ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবেদ খান

চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারী

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ এপ্রিল ২০১৭

চারিদিকে দেখ চাহি হৃদয় প্রসারী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারত সফরে যাওয়ার আগে থেকেই একটি বিশেষ মহল ভারতের সঙ্গে চুক্তি নিয়ে অনেক বক্তব্য দিয়ে বেড়াচ্ছে। বিশেষ করে বাংলাদেশ-ভারত অর্থনৈতিক কিংবা সাংস্কৃতিক চুক্তির চাইতেও বেশি গুরুত্ব দিয়ে কথাবার্তা বলা হচ্ছে ভারতের সঙ্গে প্রতিরক্ষা চুক্তি নিয়ে। কেউ কেউ বলছেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ভারত সফরের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে, ভারতের সঙ্গে এমন ধরনের সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ হওয়া যা বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী হবে এবং এই স্বার্থবিরোধী চুক্তির ফলে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব বিনষ্ট হবে। যে সফর এখনও হয়নি, যে চুক্তি নিয়ে এখন পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট কোন বক্তব্য আসেনি সেই চুক্তি নিয়ে এ ধরনের জল্পনা-কল্পনা অনেকটা যে সন্তান ভূমিষ্ঠ হয়নি সেই সন্তানেরই বিবাহের প্রস্তুতি নিয়ে গলদঘর্ম হওয়ার মতো। শেখ হাসিনা কিংবা আওয়ামী লীগ সরকার যতগুলো মেয়াদে ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হয়েছে, তার মধ্যে কি এমন কোন একটি চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে যা বাংলাদেশের অস্তিত্ববিনাশী? আমরা যদি স্বাধীনতার অব্যবহিত পরবর্তী বিষয়টিও দেখি তাহলে দেখব তৎকালীন সরকার ভারতের সঙ্গে আলোচনা করার প্রথম শর্তই দিয়েছিল বাংলাদেশের মাটি থেকে ভারতীয় সৈন্যদের প্রত্যাহার। মনে রাখতে হবে, এই ভারতের সেনাবাহিনীর বিশাল সংখ্যক সৈন্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করতে গিয়ে প্রাণদান করেছে। এত সত্ত্বেও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব এবং মর্যাদার স্বার্থে তিন মাসের মধ্যে সব ভারতীয় সৈন্য প্রত্যাহার করার ব্যবস্থা করেছিলেন। সেই সময় বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের যে পঁচিশ বছর মেয়াদি প্রতিরক্ষা চুক্তি হয়েছিল সেই প্রতিরক্ষা চুক্তির বিরুদ্ধে অনেকেই অনেক কথা সে সময় বলেছিল। অনেকেই নানাভাবে বঙ্গবন্ধুর সরকারের নীতিমালাকে সমালোচনার বাণে বিদ্ধ করেছিল। ওই চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার পরে মাত্র দু’বছরের মাথায় তৎকালীন আওয়ামী সরকারকে নৃশংস হত্যাযজ্ঞের মাধ্যমে উৎখাত করা হয়েছিল। তারপরে, দীর্ঘ সময় যেসব সরকার বাংলাদেশকে সামরিক কিংবা পরোক্ষ সামরিক আচ্ছাদনে দেশ শাসন করেছিলেন, তারা কি কখনও ওই চুক্তি বাতিলের