ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১৮ এপ্রিল ২০২৪, ৫ বৈশাখ ১৪৩১

বৈষম্যের জাঁতাকলে বিশ্ব

প্রকাশিত: ০৪:০৫, ৬ এপ্রিল ২০১৭

বৈষম্যের জাঁতাকলে বিশ্ব

মানুষ মানুষের জন্য বলা হলেও মানুষে মানুষে বৈষম্য তীব্রতর। সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে আয়ের বৈষম্য। একই সঙ্গে শ্রেণী বৈষম্য। পুঁজিবাদের বিকাশ মানুষকে প্রকৃত মানুষ হিসেবে গড়ে ওঠার পথ দেখায়নি। বরং মানুষ আরও বেশি মানবেতর জীবনের দিকে ধাবিত হচ্ছে। শ্রেণীতে শ্রেণীতে বাড়ছে বৈষম্যের জঞ্জাল। সে সব জঞ্জাল সরিয়ে মুক্ত হওয়ার পথ আর মেলে না। লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, শোষিত,বঞ্চিত জনতার জয়ধ্বনি একালে আর শোনা যায় না। আয়ের ক্ষেত্র এতই সম্প্রসারিত যে, প্রতিদিন বাড়ছে ধনীদের অর্থ ও সম্পদের ভা-ার। আর দিন দিন নিঃশেষিত হচ্ছে বিশাল অংশের মানুষ। আফ্রিকার অঞ্চলের বহু মানুষ এখনও মানবেতর জীবন যাপন করছে। দু’বেলা দু’মুঠোর আহার তাদের জোটে না। খরাপীড়িত অঞ্চলের মানুষরা এখনও ক্ষুধায় কাতর হয়ে ঢলে পড়ছে মৃত্যুর কোলে। কার্ল মার্কস এই বৈষম্যের কথা তুলে ধরেছিলেন। পথ দেখিয়েছিলেন সমাধানের। সাম্য, মৈত্রীর বন্ধনে মানুষে মানুষে সম্প্রীতি গড়ে তোলার স্বপ্নগুলো আজ সুদূরপরাহত। অর্থনৈতিক বৈষম্য আজ বিশ্বব্যাপী। আর এরই কারণে সৃষ্টি হচ্ছে সহিংসতা, যা মানব জাতির নিরাপত্তা ও শান্তির জন্য বড় ধরনের হুমকিতে পরিণত হয়েছে। বর্তমান বিশ্বের পঞ্চাশ ভাগ মানুষের সমপরিমাণ সম্পদ যদি মাত্র আটজন ধনবানের মালিকানায় থাকে, তবে বৈষম্যের বহর কত বিশালতর, তা স্পষ্ট হয়। অবস্থা এমন যে, বিশ্বের এক’শ কোটি মানুষ এখনও দিনে দুই ডলার আয় করতে পারে না। দরিদ্র জনগোষ্ঠীর আয় দিনদিন আরও নিচের দিকে নামছে। হতদরিদ্রের অবস্থা তো আরও করুণ। শিশুদের প্রাথমিক শিক্ষাও নিশ্চিত করা যাচ্ছে না। বরং বইপত্র নয়, শিশুদের হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে আত্মঘাতী বোমা। তাদের জড়ানো হচ্ছে জঙ্গীবাদে। তারুণ্যের শক্তি ও সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো হচ্ছে না। তাই জঙ্গীবাদে ঝোঁকার প্রবণতা বাড়ছে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিতদের মধ্যেও। বিশ্বের প্রায় এক শ’ মিলিয়ন তরুণের শক্তি-ক্ষমতা ও আদর্শকে কার্যকর করা হচ্ছে না অথচ পৃথিবীকে সুন্দর করতে তারুণ্যের শক্তিকে গুরুত্ব দেয়া জরুরী। বিশ্বকে বদলের ক্ষমতা; শক্তি তাদের রয়েছে। এই শক্তি যথাযথ কাজে না লাগানো হলে হতাশাগ্রস্ত, অসহিষ্ণু সহিংসতায় আবিষ্ট হতে বাধ্য তারা। এই যে তরুণরা ভুল পথে পরিচালিত হচ্ছে, মানুষ হত্যা করছে, এমনকি কার্যত স্বর্গ পাবার লোভ ও মোহ তাদের তাড়িত করছে ভুল পথের দিকে। ভবিষ্যত প্রজন্মকে সত্য, ন্যায়, আদর্শ ও মানসিক বোধে গড়ে তোলার জন্য যা যা করণীয় তার কোন উদ্যোগ পরিলক্ষিত হয় না। নারীকে সমভাবে ক্ষমতায়িত করা হয়নি। আর এ কারণে সমাজ পিছিয়ে আছে। সন্তান বাৎসল্য সংসার প্রীতি ছেড়ে নারীরা আত্মঘাতী হয়ে উঠছে এদেশে-ওদেশে। শিশু, তরুণ ও নারীদের প্রতি মনোযোগী হওয়া না গেলে বিশ্বজুড়ে ভয়াবহ বিপর্যয় নেমে আসা অসম্ভব কিছু নয়। ঢাকায় অনুষ্ঠিত পাঁচ দিনব্যাপী ইন্টার পার্লামেন্টারিয়ান ইউনিয়ন (আইপিইউ)-এর ১৩৬তম সম্মেলনে শান্তিতে নোবেল জয়ী মানবাধিকার কর্মী ভারতের কৈলাস সত্যার্থী বিষয়টিতে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেছেন, বিশ্বনাগরিকদের জন্য একটি নতুন সভ্যতা গড়ে তোলা বর্তমান সময়ের দাবি। বিশ্বের সাড়ে তিনদিনের প্রতিরক্ষা বাজেটের অর্থে বিশ্বের সকল শিশুর শিক্ষার চাহিদা পূরণ সম্ভব। এটা বাস্তব যে, অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সম্পদের ঘাটতি মানুষে মানুষে বিভেদ বাড়াচ্ছে। এই বাংলাদেশে দারিদ্র্য বিমোচনের কাজ ত্বরান্বিত হলেও আয় বৈষম্য হ্রাস পায়নি। তাই সমাজে উচ্চ শ্রেণী ও নিম্ন শ্রেণীর হার বাড়ছে। মধ্যবিত্তের অবস্থান নড়বড়ে হচ্ছে। সকল ধরনের বৈষম্য দূর করা না গেলে বিশ্বমানব সহিংসতায় জড়াবে। যা কারও কাম্য নয়। বরং বৈষম্য হ্রাসের উপায় উদ্ভাবন করে তা কার্যকর করার কাজ বিশ্বের সকল দেশের ওপরই বর্তায়। জনপ্রতিনিধিদের এজন্য বিশেষ ভূমিকা গ্রহণ অত্যাবশ্যক। বৈষম্যহীন সমাজ গড়ার প্রত্যয় নিয়ে স্বাধীন হয়েছিল বাংলাদেশ। সময়ের দাবি তাকে পূরণ করতেই হবে।
×