ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

হাতিরপুলে কিশোরীকে ধর্ষণের পর ২৬ টুকরা লাশ

কাকের কারণে ধরা পড়া সেই খুনী বাচ্চুর ফাঁসি

প্রকাশিত: ০৫:৫২, ৬ এপ্রিল ২০১৭

কাকের কারণে ধরা পড়া সেই খুনী বাচ্চুর ফাঁসি

গাফফার খান চৌধুরী ॥ কাকের কারণে ২০১২ সালে রাজধানীর হাতিরপুলে ধর্ষণ শেষে এক কিশোরীকে হত্যার পর ২৬ টুকরো করার চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্যের জট খুলে। পরিচয় মিলে হতাভাগা সেই কিশোরী রোখসানা আক্তার রুমি ওরফে সুস্মিতার। শেষ পর্যন্ত গ্রেফতারও হয় নৃশংস সেই খুনী যুবক। বুধবার চাঞ্চল্যকর সেই হত্যা মামলায় খুনী বাচ্চুর ফাঁসির আদেশ দেন ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইবুন্যালের বিচারক জয়শ্রী সমদ্দার। আসামি জামিন নিয়ে পলাতক রয়েছে। তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চলছে। গ্রেফতারের পর এই নরপিশাচ হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় ঢাকার সিএমএম আদালতে জবানবন্দীও দিয়েছে। জবানবন্দীতে বলেছিল, ভুল করেছি। যদি হাতের মাংস ছাড়িয়ে দিতাম। তাহলে কাকে নিয়ে রাস্তায় ফেলতো না। আমিও হয়তো ধরা পড়তাম না। এছাড়া সে খুনের পুরো কাহিনী বর্ণনা করে জবানবন্দীতে। ২০১২ সালের ২ জুলাই শনিবার। সকাল সাড়ে সাতটা। রাজধানীর হাতিরপুলের নাহার প্লাজার পাশের পিজা গলির ১৮ নম্বর বাড়ির সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন বেলাল নামের এক রিক্সাচালক। তিনি সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন, তিনি যাচ্ছিলেন। আচমকা একটি হাড় কাকে নিয়ে যাওয়ার সময় ছিটকে রাস্তায় পড়ে। প্রায় একই সময়ে আরেকটি হাড় কাকের মুখ থেকে পড়ে যায়। প্রথমে তিনি সেগুলো অন্যকোন প্রাণীর হতে পারে বলে মনে করেছিলেন। কিন্তু ঠিক সামনে পড়া হাড়ে মাংস দেখে এবং হাড়ের গড়ন দেখে সেটি মানুষের বলে ধারণা হয়। কাছেই পায়ের পাতার অংশ পড়েছিল। আর তা দেখে টুকরোগুলো যে মানুষের তা তিনি শতভাগ নিশ্চিত হন। মুহূর্তেই এ খবর ছড়িয়ে পড়লে সেখানে শত শত মানুষের ভিড় জমে যায়। বাড়িটির বাসিন্দারা ছাদে গিয়ে পাশের টিনের ছাদে আরও হাড় মাংস, মাংসহীন খ-িত মাথা, শরীরের হাড়, হাতসহ শরীরের অন্যান্য অংশ পড়ে থাকতে দেখেন। ঘটনাস্থলে হাজির হন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। টুকরোগুলো দেখে সেগুলো নারী না পুরুষের তা প্রথম প্রথম বোঝা যাচ্ছিল না। ঘটনাস্থল থেকে মানুষের খ-িত অংশ উদ্ধার হচ্ছিল। এক পর্যায়ে হাতের একটি কব্জির অংশ ও পায়ের পাতার একটি অংশ উদ্ধার হয়। তাতে থাকা আঙ্গুলে নেইলপলিস দেখে টুকরোগুলো নারীর বলে নিশ্চিত