ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

নাগরিক বিড়ম্বনা

অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি, সামান্য বৃষ্টিতে হাঁটাপথও থাকে না

প্রকাশিত: ০৫:৫৮, ৬ এপ্রিল ২০১৭

অপরিকল্পিত খোঁড়াখুঁড়ি, সামান্য বৃষ্টিতে হাঁটাপথও থাকে না

আরাফাত মুন্না ॥ সেগুনবাগিচা সিটি কর্পোরেশন কাঁচা মার্কেট হয়ে শিল্পকলা একাডেমি যাওয়ার রাস্তা। এই রাস্তার ঠিক মাঝখানে কয়েক ফুট পর পরই খুঁড়ে রাখা হয়েছে। স্যুয়ারেজ লাইনের কাজ করছে ওয়াসা। খুঁড়ে রাখা মাটিও রাখা হয়েছে সড়কের ওপর। যান চলাচল তো বন্ধই তার ওপর সামান্য বৃষ্টিতে হাঁটার পথটুকুও থাকে না। যাত্রাবাড়ী এলাকায় পয়োনিষ্কাশনের নালা সংস্কার করছে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন। সড়কের বেশিরভাগ অংশ খুঁড়ে ফেলায় চলাচলে ভোগান্তিতে পড়েছে এলাকার বাসিন্দারা। আগারগাঁও থেকে পল্লবী আর লালমাটিয়া থেকে গাবতলী, সড়কে রোদ হোলে ধুলা ঝড়ে দিশেহারা হন পথচারী। বৃষ্টিতে কাদায় মাখামাখি হয়ে ঘরে ফিরতে হয়। স্থানে স্থানে মাটির স্তূপ, গভীর গর্তে ভরা। অভিজাত এলাকা গুলশানও এই দশা থেকে মুক্ত নয়। আর মগবাজার-মৌচাক-মালিবাগ-রামপুরার সড়ক অনেকটাই নালায় পরিণত হয়েছে। কাজ যাই হোক সড়ক খোঁড়াখুঁড়ি চলছেই। রাজধানীতে দুই সিটি কর্পোরেশন ও সেবা সংস্থা মিলে ঢাকার মূল সড়ক ও অলিগলির কম-বেশি তিন শতাধিক স্থানে খোঁড়াখুঁড়ি চালাচ্ছে। সামান্য বৃষ্টিতেই এসব সড়ক চলাচলের অনুপযোগী হয়ে ওঠে। প্রতিদিনই এসব সড়কে যানজট থাকে দীর্ঘ। সংস্থাগুলো সড়ক খননের নিয়মনীতি না মানায় নগরবাসীর ভোগান্তি বেড়েছে বহু গুণ। নিয়মানুযায়ী সিটি কর্পোরেশন ছাড়া অন্য কোন সংস্থা তাদের সংযোগ লাইন স্থাপন করতে ক্ষতিপূরণ কিংবা মেরামত করে দেয়ার শর্তে রাস্তা কাটতে পারবে। রাস্তা কাটার অনুমোদন পাওয়ার ২৮ দিনের মধ্যে তা মেরামত বা সংস্কার করে দিতে হবে। জনদুর্ভোগ হয় এমন সময় সড়ক খোঁড়া যাবে না। প্রধান সড়কগুলোতে সরকারী ছুটির দিন এবং রাতে কাজ করার নির্দেশ থাকে। তবে সেবা সংস্থাগুলোর অধিকাংশই সিটি কর্পোরেশনের কোন অনুমতি না নিয়েই যত্রতত্র রাস্তা কেটে রাখছে। অথচ কোন রাস্তা কাটার প্রয়োজন হলে সিটি কর্পোরেশনকে অন্তত ছয় মাস আগে অবহিত করতে হয়। দিনের পর দিন খোঁড়া সড়ক পড়ে থাকলেও তা মেরামত করা হচ্ছে না। এ দায়-দায়িত্বও কেউ নিতে চায় না। ফলে দিনের পর দিন অবহেলায় পড়ে থাকছে রাজধানীর সড়কগুলো। সরেজমিনে দেখা গেছে, টেকনিক্যাল মোড় থেকে মাজার রোডের পুরনো গাবতলী পর্যন্ত এবং পুরাতন গাবতলী অংশ থেকে মিরপুর-১ নম্বর পর্যন্ত অংশে পানি নিষ্কাশনের পাইপ বসাচ্ছে উত্তর সিটি কর্পোরেশন। মাজার রোডের প্রথম কলোনি এলাকায় পাইপ বসানোর নির্মাণসামগ্রী এলোমেলোভাবে সড়কের ওপর রেখে দেয়া হয়েছে। ভাঙা সø্যাব, রড ছড়িয়ে-ছিটিয়ে আছে। ফুটপাতে