ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ও আগামী দিন -স্বদেশ রায়

প্রকাশিত: ০৪:০৬, ৬ এপ্রিল ২০১৭

তিনটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের পরাজয় ও আগামী দিন -স্বদেশ রায়

পর পর তিনটি নির্বাচনে পরাজিত হয়েছে আওয়ামী লীগ। দুটি পেশাজীবী নির্বাচন, একটি সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। ঢাকা বার, সুপ্রীমকোর্ট বার ও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। তিনটি নির্বাচনে পরাজয়ের ঘটনাকে আওয়ামী লীগ খুব তাড়াহুড়ো করে বিশ্লেষণ করে বলছে, এ পরাজয়ের মূল কারণ তাদের অভ্যন্তরীণ কোন্দল। কোন একটি নির্বাচনে পরাজয়ে একটি কারণ থাকে না। আওয়ামী লীগ নেতারা অনেক বড় দলের রাজনীতিক। তাঁরা রাজনীতির বিষয়ে আমাদের থেকে অনেক বেশি খোঁজখবর রাখেন ও পড়াশোনা করেন। তাঁরা নিশ্চয়ই আমেরিকার নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হেরে যাওয়ার পরে, ওই দলের পক্ষ থেকে হারার কারণ খুঁজে যে প্রতিবেদন তাঁরা তৈরি করেছেন তার যতটুকু সে দেশের পত্রপত্রিকায় এসেছে তা নিশ্চয়ই পড়েছেন। আমেরিকা বা ব্রিটেনে কোন দল হেরে গেলে বা জিতলে সবাই তাদের জয় বা পরাজয়ের কারণগুলো বিশ্লেষণ করে। কম-বেশি এগুলো পত্রপত্রিকা বা পলিটিক্যাল জার্নালের মাধ্যমে কিছু পড়ার সুযোগ পাই। সাম্প্রতিককালের ভেতর ক্যামেরন নেতা হওয়ার আগের বারের কনজারভেটিভ পার্টির হেরে যাওয়ার মূল্যায়ন ও এবারের ডেমোক্র্যাটদের হারের মূল্যায়ন অনেক বেশি চুল চেরা ও শিক্ষণীয়। যা হোক, আওয়ামী লীগেরও গবেষণা সেল আছে। তারাও নিশ্চয়ই অনেক ভাল মূল্যায়ন করবে। আওয়ামী লীগ নেতারা যে শুধু কোন্দল বলেই শেষ করে দিয়েছেন, এমনকি দলের সেক্রেটারিও বলেছেন কোন্দলই মূল কারণ- এখানেই নিশ্চয়ই বিষয়টি শেষ করবেন না। মি. সেক্রেটারি যে ঘরের ভেতর ঘর তোলা বন্ধ করতে বলেছেন আইনজীবীদের, তা অত্যন্ত সঠিক। ঠিক তেমনি কুমিল্লায় নির্বাচনে যদি মন্ত্রীরা কোন্দলে জড়িয়ে যান, আর তা যদি সত্য হয়– তাহলে মি. ওবায়দুল কাদের তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার যে কথা বলেছেন এটাও যে কোন দলের সেক্রেটারি হিসেবে অত্যন্ত সঠিক অবস্থান বলেই বিবেচিত হবে রাজনীতিতে। এখন প্রশ্ন, আসলে কি শুধু অভ্যন্তরীণ কোন্দলের কারণে আওয়ামী লীগ এই তিনটি নির্বাচনে হেরেছে? এই তিনটি নির্বাচনের প্রথমেই প্রশ্ন আসে, এই তিন নির্বাচনে আওয়ামী লীগ কি সঠিক প্রার্থী নির্বাচন করেছিল? আওয়ামী লীগ যদি প্রফেশনাল কোন সংস্থা দিয়ে বিশ্লেষণ করায়, তারা দেখতে পাবে এই তিন নির্বাচনের কোনটাতেই আওয়ামী লীগের প্রার্থী সঠিক হয়নি। প্রার্থীর জন্য যোগ্যতা, দলে গ্রহণযোগ্যতা এবং সার্বজনীন জনপ্রিয়তাÑ এই তিনই বড়। কোন বিশেষ অঞ্চল, পরিবার বা উত্তরাধিকার বিবেচনায় প্রার্থী নির্বাচন খুব কম সময়ে সঠিক হয়। এ ছাড়া যে কোন পেশার নির্বাচনে অনেক বিষয় কাজ করে তার ভেতর অন্যতম হলো, যিনি আমার পেশার প্রার্থী তিনি কতটা আমার পেশায় যোগ্য মানুষ। এই দিকটি দীর্ঘদিন হলো বিভিন্ন পেশাজীবী নির্বাচনগুলোতে দেখা হচ্ছে না, যে কারণে বিভিন্ন পেশাজীবী ফোরামগুলো ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়ছে। আমি আমার পেশার খোঁজ জানি, এখানে সাম্প্রতিককালের দুটি নির্বাচনে মঞ্জুরুল ইসলাম বুলবুল ও শফিকুর রহমানের বিরুদ্ধে অনেক রকম প্রতিবন্ধকতা তৈরি করা হয়েছিল। কিন্তু দু’জনই জয়লাভ করেন। এই দু’জন জয়লাভ করার মূল কারণ, দু’জনই অনেক বড় সাংবাদিক। অন্য সাংবাদিকরা গর্বের সঙ্গে তাদের ভোট দিয়েছেন। পেশাজীবী নির্বাচনে এটা খুবই বড় বিষয়। গতবারের বার কাউন্সিল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যে দীর্ঘদিন পরে বিজয় ছিনিয়ে এনেছিল তার একটি বড় কারণ ছিল এমনই। কারণ, ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের নেতৃত্বে যে প্যানেল আওয়ামী লীগ সভানেত্রী তৈরি করে দিয়েছিলেন তা ছিল আমাদের মতো ক্ষুদ্র সাংবাদিকের দৃষ্টিতে আইনজীবী মহলের একটি সেরা প্যানেল। নির্বাচনে এই প্রার্থী নির্বাচন খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। যা এবার আমেরিকার নির্বাচনে হিলারি হেরে যাওয়ার পরে ডেমোক্র্যাটদের মূল্যায়নপত্র তৈরি করার আগেই ওবামা বলেন। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, তিনি নিজে প্রার্থী হলে ট্রাম্পকে হারাতে পারতেন। এক শ’ ভাগ সত্য। ডেমোক্র্যাটদের মূল্যায়নপত্রের লাইন বিটিউন এবং তথ্যে উপাত্তে তা ফুটে উঠেছে। এ কারণে, এই তিনটি নির্বাচনে পরাজয় আগামী জাতীয় নির্বাচনের ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের জন্য একটি বার্তা দিয়ে গেছে, আগামী জাতীয় নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য সব থেকে বড় হলো তার প্রার্থী নির্বাচন। এখনই মানুষের মুখে মুখে ফিরছে, আওয়ামী লীগকে অন্তত দুই শ’ আসনে নতুন প্রার্থী মনোনয়ন দিতে হবে। তাদের বক্তব্য ওই সব এমপি ও মন্ত্রীদের লোকজনের অত্যাচারে, চাঁদাবাজিতে অতিষ্ঠ তাদের এলাকার মানুষ। তারা কোন্ লেভেলে গিয়ে চাঁদাবাজি করছে, তা দলের সেক্রেটারি ইতোমধ্যে কিছু খোঁজ পাচ্ছেন। তিনি দু-একটা বন্ধও করেছেন। যেমন, বগুড়ায় প্রত্যেক রিক্সাওয়ালার কাছ থেকে প্রতিদিন ২০ টাকা চাঁদা নেয়া হতো। মি. কাদের তা জানার পরে, এসপি ও ডিসিকে ডেকে বলে দেন, কাল থেকে যেন এই ঘটনা আর না ঘটে। আঞ্চলিক সাংবাদিকদের মাধ্যমে শুনেছি, পরদিন থেকে তা বন্ধ হয়ে গেছে এবং সেখানকার রিক্সাওয়ালারা এখন মি. কাদেরের জন্য দোয়া করেন। ঠিক এমনি