ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

দিল্লী যাচ্ছেন মমতা, তিস্তা নিয়ে কোন চমক হবে কি?

প্রকাশিত: ০৫:৫৩, ৬ এপ্রিল ২০১৭

দিল্লী যাচ্ছেন মমতা, তিস্তা নিয়ে কোন চমক হবে কি?

কূটনৈতিক রিপোর্টার ॥ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন দিল্লী সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তি নিয়ে পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যয়ের সঙ্গে আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছে দিল্লী। ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী এ নিয়ে মমতার সঙ্গে মধ্যস্থতাও করছেন। প্রণব মুখার্জীর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে দিল্লীও যাচ্ছেন মমতা। তাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফরে তিস্তা চুক্তি নিয়ে শেষ মুহূর্তে নতুন কোন চমকও থাকতে পারে। ঢাকা ও দিল্লীর একাধিক কূটনৈতিক সূত্র এসব তথ্য জানিয়েছে। সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে নৈশভোজে যোগ দিতে রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখোপাধ্যায়ের আমন্ত্রণে দিল্লী যাচ্ছেন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। বুধবার মমতা বন্দ্যোপাধ্যয় জানিয়েছেন, তিনি দিল্লী যাবেন। আগামী ৮ এপ্রিল দিল্লীতে খুলনা-কলকাতা রুটের বাসের উদ্বোধন হবে। সেই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে অংশ নেবেন তিনি। এরপর রাতে রাষ্ট্রপতি ভবনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সম্মানে নৈশভোজের আসরেও যোগ দেবেন মুখ্যমন্ত্রী। এই সফরের মাঝে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গেও মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের বৈঠকও হতে পারে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের দিল্লী সফরে দুই দেশের মধ্যে প্রায় ৩৩টি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারত সফরের প্রস্তুতির অংশ হিসেবে বুধবার পররাষ্ট্র সচিব এম শহীদুল হক ঢাকা থেকে দিল্লী গেছেন। সেখানে তিনি ভারতের পররাষ্ট্র সচিব ড. জয়শঙ্করের সঙ্গে আলোচনা করবেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরকালে কি কি চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক সই হতে পারে, সে বিষয়েও আগেভাগেই আলোচনা সারতে চান দুই পররাষ্ট্র সচিব। সূত্র জানায়, তিস্তা চুক্তির বিষয়ে ঢাকার প্রস্তুতিও রয়েছে। ২০১১ সালের ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের ঢাকা সফরকালেই তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে একটি সিদ্ধান্ত ছিল। সেটিতেই বাংলাদেশের সম্মতি রয়েছে। তাই নতুন করে চুক্তির খসড়া প্রস্তুত করতে হবে না। ভারতের কেন্দ্রীয় সরকার পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়কে ম্যানেজ করতে পারলেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লী সফরের সময় তিস্তা চুক্তি করা সম্ভব হবে। তিস্তা চুক্তিতে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির কোন আপত্তি নেই। পশ্চিমবঙ্গে মুখ্যমন্ত্রী মমতার কারণেই এই চুক্তি আটকে রয়েছে। তবে শেষ মুহূর্তে তিস্তা জট ছাড়াতে ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জী আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছেন মমতার সঙ্গে। তাই প্রধানমন্ত্রীর সফরের শেষ সময়ে এ নিয়ে কোন চমকও দিতে পারে মোদি। কেননা মোদি সব সময় নতুন নতুন চমক দিতে পছন্দ করেন। এ ক্ষেত্রেও তেমন হতে পারে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে সবচেয়ে বড় দুটি সমস্যার মধ্যে একটি ছিল সীমান্ত চুক্তি, অপরটি তিস্তা চুক্তি। তবে নানা কারণে এই দুটি চুক্তি একসঙ্গে বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ক্ষমতায় আসার পরে সীমান্ত চুক্তি বাস্তবায়ন হয়েছে। তবে এখনও তিস্তা চুক্তি সম্পন্ন হয়নি। আর তিস্তা চুক্তির ক্ষেত্রে একসময় বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছেন পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এদিকে পশ্চিমবঙ্গকে পাশ কাটিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে পারছে না মোদি সরকারও। তাই যেভাবেই হোক মমতাকে