চেষ্টা করেছিলেন? কিংবা এই চুক্তির কারণে কি তাদের শাসিত রাষ্ট্রব্যবস্থা কোনভাবে সার্বভৌমত্বহীন হয়ে পড়েছিল? বঙ্গবন্ধুর সেই সরকারের সময় যে সমস্ত ছিটমহল চুক্তি হয়েছিল, যে সমুদ্রসীমা চুক্তি হয়েছিল, যে শিমলা চুক্তি হয়েছিল, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে অন্যান্য দেশের সঙ্গে যতগুলো সম্পর্ক উন্নয়ন চুক্তি হয়েছিল, সেগুলোর ক্ষেত্রে ভারতের সঙ্গে সম্পাদিত ওই প্রতিবক্ষা চুক্তি কি কোন রকম প্রতিবন্ধক হয়েছিল? সেই চুক্তির মেয়াদ উত্তীর্ণ হওয়ার পরে আওয়ামী লীগ সরকার নব্বইয়ের দশকে যখন ক্ষমতায় এসেছিল তখন কি সেই চুক্তি নবায়ন করা হয়েছিল? শেখ হাসিনার সেই আমলে ফারাক্কার পানি বণ্টন চুক্তি হয়েছিল তার দ্বারা কি বাংলাদেশ কোন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল? বাংলাদেশের স্বার্থ কি কোন অবস্থায় বিঘিœত হয়েছিল তখন? সে সময় যে স্বাক্ষরিত পার্বত্য শান্তি চুক্তি হয়েছিল, তার মাধ্যমে বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিল নাকি রক্ষা করা হয়েছিল? সে প্রশ্নের উত্তর নিশ্চয়ই কূটনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল জানেন। তারা নিশ্চয়ই এটাও জানেন, তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশের গ্যাস সম্পদ নেয়ার জন্য তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের ওপরে কি ভয়াবহ চাপ সৃষ্টি করেছিল। সেদিন যদি দেশের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেয়ার সামান্যতম আভাসও থাকত তাহলে সে সময়ের শেখ হাসিনার সরকারকে ২০০১-এর নির্বাচনী বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হতো না। যে ফাস্ক চুক্তি করা হয়েছিল এরশাদের সময় তাতে বাংলাদেশকে তো এখন পর্যন্ত সেই কাফফারা দিতে হচ্ছে। এই হিসাব কি সমালোচকরা অনুগ্রহ করে আরেকবার করবেন? আন্তর্জাতিক জলসীমা চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশ তো ভারত কিংবা মিয়ানমারের কাছ থেকে তার ন্যায্য পাওনা আদায়ে সামান্যতম দ্বিধা করেনি। অনেকেই এখন তিস্তা চুক্তি সম্পর্কে অনেক কথাই বলছেন। তিস্তার পানি বণ্টনের প্রশ্নে মতৈক্য না হওয়ার কারণে শেখ হাসিনা যে একসময় পশ্চিমবঙ্গ সফরে সম্মত হননি সে তথ্য নিশ্চয়ই যারা সমালোচনা করেন তারা জানেন। আজ সমালোচকদের একটি বিষয়ে বেশি ভাবিয়ে তুলছে, তাহলো, ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের কোন সামরিক চুক্তি হচ্ছে কি হচ্ছে না- যারা প্রতিরক্ষা সম্পর্কে কিঞ্চিত ধারণা রাখেন, তারা নিশ্চয়ই জানেন বাংলাদেশের সামরিক অস্ত্রসম্ভারের কত ভাগ চীন থেকে আসে। যারা আরও খবর রাখেন তারা জানেন, পাকিস্তানের সামরিক স্বার্থ একসময়ে কি মাত্রায় সংরক্ষিত হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে তাদের পবিত্র কণ্ঠে একটি শব্দও