ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

থাইল্যান্ডে জেনারেলদের মাস্টার প্ল্যান

প্রকাশিত: ০৫:৪৮, ৫ এপ্রিল ২০১৭

থাইল্যান্ডে জেনারেলদের মাস্টার প্ল্যান

থাইল্যান্ডে ২০১৪ সালের অভ্যুত্থানে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করার পর শাসক সামরিক জান্তা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে অচিরেই গণতন্ত্র ফিরিয়ে দেয়া হবে। তিন বছর চলছে আজও সেই প্রতিশ্রুত নির্বাচনের কোন লক্ষণ নেই। বরং মার্চ মাসের মাঝামাঝি জেনারেলরা বিদেশী কূটনীতিক ও সাংবাদিকদের এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তাদের ২০ বছরের জাতীয় স্ট্র্যাটেজি ঘোষণা করেন এবং জোর দিয়ে বলেন, সে ভবিষ্যতের সব সরকার এই স্ট্র্যাটেজি অনুসরণ করতে আইনগতভাবে বাধ্য থাকবে। থাইল্যান্ডের ওপর জান্তার মাস্টার প্ল্যান চাপিয়ে দেয়ার ব্যবস্থাটা নতুন সংবিধানেই বিধৃত আছে। জান্তা গত বছর এক গণভোটে সংবিধানটি পাস করিয়ে নেন এবং এর যে কোন সমালোচনা নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। সংবিধানে নতুন নির্বাচনের ব্যবস্থা আছে বটে তবে সেটা বহুবার স্থগিত রাখার পর অবশেষে আশা করা হচ্ছে যে আগামী বছর সেই নির্বাচন হবে। একই সঙ্গে সংবিধানে জান্তার লোকজন ঠাসা সিনেট ও অন্যান্য ব্যতিক্রমী ধরনের কমিটিকে নবাগত সরকারগুলোকে বেবি সিটিং করার ক্ষমতা দেয়া হয়েছে। নির্বাচিত রাজনীতিকরা জেনারেলদের পূর্ব নির্ধারিত পরিকল্পনা আঁকড়ে না থেকে যদি নিজস্ব নীতি অনুসরণ করতে চায় সেক্ষেত্রে ওই সংস্থাগুলোকে হস্তক্ষেপ করার অধিকারও দেয়া হয়েছে। থাইল্যান্ড এক সময় দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার অর্থনৈতিক জগতের অন্যতম উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক ছিল। তবে হালে কয়েক বছর ধরে বৃহৎ প্রতিবেশীদের সকলের তুলনায় দেশটির প্রবৃদ্ধি হয়েছে মন্থর। বিশ্বব্যাংকের এক রিপোর্টে কম্বোডিয়া, মালয়েশিয়া ও ভিয়েতনামকে থাইল্যান্ডের তুলনায় অধিক প্রতিযোগিতামূলক বলে উল্লেখ করা হয়। থাইল্যান্ডে ক্ষমতার সঙ্গে ভালভাবে সম্পর্কযুক্ত ধনকুবের বা ব্যবসার ক্ষেত্রে আধিপত্য করে থাকে। বৃহত্তম শহরগুলোর বাইরের অনেক স্কুলের অবস্থা শোচনীয়। বছরের পর বছর ধরে সরকার তার বাজেটের সবচেয়ে বড় অংশ ব্যাংকে ও এর শিল্পাঞ্চলের ভাগ্যবান বাসিন্দাদের পেছনে ব্যয় করে আসছে। অন্যদিকে বাইরের এ দেশগুলোর অধিবাসীরা দরিদ্রই রয়ে গেছে। জান্তার অন্দর মহল এসব সমস্যা যে জানে না তা নয়। এ পর্যন্ত কর হ্রাস, অর্থ স্থানান্তর এবং ভোক্তার ব্যয়বৃদ্ধি বাড়াতে সাময়িক অনুপ্রেরণা দিয়ে প্রবৃদ্ধি ঠেকা দিয়ে রাখা হয়েছে। তবে ২০ বছরের মাস্টার প্ল্যানে যেসব সংস্কার কার্যকর করার কথা সেগুলো করতে এই জান্তার ক্ষমতা বা সামর্থ্য নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। থাইল্যান্ডের গ্রামীণ প্রাণকেন্দ্রে বিরোধী শক্তিকে দমন করতে এই জান্তা সফল হলেও শহরকেন্দ্রিক যে ক্ষুদ্র চক্রটি নিজেদের সুযোগ-সুবিধা অটুট রাখতে বদ্ধপরিকর তাদের খুশি রাখতে এবং নিজেদের বাধিত বোধ করে। এদিকে জান্তার স্কিমগুলো থাইল্যান্ডের নতুন রাজা ভাজিরালংকনের ইচ্ছা অনিচ্ছার কাজে উত্তরোত্তর জিম্মি হয়ে পড়ছে। বাজার উদ্দেশ্যটা এখনও পর্যন্ত পরিষ্কার নয়। দু’- দু’বার তিনি জেনারেলদের অপ্রস্তুত অবস্থায় ফেলেছেন। প্রথমত তার বাবার মৃত্যুর পর সিংহাসনে আরোহণ এক মাস বিলম্বিত করার সিদ্ধান্ত নিয়ে এবং দ্বিতীয়ত জান্তার প্রণীত সংবিধানের কিছু কিছু অনুচ্ছেদ পরিবর্তনের নির্দেশ দিয়ে। সংশ্লিষ্ট অনুচ্ছেদগুলোতে রাজার ক্ষমতা কিছুটা সীমিত করার ব্যবস্থা ছিল। নতুন করে প্রণীত ওই অনুচ্ছেদগুলো এখন বাজার অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে। ইদানীং রাজা তার রাজসভার কিছু কর্মকর্তাকে পদচ্যুত করেছেন আবার কাউকে কাউকে পদোন্নতিও দিয়েছেন। এসব ঘটনাকে কেউ কেউ রাজতন্ত্র ও সেনাবাহিনীর মধ্যে মনকষাকষির লক্ষণ হিসেবেও দেখছেন। জান্তার উদ্বিগ্ন শোধ করার কারণ রাজা যেসব পদক্ষেপ নিচ্ছেন তাতে আগামী সেপ্টেম্বরে সেনাবাহিনীতে যে বার্ষিক রদবদল হওয়ার কথা সেটার সুযোগ নিয়ে তিনি আর্মিকে নাড়া দেয়ার চেষ্টা করতে পারেন। আগামী দুই দশক থাইল্যান্ডকে নিরাপদ করার একমাত্র উপায় হলো রাজনৈতিক দৃশ্যপটের মর্মমূলে যে সংঘাত রয়েছে সেটাকে দূর করার চেষ্টা করা। সেই সংঘাতের চরিত্র হলো শ্রেণীযুদ্ধ। গ্রামীণ জনপদের সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠী শহরাঞ্চলের সম্পন্ন মানুষ, রাজপুরুষ ও সৈনিকদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর লক্ষণ দেখাচ্ছে। এদিকে সামরিক বাহিনী জোর দিয়ে বলছে যে তারা থাইল্যান্ডের রাজনীতিতে কুশীলব নয়, রেফারি মাত্র। অথচ কার্যত তারাই সবকিছুর নিয়ন্তা হতে চাইছে। আগামী দিনগুলোতে থাই রাজনীতির গতিপথ কি হবে সেটাই এখন দেখার বিষয়। সূত্র : দি ইকোনমিস্ট
×