রাজি করিয়ে তিস্তা চুক্তি করতে চায় দিল্লী। সে কারণে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি ২০১৫ সালের ৬ জুন ঢাকা সফরে এলে মমতাকেও সফরসঙ্গী করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে মমতা-মোদির একসঙ্গে বৈঠকও হয়। বৈঠকে ভারতের দুই নেতাই তিস্তা চুক্তির বিষয়ে আশ্বাস দিয়েছিলেন। পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা কখনই বলেননি, তিনি এই চুক্তির বিপক্ষে। তিনি সব সময় বলে আসছেন, তিস্তা চুক্তিতে তিনি আগ্রহী। তবে পশ্চিমবঙ্গের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখেই তিস্তা চুক্তিতে আগ্রহী বলে মমতা জানিয়েছেন। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষতি করে তিনি তিস্তা চুক্তির পক্ষে আগ্রহী নয়। আর সিকিম থেকে ঠিকমতো পানি পেলেই পশ্চিমবঙ্গের এ বিষয়ে কোন আপত্তি নেই বলেও মমতা জানিয়েছেন। ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ঢাকা সফরের আগেই বহুল আলোচিত তিস্তার পানি বণ্টন চুক্তি হবে না, তার আগেই ভারতের পক্ষ থেকে স্পষ্ট করা হয়েছিল। তখন তিস্তা চুক্তি নিয়ে ধৈর্য ধরার পরামর্শ দিয়েছিলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। পররাষ্ট্রমন্ত্রী তখন জানিয়েছিলেন, সবকিছু রাতারাতি হয় না। এটা নিয়ে আলোচনা চলছে। মোদির ঢাকা সফরের একদিন আগেই পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছিলেন, তিস্তা নিয়ে দুই দেশের মধ্যে আলোচনা চলছে কূটনৈতিক পর্যায়ে। ডিপ্লোমেসিতে সবকিছু তো পাবলিকলি হয় না। অনেক কিছুই চোখের আড়ালে হয়। তিস্তা চুক্তি নিয়েও আলোচনা চলছে। এটা নিয়ে আমরা কাজ করছি। গত মঙ্গলবার ভারত সফর সামনে রেখে তিস্তা চুক্তির বিষয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী জানিয়েছেন, আমাদের সম্পর্ক এখন যে অবস্থানে আছে, সেখানে আমরা বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করছি। সেখানে একটি বিষয় হলো কি হলো না, সেটি তেমন বড় কিছু নয়। তবে প্রধানমন্ত্রীর দিল্লী সফরের সময় গঙ্গা ব্যারাজ নির্মাণ, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন, নদীর অববাহিকাভিত্তিক পানি সম্পদ ব্যবস্থাপনা ইত্যাদি বিষয়ে আলোচনা হবে বলে তিনি জানান। ঢাকা সফরে এসে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছিলেন, আমি আত্মবিশ্বাসী যে, ভারতের রাজ্য সরকারগুলোর সহযোগিতায় তিস্তা ও ফেনী নদীর পানি বণ্টনে সুষ্ঠু সমাধানে পৌঁছতে পারব। আমাদের নদীগুলো দূষণমুক্ত ও নাব্য বজায় রাখতে একসঙ্গে কাজ করব। আমাদের নদীগুলো আমাদের সম্পর্ককে লালন করবে, বিভেদের উৎস হবে না। নদী সীমান্তের দুই পাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকাকে তা প্রভাবিত করে। পানি একটি মানবিক ইস্যু, যা আমরা নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেব। ২০১১ সালে ভারতের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনের ঢাকা সফরের সময় তিস্তা চুক্তি সই হওয়ার কথা থাকলেও পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় শেষ মুহূর্তে আপত্তি তোলায় বিষয়টি আটকে যায়। এর প্রায় সাড়ে তিন বছরের মাথায় ২০১৫ সালের ২১ ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের অনুষ্ঠানে যোগ দিতে ঢাকা এসে শীঘ্রই তিস্তার জট খোলার আশা দেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। এরপর মোদির ঢাকা সফরের সময় মমতারও আসার আলোচনা শুরু হলে তিস্তা চুক্তি নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আবারও বেঁকে বসেন তিনি। শেষ পর্যন্ত ঢাকা সফরে তিস্তা চুক্তি না করার আশ্বাস দিয়েই প্রধানমন্ত্রী মোদি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে সফরে আসতে রাজি করান। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকা থেকে ফিরে গিয়ে মমতা বাংলাদেশ সফর নিয়ে নরেন্দ্র মোদিকে চিঠি লিখেন। ওই চিঠিতে মমতা লিখেন তিস্তার পানি বণ্টন নিয়ে তার বিরোধিতা নেই। এই চুক্তির জট খুলতে তিনি মোদিকে সহযোগিতা দিতেও প্রস্তুত রয়েছেন। উল্লেখ্য, ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আমন্ত্রণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামীকাল শুক্রবার সকালে চার দিনের সফরে দিল্লী যাচ্ছেন।
×