কোন দল করেন না এমন একজন তরুণ ব্যারিস্টারের সঙ্গে কথা হচ্ছিল সুপ্রীমকোর্ট আইনজীবী সমিতি নির্বাচনের পরে। তিনি বলছিলেন, দেখেন সরকারী দলের তরুণরা অনেকেই তো ভোট দিতে আসেনি। কারণ কয়েকজন সুবিধাবাদী নেতা সব সুবিধা নেবে আর তরুণদের মূল্যায়ন করবে না, তাঁদের মানুষ মনে করবে না- এগুলো তাঁরা মেনে নেয়নি। কুমিল্লায়ও এমন ঘটেছে। প্রায় এক লাখ লোক ভোট কেন্দ্রে আসেনি। আমেরিকার ডেমোক্র্যাটদের ক্ষেত্রেও অনেক রাজ্যে এবার একই ঘটনা ঘটেছে। ভোটাররা ভোট দিতে আসেনি। যা হোক, এমনি অনেক বিষয় আছে একটি নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার ক্ষেত্রে। আওয়ামী লীগের প্রয়োজন এ বিষয়ে সঠিক মূল্যায়নপত্র তৈরি করা। কুমিল্লার সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের দিন, মতামত দেয়ার জন্য কয়েক ঘণ্টা ‘এটিএন নিউজ’ টিভিতে ছিলাম। ওই টেলিভিশনটি মাঝে মাঝে কুমিল্লার তরুণ ভোটারদের ভোট সংক্রান্ত বক্তব্য প্রকাশ করছিল। বেলা তিনটা পর্যন্ত তা শুনে, তাদের কথার পেছনের কথাটা পড়ে নিয়ে হিসাব করে দেখি মোটামুটি ৪০ পার্সেন্ট তরুণ ভোটার আওয়ামী লীগকে ভোট দিচ্ছে আর ৬০ পার্সেন্ট দিচ্ছে বিএনপি প্রার্থীকে। তখন, ওখানে মতামত দিতে গিয়ে বলি, কে জিতবে তা ইতোমধ্যে নির্ধারিত হয়ে গেছে। তবে এখনও ভোট চলছে তাই তা এ মুহূর্তে বলা সাংবাদিকতার নীতি নয়। কারণ এতে ভোটে প্রভাব ফেলতে পারে। তবে মার্জিন খুব বড় হবে না। তার কারণ বয়স্ক ভোটারদের বক্তব্য ছিল এর থেকে একটু ভিন্ন। এখানে সব থেকে বড় দিক হলো, যা শুধু আওয়ামী লীগকে নয়, গোটা প্রগ্রেসিভ সমাজকে ভাবতে হবে। গত আট বছর দেশে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার। মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে তরুণ প্রজন্ম ফেসবুকেও বেশ সরব। তার পরেও কেন কুমিল্লায় তরুণ ভোটাররা এককাট্টা হয়ে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির সঙ্গে দাঁড়াল না। বরং বেশি তরুণ ভোট দিল বিএনপি প্রার্থীকে। এর জন্য কি প্রার্থী দায়ী, প্রার্থীর পিতা দায়ী না মুক্তিযুদ্ধের সরকার ও প্রগতিশীল মহল তরুণ প্রজন্মকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে? কুমিল্লায় যে ব্যর্থ হয়েছে তার প্রমাণ নির্বাচনের ফল। কুমিল্লার এই ব্যর্থতা কোন্ পর্যায়ে তা পর্যালোচনা প্রয়োজন। কেন্দ্র থেকে যে নেতারা গিয়েছিলেন প্রচারে, তারাও কিন্তু একবারও তুলে ধরেননি, ১৯৭১ এ হানাদার বাহিনীর সহযোগী হিসেবে সাক্কুর বাবার কী ভূমিকা ছিল। কুমিল্লার মতো সারাদেশে এমনি তরুণ প্রজন্মকে বোঝাতে ব্যর্থ হয়েছে কিনা সরকার ও প্রগতিশীলরা তা এখনই জরিপ করে দেখা দরকার। কারণ, মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তি ছাড়া আওয়ামী লীগকে