হয় পুলিশ। সর্বমোট ২৬ টুকরো নারী দেহের অংশ উদ্ধার করে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। পুলিশ পুরো নাহার প্লাজায় তল্লাশি চালায়। তল্লাশির এক পর্যায়ে নাহার প্লাজার ১৩তলার ১৩০৮ নম্বর কক্ষের সোনালী ট্রাভেল এ্যান্ড ট্যুরস নামের একটি অফিসের বাথরুম থেকে মানুষের নাড়িভুঁড়ি, মাংসের টুকরো, চর্বি, বাথরুমে রক্তের দাগ, ধারালো ছুরি, চাপাতি উদ্ধার হয়। পুলিশ বাদী হয়ে অজ্ঞাত আসামিদের বিরুদ্ধে শাহবাগ মডেল থানায় মামলা দায়ের করে। সোনালী ট্রাভেলসের মালিক সাইদুজ্জামান বাচ্চুকে (২৪) গ্রেফতার করে পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের এক পর্যায়ে পুলিশ কিশোরীর খুনী বাচ্চু বলে নিশ্চিত হয়। বাচ্চু ২০১২ সালের ৭ জুন ঢাকার সিএমএম আদালতে হত্যার দায় স্বীকার করে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দী দেয়। মামলাটির তদন্তকারী কর্মকর্তা ডিবি পুলিশের পরিদর্শক দীপক কুমার দাশ মামলার চার্জশীট দাখিল করেন। জবানবন্দীতে খুনী জানায়, সে নাহার প্লাজার ১৩০৮ নম্বর কক্ষটি ভাড়া নিয়ে ব্যবসা করে। এক বছর আগে সংসদ ভবন এলাকায় রুমির সঙ্গে পরিচয় হয়। পরিচয় থেকে প্রেম। প্রথম সাক্ষাতে রুমি তার কাছে একটি মোবাইল ফোন চায়। ওইদিনই তাকে নকিয়া ১১০০ মডেলের একটি মোবাইল সেট কিনে দেই। রুমি মিরপুরে গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। আমার সঙ্গে দেখা করতে চায়। রুমিকে শুক্রবার (২০১২ সালের ১ জুন) বিকেল ৫টায় দেখা করতে বলি। আমি বিকেলে মিরপুর-১০ নম্বর থেকে তাকে একটি সিএনজি করে অফিসে নিয়ে আসি। তখন সন্ধ্যা প্রায় ৬টা। লিফটে তাকে নিয়ে ১৩০৮ নম্বর কক্ষে যাই। নেয়ার সময় নাহার প্লাজার অনেকেই বিষয়টি দেখে ফেলে। কক্ষের দরজা ভালভাবে লাগিয়ে দেই। এরপর রুমির সঙ্গে একান্ত সময় কাটে। রুমি যখন ক্লান্ত হয়ে সোফায় শুয়ে আরাম করছিল, তখন নাহার প্লাজার কিছু লোক তার দরজায় নক করে। তাদের মধ্যে নাহার প্লাজার স্টাফ ও দোকানদারের সংখ্যাই বেশি ছিল। তারা আমাদের বের হতে বলে। এতে আমরা ভয় পেয়ে যাই। তারা টের পেলে আমাকে অফিস ছেড়ে দিতে হবে। আমার সঙ্গে রুমির বিয়ে দিয়ে দেবে। এমন পরিস্থিতিতে আমি পাগলের মতো রুমিকে হত্যার সিদ্ধান্ত নেই। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টার দিকে আমি রুমিকে গলা টিপে হত্যা করি। হত্যা করার সময়ও মাঝে মাঝে বাইরে লোকজনের কথা শোনা যাচ্ছিল। মারার পর লাশ বাথরুমে নিয়ে যাই। নানা কিছু চিন্তা করার পর রুমে থাকা ছুরি দিয়ে রুমির গলা কাটি। মাথা আলাদা করে বাথরুমের একপাশে রাখি। দুই হাত ও দুই পায়ের জয়েন্ট তিন ভাগ করে ফেলি। বঁটি দিয়ে গলা থেকে নাভি পর্যন্ত