উচ্চারিত হয় না। তবে কি, এটা ধরে নিতে হবে যে বাংলাদেশ চীনের সঙ্গে কিংবা পাকিস্তানের সঙ্গে কিংবা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে অলিখিত কোন সামরিক চুক্তিতে আবদ্ধ? আর যারা ওইসব সামরিক চুক্তি মুসাবিদা করেছিলেন, তারাও আজ শঙ্কিত হয়েই কি কোন ঘটনা ব্যতিরেকেই কোন অদৃশ্য প্রতিপক্ষ কল্পনা করে শঙ্কা বোধ করছেন? আজকের বাংলাদেশ যে কোন বৃহৎ শক্তির লেজুড়বৃত্তি করার প্রয়োজন বোধ করে না, আজকের এই বাংলাদেশ যে- যে কোন বৃহৎ ক্ষমতাশালী শক্তির সঙ্গে আপন মর্যাদাকে সমুন্নত রাখার স্বার্থে টক্কর দেয়ার ক্ষমতা রাখে- আজকের বাংলাদেশ যে নিজের স্বার্থরক্ষার জন্য দরকষাকষি করার শক্তি রাখে, এসব কথা কি বিজ্ঞ সমালোচকরা জানে না? একটি সত্য অনুধাবন করতে হবে, সামরিক শাসনের আমলে কিংবা গণতন্ত্রহীন রাষ্ট্রব্যবস্থায় যখন সংবিধানের অস্তিত্ব থাকে না তখন যে কোন বিষয়ই চাপিয়ে দেয়া যেতে পারে, যেটা একসময় বাংলাদেশের ছিল। কিন্তু আজ কোন সরকারের পক্ষেই সম্ভব নাÑ জনগণের এই অর্জিত শক্তিকে উপেক্ষা করা। এই সরকারের অনেক দুর্বলতা আছে। সংগঠনকে ত্রুটিমুক্ত করার ব্যাপারে এই সরকারের ব্যর্থতা আছে। প্রশাসনিক ক্ষেত্রে পদক্ষেপ গ্রহণ করার ব্যাপারে এ সরকারের অনেক দুর্বলতাও আছে। দল পরিচালনার ক্ষেত্রে নেতৃত্বের অপরিসীম ব্যর্থতাও দৃশ্যমান। আমরা অবশ্যই সেই সব কর্মকা-ের সমালোচনা করব। আমরা অবশ্যই শিক্ষাব্যবস্থা হিজাবীকরণকে সমর্থন করব না। আমরা অবশ্যই ধর্মের রাজনীতি দ্বারা রাজনীতির ধর্মকে রক্তাক্তকরণ সমর্থন করব না। আমরা অবশ্যই সাম্প্রদায়িকতার কিংবা জঙ্গীবাদের সামান্যতম অনুপ্রবেশকে প্রতিহত করব এমনকি তা যদি কোন সরকারের কিংবা সরকারী মহলের অথবা সরকারী দলের কার্যক্রম দ্বারা পরিচালিত হয়ও। কিন্তু তার অর্থ এই নয়, দেশের সরকারকে আন্তর্জাতিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করব মিথ্যা ও ত্রুটিপূর্ণ তথ্য পরিবেশনের মাধ্যমে। আজ যারা শেখ হাসিনা সরকারের নিন্দা ভাষণে মুখর তাদের উচিত হবে এ দেশের অন্যান্য সরকারের আন্তর্জাতিক নীতিমালার সঙ্গে এই সরকারের নীতিমালা এবং সাফল্যের তুলনামূলক বিচার করা। আমাদের সমস্যা আমরা দুঃসময়ের দিনগুলোর দুঃসহ স্মৃতি তুলে ধরতে চাই না এবং সুসময়ের অর্জনকে কটাক্ষবাণে বিদ্ধ করতেও দ্বিধাগ্রস্ত হই না। অতীতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে, বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে আন্তর্জাতিক অর্থলগ্নি সংস্থার কাছে বন্ধক রাখা হয়েছিল। আজ যখন সেই ঋণজাল ছিন্ন করে এই বাংলাদেশ নিজস্ব শক্তিতে পদ্মা সেতু থেকে শুরু করে অন্যান্য বিভিন্ন কার্যক্রমে সফলতার ছাপ রাখছে তখন বিনীতভাবে শুধু এ কথাই বলতে হবে, “হে সমালোচক বন্ধুরা, কালো পর্দার নেকাব মোচন করে বাইরে চোখ রাখলেই আলোকোজ্জ্বল প্রভাতের দৃশ্য অবলোকন করবেন।”
×