চলাচলের কোন ব্যবস্থা রাখা হয়নি। স্থানীয় লোকজন বাঁশ ও টিন দিয়ে গর্তের ওপর দিয়ে চলাচল করছে। মিরপুর-১ নম্বরের বাসিন্দা মিজানুর রহমান ঢালী জনকণ্ঠকে বলেন, রাস্তা খুঁড়ে রেখে অনেক দিন ধরেই কাজ চলছে এখানে। কাজ যেন শেষই হয় না। দ্রুত কাজ শেষ করে রাস্তা মেরামত করে দিলে আমাদের ভোগান্তি হতো না। প্রায় ২০০ কোটি টাকা ব্যয়ে ‘গুলশান, বনানী ও বারিধারা কূটনৈতিক এলাকার রাস্তা, নর্দমা ও ফুটপাত নির্মাণ এবং উন্নয়ন’ শীর্ষক প্রকল্পটির কাজ শুরু হয়েছে ২০১৬ সালের ফেব্রুয়ারিতে। প্রকল্পের কাজ শুরুর পর থেকেই গুলশান, বনানী ও বারিধারা এলাকার একেক সড়ক একেক সময় খোঁড়া হচ্ছে। দেখা যায়, গুলশান এলাকার সড়কগুলোতেও ডিএনসিসির ঠিকাদারেরা কোন ধরনের নিরাপত্তাবেষ্টনী ছাড়াই কাজ করছেন। মিরপুর ২ নম্বর থেকে মিরপুর ১০ নম্বর পর্যন্ত সড়কেও একই অবস্থা দেখা গেছে। রিক্সায় বসে থাকা বেসরকারী প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা ওয়াহিদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, রাস্তা খুঁড়লে ধাপে ধাপে ভোগান্তি হয়। কোন নিয়ম না মেনে, জনগণের সুবিধা বিবেচনা না করে রাস্তা খোঁড়াখুঁড়িতে ভোগান্তি বাড়ছে। খোঁড়া শেষে যেনতেনভাবে মাটি ভরাট করায় ধুলাও বাড়ছে, শ্বাস নেয়া যায় না। জানা গেছে, নগরবাসীর সেবা দেয়ার জন্য ঢাকার দুই সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি ও ডিএনসিসি), রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ- রাজউক, ঢাকা ওয়াসা, বিটিসিএল, তিতাস, ডেসা, ডেসকোসহ ২৬টি সংস্থা তাদের বিভিন্ন সেবা সংযোগ স্থাপনের কাজ করে। এসব কাজে সড়ক কাটতে হয়। কিন্তু সেবা সংস্থাগুলো তাদের কাজ শেষ হওয়ার পর কাটা রাস্তা মেরামত করে দেয় না। সিটি কর্পোরেশনের কর্মকর্তারা বলছেন, কোন সড়ক নির্মাণ বা নতুন করে সংস্কার করতে না করতেই অন্যান্য সংস্থা রাস্তা কেটে রাখে। কখনও রাস্তা কাটার আবেদন করে আবার কখনও নিজের মতো করে তারা কাজ শেষ করে রাস্তা খোঁড়া অবস্থায় ফেলে রাখে। এ কারণে ক্ষতিগ্রস্ত সড়কগুলো অনেক সময় সিটি কর্পোরেশনের নজরে আসে না। সরেজমিনে রামপুরা ব্রিজ থেকে মেরাদিয়া হাট, রামপুরা বাজার থেকে মালিবাগ, মালিবাগ-মগবাজার, সিটি কর্পোরেশনের কাঁচা মার্কেট হয়ে শিল্পকলা একাডেমি। এছাড়া রাজধানীর খিলগাঁও, তিলপাপাড়া, বনশ্রী, তালতলা, মেরাদিয়া, বাসাবো, মাদারটেক, পূর্ব রামপুরার ঝিলকানন, হাজীপাড়া, জাকের রোড, কুঞ্জবন, যাত্রাবাড়ী, সায়েদাবাদ, গে-ারিয়া, ইংলিশ রোড, রামকৃষ্ণ মন্দির, বাংলাবাজার, মোহাম্মদপুর, সায়েন্সল্যাব, নিউমার্কেট এলাকা, আজিমপুর ও হাজারীবাগ এলাকার সড়কগুলো বেহাল অবস্থায় আছে। এছাড়া কারওয়ান বাজার, ফার্মগেট, তেজগাঁও শিল্প এলাকা, বাড্ডা, সাতরাস্তা, গুলশান-১ ও ২, বনানী, বারিধারা, মহাখালী, কাজীপাড়া, শেওড়াপাড়া, আগারগাঁও, বিমানবন্দর, উত্তরা, গাবতলী, নিকেতনমুখী