দুইভাগ করি। এরপর পেট ফাঁক করে নাড়িভুঁড়ি বের করে বাথরুমে আরেক পাশে রাখি। আস্তে আস্তে নাড়িভুঁড়ি কেটে ছোট ছোট করে বাথরুমের কমোডে দিয়ে ফ্লাশ করতে থাকি। হাত ও পায়ের মাংসগুলো ছাড়াই। যাতে হাত পায়ের হাড়গুলো বাইরের ছাদে ফেললে গন্ধ বের না হয়। দেহের মাংসগুলো ছোট ছোট করে কেটে কমোডে ফেলে দিয়ে ফ্লাশ করে দেই। আর হাত-পায়ের হাড়গুলো জানালা দিয়ে বাইরের ছাদে ফেলে দেই। গোপনাঙ্গে কোন কাপড় ছিল না। ওড়না, সালোয়ার ও জামা কাঁচি দিয়ে কেটে টুকরো টুকরো করে কমোডে ফেলে দিয়ে ফ্লাশ করি। সেমিজ দিয়ে বাথরুমের মেঝে পরিষ্কার করি। চুল কেটে কমোডে ফেলে দেই। মাথাটা জানালার গ্রিলের ভেতর দিয়ে বের হচ্ছিল না। তখন আমি মুখের দুই সাইডে ছুরি দিয়ে মাংস ছাড়িয়ে নেই। এরপর জানালার ভেতর দিয়ে মাথাটি পাশের ছাদে ফেলে দেই। বুকের খাঁচার মাংস ছাড়িয়ে পাশের ছাদে ফেলে দেই। এরপর বাথরুমে থাকা রুমির দেহের অন্যান্য ছোটখাটো অংশও জানালা দিয়ে ফেলে দেই। পরে ছুরি, চাকু, ঘরের দেয়াল, বাথরুমের দেয়ালে লেগে থাকা রক্ত ধুয়ে ফেলি। সেমিজটি সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলি। এরপর সেমিজটি জানালায় শুকোতে দেই। এ কাজ করতে করতে ভোর ৬টা বেজে যায়। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে বাইরের লোকগুলো আবার আসে। দরজায় নক করে। আমি নাহার প্লাজার ম্যানেজার ইলিয়াস এলে দরজা খুলব বলে জানাই। আমি ইতোমধ্যেই ইলিয়াসের সঙ্গে মোবাইল ফোনে কথা বলি। সাড়ে ৯টার দিকে তিনি এলে আমি দরজা খুলি। তারা রুম সার্চ করে। রুমে কিছুই না পেয়ে তারা সবাই চলে যায়। এর ২/৩ মিনিট পরেই তারা আবার মাই টিভির ক্যামেরাসহ আসে। তারাও সার্চ করে কিছুই পায় না। এরপর তারা আমাকে তাদের সঙ্গে থাকতে বলেন। তারা সরাসরি নিচের রুমে চলে যায়। নিচের রুমের কমোডে মাংস, মাংসের টুকরো ও কিছু রক্ত ভেসে ওঠে। ইতোমধ্যেই পুলিশ আসে। পুলিশ আমাকেসহ ৭ জনকে থানায় নিয়ে যায়। আমি ভুল করেছি। যদি হাতের আঙ্গুলের মাংসগুলো ছাড়াতাম, তবে কাকে তা নিয়ে রাস্তায় ফেলত না। আমিও হয়ত ধরা পড়তাম না। প্রসঙ্গত, হতভাগ্য কিশোরীর নাম রোখসানা আক্তার রুমি (১৫)। মায়ের নাম শিরিনা বেগম (৩৮)। রুমি নিহত হওয়ার প্রায় ৪ বছর আগে তার পিতা ছোবহান ফকিরের মৃত্যু হয়। রুমিরা ৪ বোন এক ভাই। রুমির পরিবার মাসিক দেড় হাজার টাকা ভাড়ায় রাজধানীর মিরপুর-৭ নম্বরের চলন্তিকা বস্তিতে বসবাস করত। সবার বড় মেয়ে সাবিনা, মেজো মেয়ে জেসমিন গার্মেন্টসে চাকরি করে। আর সবার ছোট মেয়ে যমুনার ওই সময় বয়স ছিল ১০ বছর। একমাত্র পুত্র আল আমিন (১৭) ফরিদপুরের একটি আলিয়া মাদ্রাসার ছাত্র ছিল। রুমি অষ্টম শ্রেণী পাস করেছিল।
×