ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সতেরো শতকের ঐতিহ্যবাহী রঘুনাথ জিউ মন্দির

রামনবমী উৎসব, মনোবাসনা পূরণে ভক্তদের ভিড়

প্রকাশিত: ০৫:৫৬, ৬ এপ্রিল ২০১৭

রামনবমী উৎসব, মনোবাসনা পূরণে ভক্তদের ভিড়

বিশ্বজিৎ মনি ॥ মন্দিরে যাওয়ার কাঁচা অপ্রশস্ত সড়কে সবাই যেন আগে যাবার আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু প্রচ- ভিড়ে তাদের সে চেষ্টা ব্যর্থচেষ্টা ছাড়া ফল হচ্ছে না কিছুই। কতইনা আত্মবিশ্বাস আর ধর্মীয় অনুভূতি নিয়ে মনোবাসনা পূরণের আশায় মানুষ ছুটে যায় সেখানে। সেই সংখ্যা হাজার পেরিয়ে পৌঁছে যায় লাখে । নওগাঁ জেলার মান্দা উপজেলার ঠাকুরমান্দায় শ্রী শ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরে ত্রেতাযুগের অবতার শ্রী রামচন্দ্রের জন্মদিন উপলক্ষে প্রতিবছর এই রামনবমী তিথিতে মন্দিরে অনুষ্ঠিত হয় পূজা ও নানান ধর্মীয় উৎসব। প্রচলিত আছে, রামনবমীর দিনে প্রতিবছর দৃষ্টি ফিরে পায় অনেক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশু। সেই আশায় ছোট্ট শিশু থেকে নানান বয়সের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সারাদিন অবস্থান নেয় মন্দির প্রাঙ্গণে একটি নির্ধারিত স্থানে। শ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরে রামের জন্মদিন উপলক্ষে বন্ধ্যা নারী সন্তান লাভের আশায় মন্দির প্রাঙ্গণে আঁচল বিছিয়ে মনোবাসনার প্রার্থনা করে দিনভর। প্রায় তিন শ’ বছরের প্রাচীন মন্দিরটির প্রতিষ্ঠার ইতিহাসের কোন দলিল নেই। আছে প্রচলিত লোকমুখের ইতিহাস। সবই আজ প্রতিষ্ঠিত আত্মবিশ্বাসী ভক্তদের অন্তরে। প্রত্যন্ত ওই পল্লীতে মাটির এবড়ো-থেবড়ো পথ ও মাঝে শিব নদীর ওপর বাঁশের সেঁতু পেরিয়ে হিন্দু নারী-পুরুষ ভক্তরা যান মন্দিরে পুণ্য লাভের আশায়। যাওয়ার সড়কটি আজও রয়ে গেছে কাঁচা। মাঝে শিব নদীর ওপর নির্মিত হয়নি ব্রিজ। চরম অসুবিধার মধ্য দিয়ে মন্দিরে যাতায়াত করেন তীর্থযাত্রীরা। ঐতিহাসিক প্রতœতত্ত্ব নিদর্শনে সমৃদ্ধ উত্তরের নওগাঁ জেলার অন্যতম পুণ্যভূমি স্থাপত্যের মধ্যে মান্দা উপজেলার ঠাকুরমান্দা শ্রীশ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরটি প্রায় তিন শ’ বছর ধরে কালের সাক্ষী হয়ে আছে। সতেরো শতকের অন্যতম স্থাপত্যের মধ্যে এটি একটি। এখনও চৈত্র মাসের নবমী তিথিতে রামনবমী উৎসবে ১৫দিন ধরে চলে নানা ধর্মীয় উৎসব ও মেলা। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের এটি একটি অন্যতম তীর্থস্থান হিসেবেও ব্যাপক পরিচিতি রয়েছে ভারত উপমহাদেশে। বাসন্তী পুজোর শুরু তথা ষষ্ঠি থেকে নবমী এবং এর ৯দিন পর লক্ষণভোজের মাধ্যমে একটানা ১৫ দিন ধর্মীয় উৎসব চলে মহা ধুমধামের মধ্যদিয়ে। এই উৎসবে বিশেষ করে রামনবমী উৎসবে বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলার ভক্তবৃন্দ ছাড়াও ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল থেকেও ভক্তরা আসেন ঠাকুর দর্শনে ও তাদের মানত দিতে। হাজার হাজার নারী-পুরুষ ভক্তের পদচারণায় মুখরিত হয়ে ওঠে মন্দিরের চারপাশে প্রায় ১ কিমি এলাকাজুড়ে। শত শত বাস, মাইক্রোবাস, জীপ আর হাজার হাজার ভ্যান ও ভটভটিতে চড়ে ভক্তরা আসেন এই রঘুনাথ মন্দিরে। মন্দির থেকে কমপক্ষে