ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১০ বৈশাখ ১৪৩১

অরুণ কুমার বিশ্বাস

রাজধানীর রাজকীয় জঞ্জাল!

প্রকাশিত: ০৪:০৯, ৬ এপ্রিল ২০১৭

রাজধানীর রাজকীয় জঞ্জাল!

টুকটাক প্রাতঃভ্রমণের অভ্যেস আমার অনেক দিনের। বয়স বাড়ছে তাই শরীরটা কেমন আইঢাই করে, ইদানীং তাই চিকিৎসকের পরামর্শে ভোর ভোর বেরিয়ে একটু হাঁটাহাঁটির প্রয়াস আর কি! কিন্তু চাইলেই কি তিলোত্তমা নগরী ঢাকার বুকে সেই সুযোগ পাবেন আপনি! তাজমহল রোড ধরে খানিক এগিয়ে স্বনামধন্য রেসিডেন্সিয়াল মডেল স্কুল এন্ড কলেজের দক্ষিণে থানারোডে যে চওড়া ফুটপাত, ওটা প্রাতঃভ্রমণের জন্য বিশেষ যুতসই মর্মে সকলে একবাক্যে স্বীকার করবেন। নিরাপত্তার কথাটুকু বাদ দিলে শরীর সুরক্ষায় প্রাতঃভ্রমণ করা যেতেই পারে। কিন্তু আপনি হাঁটবেন কোথায়! এই তো সেদিন চওড়া ফুটপাতে পা রাখতেই কোত্থেকে যেন উড়ে এলো পুতিগন্ধময় একগুচ্ছ নাড়িভুঁড়ি। পড়বি তো পড় মালির ঘাড়ে- ঠিক আমার নাকের ডগায় এসে দুর্গন্ধ ঝাপটা দিল। এদিক ওদিক তাকিয়ে খানিক বাদে মালুম হল, অদূরে খোলা ময়লার স্তূপ পড়ে আছে। হরেক রকম জঞ্জাল জমা আছে সেখানে। গৃহস্থালি বর্জ্য থেকে শুরু করে তরি-তরকারির খোসা, পচা ফলমূল, পশুর নাড়িভুঁড়ি- কী নেই বলুন। ফুটপাতে নানান বয়স ও পেশার লোকজন হাঁটাহাঁটি করেন। তারা হেলেদুলে কথা বলতে বলতে হাঁটেন। আলাপের বিষয় বহুবিধ। বয়স্ক এক ভদ্রলোক ক্ষোভের স্বরে বললেন, দেশটা কি মগের মুল্লুক নাকি, রাস্তাঘাটে যেখানে সেখানে এমন ময়লার স্তূপ জমে আছে! সরকার করেটা কী! এ প্রশ্ন আমারও। মগেদের আমলে মুলুক কেমন চলতো জানা নেই, তবে সাত সকালে প্রিয় শহর ঢাকায় জমিয়ে একটু হাঁটতেও পারছি না, এই কষ্ট কোথায় রাখি! মিনিট কুড়ি পরে সহসাই সিটি করপোরেশনের একখানা গাড়ি দেখা গেল। কষ্ট করে ধুঁকতে ধুঁকতে এদিকেই আসছে। রেসিডেন্সিয়াল কলেজের উল্টোদিকে কোণায় যে ভাগাড়, সেখানেই এসে গাড়ি থামলো। গাড়িতেই মেলা ময়লা ঝুলঝুল করছে। অথচ আমি লন্ডনে দেখেছি, ময়লাবাহী গাড়ি কত পরিপাটি ও সুন্দর করে ঢাকনা দিয়ে ঢাকা থাকে, যাতে পথচারীরা কেউ ওটা ময়লার গাড়ি বলে ঠাহরই করতে পারে না। বেলা তখন অনেক, ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে যেতে শুরু করছে। তখন কিনা সিটি করপোরেশনের লাটসাহেব ধাঙড়দের ঘুম ভাঙলো। অমনি কাকদের প্রচুর হাঁকডাক শোনা গেল। কেউ ময়লার স্তূপ ঘাঁটছে আর কাক থাকবে না, তাই কি হয়! বেশুমার নাড়িভুঁড়ির খোঁজ পেয়ে কাকরা মেজবানের ভোজসভা শুরু করে দিল। পুরো এলাকা তখন কাকের দখলে, পুতিগন্ধে সয়লাব রেসিডেন্সিয়াল মডেল কলেজের আশপাশ। যাহ্, পুরো সকালটাই মাটি! এভাবেই বিরক্তি প্রকাশ করেন জনৈক প্রাতঃভ্রমণকারী। তার সহচর অবশ্য তেরছা হেসে বলেন, এরচে ভাল আর কী প্রত্যাশা করেন আপনি! দেরিতে হলেও করপোশনের গাড়ি এসেছে তো! মাগনায় কাকদের ডাক শুনছেন, এই ঢের। কথা মিথ্যে নয়, বেটার লেট দ্যান নেভার। এ ব্যাপারে মেয়রগণের সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ করলে নির্দয় হেসে বলবেন, লোকবলের অভাব, কী করবো বলুন! শহরে পাল্লা দিয়ে পাবলিক বাড়ছে, জনতা ভরপেট খাচ্ছে আর সমানে বর্জ্য ছড়াচ্ছে, সেই তুলনায় বাজেট-বরাদ্দ কই! কাজের কথায় আসি। এই শহরে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আদৌ কোন সিস্টেম আছে বলে মনে হয় না। যাও বা আছে তা যথেষ্ট কার্যকর নয়। সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিদের অগ্রহণযোগ্য ঔদাসীন্য আমাদের তাড়িত করে। নাগরিকদের তরফে ঘরের ময়লা-আবর্জনা যথেচ্ছ বাইরে ছুড়ে ফেলার বদভ্যেস লক্ষ্য করা যায়। যেন নিজের বাসা থেকে ময়লা বাইরে ফেললেই হয়, শহরটা তো তার নয়, ওটা আমজনতার। এহেন অবিবেচনাপ্রসূত আচরণ ছেড়ে নগরের শুদ্ধতার প্রতি সকলে মনোযোগী হলে ভাগাড়তুল্য শহরের কিছু একটা গতি হতে পারে মর্মে আশা করা যায়। জঞ্জালের এই শহরে মাথা গোঁজার ঠাঁই হয়তো হয়, কিন্তু প্রাণভরে নিঃশ^াস নেবার ফুরসতটুকু নেই। আসুন সবাই মিলে এ শহরকে বাসযোগ্য করে তুলি, বাতাসে আবর্জনা নয়, শুদ্ধতার সুবাস খুঁজি। মোহাম্মদপুর, ঢাকা থেকে
×