অন্যরা ভোট দেবে না। তাদের যতই তোষামোদ করা হোক না কেন, আর তাদের কথামতো রবীন্দ্রনাথ, জয়নুল আবেদিনকে পাঠ্যসূচী থেকে বাদ দেয়া হোক না কেন। কুমিল্লায় আওয়ামী লীগের প্রার্থীর পক্ষ থেকে জামায়াতের সঙ্গে একটা গোপন আঁতাত করার চেষ্টা হয়েছিল। যা কেন্দ্রীয় নেতাকে সেখানকার জনপ্রতিনিধি জানিয়েছিলেনও। জামায়াত কথা দিয়েও তাদের পাঁচ হাজার ভোট আওয়ামী লীগকে দেয়নি। অথচ তারা বোকা আওয়ামী লীগের ভোট নিয়ে তিনজন কাউন্সিলর পাস করিয়েছে। এ ধরনের কথাও কিন্তু নানান সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগকে বিষয়টির সত্যতা যাচাই করতে হবে। সত্য হলে সে বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে হবে। অন্যদিকে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যদি মনে করে, জামায়াত-হেফাজত তাদের ভোট দেবে তাহলে সেটা হবে সোনার পাথর বাটি তৈরির চিন্তা। জামায়াত-হেফাজতে সোনা খুঁজে আওয়ামী লীগের কোন লাভ নেই। আওয়ামী লীগের ভোট খুঁজতে হবে সেই সব তরুণের ভেতর যারা রাজধানীর শাহবাগসহ সারাদেশের রাজপথে নেমে এসেছিল। এখনই ঘরে ঘরে গিয়ে তাদেরই বের করে আনতে হবে আওয়ামী লীগকে। কারণ আওয়ামী লীগ তাদের সঠিক স্নেহ করেনি। এই প্রার্থী নির্বাচনে ভুল, লোকাল আওয়ামী লীগ নেতা-কর্মীদের অত্যাচার, জামায়াত-হেফাজতের ভোট নিয়ে মিথ্যা আশার বাইরেও আগামী সাধারণ নির্বাচনে আরেকটি বিষয় প্রভাব ফেলবে- তা হলো, নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসের দাম। চালের দামের রেকর্ড হয়েছে, চিনির দামও সেই পথে, লবণের দামসহ অন্য অনেক জিনিসের দাম এখন ক্রেতাকে কষ্ট দিচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী যদি গভীরভাবে এ বিষয়টির দিকে আগামী দুই বছরের জন্য নজর না দেন, তিনি যদি এ বিষয়ে সঠিক সিদ্ধান্ত না নেন- তা হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের মূল্য আগামী নির্বাচনে অনেক বড় ফ্যাক্টর হয়ে দেখা দেবে। শুধু ভোটের জন্য নয়, এ মুহূর্তেই কিছু নিত্যপণ্যের মূল্য নিয়ে মানুষের নাভিশ্বাস উঠছে। এ দিকটিও সরকারকে দেখতে হবে। সরকারী চাকুরেদের প্রধানমন্ত্রী ১২৯ গুণ বেতন বাড়িয়েছেন। বেসরকারী ক্ষেত্রে ওই হারে কেন, প্রকৃত অর্থে কোন বেতন বাড়েনি। ছোট ব্যবসায়ী, ছোট ছোট কাজ করে যারা সংসার চালায় তাদেরও আয় ওই অর্থে বাড়েনি। একেবারে নিম্ন পর্যায়ের জন্য বর্তমান সরকার অনেক কর্মসূচী নিয়েছে। সেখানে যদিও অনেক দুর্নীতি হচ্ছে তারপরও মানুষ উপকৃত হচ্ছে। তবে এই দ্রব্যমূল্যের আঘাত সব থেকে বেশি পড়ছে নিম্নমধ্যবিত্তের ওপর। শেখ হাসিনার আগের সরকারের আমলে এটা ছিল না- কেন এবার হচ্ছে? কোন্ ছিদ্রপথে এই চোর ঢুকছে? ওই ছিদ্র তাকে অচিরেই বন্ধ করতে হবে। [email protected]
×