লিংক রোড, গুলশান-১ থেকে গুলশান-২ নম্বর গোলচত্বর পর্যন্ত এবং কূটনৈতিক এলাকা খ্যাত বারিধারার প্রধান সড়ক প্রগতি সরণিসহ প্রায় পুরো রাজধানীর অলিগলি থেকে শুরু করে প্রায় সব সড়কই কাটা। সামান্য বৃষ্টিতেই এসব সড়ক থেকে মাটি উঠে গর্তের সৃষ্টি হয়। আস্তে আস্তে ছোট গর্ত থেকে পুরো সড়কই নষ্ট হয়ে পড়েছে। দনিয়া এলাকার অনাবিল হাসপাতালের ম্যানেজার মোহাম্মদ আবুল হোসেন জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের হাসপাতালের সামনের পয়োনিষ্কাশনের নালা সংস্কার করা জন্য দুই মাস আগে খুঁড়ে রেখেছে। এখনও কাজ শেষ হয়নি। বাঁশের তৈরি সাঁকো দিয়ে অনেক কষ্ট করে রোগীরা এখানে আসেন। ফ্লাইওভারের কারণে মগবাজার-মৌচাকে ভোগান্তি ॥ নির্মাণাধীন মগবাজার-মৌচাক ফ্লাইওভারের প্রায় পাঁচ কিলোমিটার এলাকা এখন দুর্ভোগের কেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। এই সড়কে গভীর গর্ত ও কাদা-পানি নিত্য ভোগান্তি। ফ্লাইওভারের নির্মাণকাজ চলছে পূর্ব-পশ্চিমে মগবাজার মোড় থেকে সোজা পথে রাজারবাগ মোড় পর্যন্ত। আর উত্তর দিকে মৌচাক মোড় থেকে মালিবাগ আবুল হোটেল পর্যন্ত। দক্ষিণে মালিবাগ মোড় থেকে শান্তিনগর চৌরাস্তা পর্যন্ত বিস্তৃত। এই তিন ফ্লাইওভারের নির্মাণ কাজ আর নির্মাণ সামগ্রী রাখার পর যানবাহন চলাচলের জন্য দুপাশে দুই লেনের সামান্য সড়কই অবশিষ্ট আছে। ফুটপাথ নেই বললেই চলে। সড়কে সৃষ্টি হয়েছে গভীর গর্তের। কোথাও হাঁটুসম, কোথাও গোড়ালি পর্যন্ত পানি জমে আছে। কিছু স্থানে কাদায় মাখামাখি। এই প্রকল্প এলাকার আশপাশে ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও কলেজ, আবুজর গিফারী বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, সিদ্ধেশ্বরী কলেজসহ বেশকিছু শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। আছে অসংখ্য বিপণিবিতান। মৌচাক মার্কেট ও আয়েশা শপিংমলের সামনের সড়কে হাঁটুসম পানি। রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির বিষয়ে ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের প্রধান প্রকৌশলী ফরাজী শাহাবউদ্দীন আহমেদ বলেন, বিভিন্ন সংস্থার উন্নয়ন কাজের জন্য প্রথমত আঞ্চলিক অফিসগুলো থেকে অনুমোদন দেয়া হয়। বড় বড় কাজের জন্য আমরা নগর ভবন থেকে অনুমোদন নেই। রাস্তা কাটার জন্য শর্তসাপেক্ষে তাদের অনুমোদন দেয়া হয়। নির্ধারিত সময়ের মধ্যে তাদের কাজ শেষ করতে বলা হয়। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা গেছে তারা তা করে না। তিনি আরও বলেন, আসলে আমরা অনেকটা জিম্মি অবস্থায় আছি। তারাও সরকারী সংস্থা। আমাদের অনুরোধ রাখতে চান না। তারা নিজেদের মতো কাজ করে চলে যান। যে কারণে অনেক সময় পুরো রাস্তা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। জনগণের দুর্ভোগ বাড়ে।
×