরো ওঠার সময়। তাই তারা ‘দেশে’ যাচ্ছে। এমতাবস্থায় ছোট ছোট দুঃখ নিয়ে যাদের সংসার তাদের জন্য কী করা দরকার- সেটা ভাবা দরকার সরকারের। লেখক : সাবেক শিক্ষক, ঢাবি
×