দেড় কিমি দূরে রাখতে হয় এসব যানবাহন। ভক্ত-দর্শনার্থীর ভিড়ে প্রাচীন এই মন্দিরটি মুখরিত হয়ে ওঠে এই তিথিতে। এবারেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি। বুধবার ছিল রামনবমী উৎসব। নওগাঁ জেলা শহর থেকে ৪০কিমি পশ্চিমে মান্দা উপজেলার এই ঠাকুর মান্দা গ্রামের অবস্থান। এক সময় এই মন্দিরের চারধারে বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে ছিল শুধু বিল। মন্দিরের পূর্বপাশ দিয়ে বয়ে গেছে শিব নদী। এক সময় এটি ছিল স্রোতস্বিনী। এই নদীতে ভক্ত-দর্শনার্থীরা ¯œান করে ভেজা কাপড়ে পাশের বিল থেকে পদ্মের পাতা তুলে মাথায় দিয়ে মন্দিরে যেত ঠাকুর দর্শনে। এখনও কিছুটা হলেও ভক্তরা সেই রীতিনীতি মেনে চলার চেষ্টা করেন। নদী এবং বিলে পানি না থাকলেও ভক্তরা মন্দির সংলগ্ন পুকুরে ¯œান করে ভেজা কাপড়ে কেউ কেউ আবার দুর্লভ পদ্মপাতা সংগ্রহ করে তা মাথায় দিয়ে তার ওপর মাটির পাতিল বোঝাই ভোগের মিষ্টান্ন নিয়ে দীর্ঘ লাইন ধরে প্রভুর চরণে নিবেদন করে থাকেন। কেউ কেউ এক সপ্তাহ ধরে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী মাঠেই আস্তানা গাড়ে। সেখানেই রান্না করে খেয়ে সেখানেই অবস্থান করে। ভক্তবৃন্দকে ধর্মীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ করতে কমিটির লোকজন সেখানে পদাবলী কীর্তনের আসর বসিয়ে থাকেন প্রতিবছর। নিজস্ব স্বেচ্ছাসেবীর পাশাপাশি পর্যাপ্ত পুলিশী নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার থাকে। তবে এবারের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ছিল চোখে পড়ার মতো। প্রবীণদের সঙ্গে কথা বলে এবং বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যায়, ১৭৮০ সালে নাটোরের রানী ভবানী মান্দার এই রঘুনাথ মন্দির নির্মাণ করেন। এর গঠন পিরামিডাকৃতির। মন্দিরের সম্মুখে ডরিক স্তম্ভবিশিষ্ট অর্ধবৃত্তাকার বারান্দা আছে। মন্দিরটি সপ্তদশ শতকের হলেও এর অভ্যন্তরে স্থাপিত বিগ্রহগুলো অনেক পুরনো। বিগ্রহগুলো প্রাপ্তির বিষয় নিয়ে ভিন্নমত রয়েছে। কেউ বলেন, মান্দার বিল খননকালে রাম, লক্ষণ, সীতা ও রামভক্ত হনুমানের বিগ্রহগুলো পেয়ে ওই মন্দিরে স্থাপন করা হয়। আবার কিংবদন্তি রয়েছে, ওই গ্রামে বাস করতেন দরিদ্র এক অন্ধ ব্রাহ্মণ। তিনি অতীব রামভক্ত ছিলেন। একদিন তিনি বিলে ¯œান করতে যান। সেখানে ¯œানে নামলে বিগ্রহগুলো বিলের জলে ভাসতে ভাসতে এসে তার শরীরে স্পর্শ হয়। তখন তিনি প্রণাম করে মূর্তিগুলো মাথায় ও কোলে নিয়ে বাড়িতে নিয়ে স্থাপন করেন। সেখানে প্রতিদিন ৩ বেলা পুজো অর্চনা করতে শুরু করেন। এক পর্যায় তিনি দৃষ্টি ফিরে পান এবং সাংসারিক সচ্ছলতা ফিরে পান। তখন থেকেই রঘুনাথের মাহাত্মের কথা চারদিকে প্রচার হতে থাকে। বাড়তে থাকে ভক্তদের ভিড়। এক পর্যায় প্রভুর মাহাত্মের কথা পৌঁছে নাটোরের রানী ভবানীর কানে। তিনি ঠাকুর মান্দায় পৌঁছে মন্দিরের জীর্ণতা দেখে নিজেই মন্দির তৈরি করে দেন। সেই প্রাচীনকাল থেকে এখনও প্রতিবছর জন্মান্ধ শিশুদের শুয়ে রাখা হয় মন্দিরের সামনে। মানত করা হয়, স্বর্ণের চোখ ও নানা রকম ভোগরাগ। যাদের চোখ ভাল হয় বা দৃষ্টি ফিরে পায় তারা প্রতিবছর এসব মানত দিয়ে থাকে। অন্ধ তথা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের মন্দিরের সামনে শুয়ে রাখার পর অনেক শিশুর চোখ ভাল হয়ে যায় বলে স্থানীয় লোকজন জানায়। মানত দিতে আসা ভক্তরাও ঠিক এমন কথাই বলেছেন। মঙ্গলবার ছিল মহাঅষ্টমীর ¯œান। ভক্তরা এই ¯œান সেরে বুধবার রামনবমী উৎসবে ঠাকুর দর্শনে মেতে ওঠেন। এই দিনটিই ভক্তদের মানত দেয়ার দিন। এদিনই অন্ধ শিশুদের কেউ কেউ দৃষ্টি ফিরে পায়। যেসব গৃহবধূ মা হতে চেয়েও পারছেন না, তারাও মন্দিরের সামনে ¯œান করে ভেজা কাপড়ে আঁচল পেতে মাটিতে বসে সন্তানের জন্য মানত করে থাকেন। যাদের মনোবাসনা পূর্ণ হয় তারা পরবর্তীতে সন্তান কোলে নিয়ে মানত দিতে আসেন। এসব ক্ষেত্রে শুধু হিন্দু নয়, অনেক মুসলিম পরিবারের লোকজনকেও দেখা যায় সেখানে মানত দিতে। ঠাকুর মান্দা রঘুনাথ জিউ মন্দির কমিটি সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে চন্দন কুমার মৈত্র ও সত্যেন্দ্র নাথ প্রামানিক বলেন, ইতিহাস প্রসিদ্ধ অলৌকিক মাহাত্ম সংবলিত ঠাকুর মান্দায় শ্রীশ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরে মঙ্গলবার বিকেল ৩টা ৩২ মিনিট ১৭ সেকেন্ডের পর থেকে বুধবার বেলা ১টা ৩৯ মিনিট ২১ সেকেন্ড পর্যন্ত নবমী উৎসব। এই সময়ে শ্রীশ্রী রামচন্দ্রের জন্ম উৎসব হিসেবে নানা ধর্মীয় আঙ্গিকে প্রতিবছর এখানে উৎসব পালিত হয়ে আসে। এটি হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম বলে জানান তারা। তাদের মতে এই মন্দিরে সকল ধর্মবর্ণের মানুষ নানা মানত করে এবং সুফলও পেয়ে থাকেন অনেকেই। নটোরের গুরুদাসপুর থেকে এসেছিলেন মীরা ও রমেন দম্পতি। তারা আশা করছেন এবার হয়ত তাদের মনোবাসনা পূরণ হবে।। গতবারও তারা এসেছিলেন বলে জানালেন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে এসেছিলেন নিখিল সাহা। তিনি জানালেন, প্রতিবছর আসেন তিনি এই মন্দিরে। মানসা করেছেন। এবারও সে জন্যই এসেছেন। নওগাঁ-রাজশাহী মহাসড়কের গোবিন্দপুরের মোড় থেকে মন্দিরটির দূরত্ব প্রায় ৬ কিমি। মাঝে আছে শিব নদী। সড়কটির প্রায় ৪ কিমি কাঁচা। বর্ষা মৌসুমে মন্দিরে যাওয়া-আসা কঠিন হয়ে দাঁড়ায় বলে জানালেন তীর্থযাত্রী পরিমল শীল। তাদের আশা, বর্তমান সরকারের সময়ই নির্মিত হবে প্রাচীন ওই মন্দিরে যাওয়ার সড়ক ও সেতুটি। অপরদিকে মহাদেবপুর উপজেলা সদরের কেন্দ্রীয় শ্রী শ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরে ৩২ প্রহর, কুঞ্জবন শ্রীশ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরে ২৪ প্রহর এবং বাগডোব শ্রীশ্রী রঘুনাথ জিউ মন্দিরে অষ্ট প্রহরব্যাপী বিরতিহীনভাবে লীলা ও সংকীর্তন শুরু হয়েছে। ওসব মন্দিরে ভারত ও বাংলাদেশের কয়েকটি জেলা থেকে আগত ১৬ নারী ও পুরুষ সমন্বয়ে গঠিত কীর্তনিয়া দল পর্যায়ক্রমে নাম ও সংকীর্তন শুরু করেছে। এসব মন্দিরে পুণ্যের আশায় দেশের বিভিন্ন জেলা এবং পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত থেকে সনাতন ধর্মাবলম্বী হাজার হাজার নারী ও পুরুষ ভক্ত যোগ দেয়। মন্দিরে আগত ভক্তবৃন্দের জন্য বিনামূল্যে থাকা ও খাবার হিসেবে প্রসাদ বিতরণ ব্যবস্থা মন্দির কমিটির পক্ষ থেকে বিগত প্রায় ১শ’ বছরের ঐতিহ্য বহাল থাকছে এবারও। একই সঙ্গে ওই সব মন্দির এলাকায় এ তিথি উপলক্ষে ৪ দিনব্যাপী মেলার আয়োজন করা হয়েছে।
×