ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

শীঘ্রই জেলায় জেলায় জনসংযোগ কর্মসূচী

নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে মাঠে নামছেন খালেদা জিয়া

প্রকাশিত: ০৫:৪৫, ৫ এপ্রিল ২০১৭

নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে মাঠে নামছেন খালেদা জিয়া

শরীফুল ইসলাম ॥ সারাদেশের সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে শীঘ্রই জেলায় জেলায় সফরে গিয়ে জনসংযোগ শুরু করবেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ইতোমধ্যেই বিএনপি চেয়ারপার্সনের গুলশান কার্যালয় থেকে বিভিন্ন জেলা নেতাদের এ কথা জানানো হয়েছে। আর জেলা নেতারাও নিজ নিজ এলাকায় খালেদা জিয়াকে বরণ করতে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছেন। জানা যায়, চরম বেকায়দায় থাকার পরও কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয়ী হওয়ার পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা আশাবাদী হয়ে উঠেছেন। আর এ কারণেই দলের হাইকমান্ড তাদের আশাবাদ আরও চাঙ্গা করতে জেলায় জেলায় জনসংযোগ কর্মসূচী শুরু করতে যাচ্ছে। জনসংযোগকালে একদিকে দলের সাংগঠনিক অবস্থা জোরদার করা এবং অন্যদিকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সরকারের বিষয়ে জনমত তৈরি করা হবে। এভাবে জনসংযোগ কর্মসূচী জোরদার করে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই সরকারকে চাপে রেখে নির্বাচনে সুবিধা আদায় করার কৌশল নেবে বিএনপি। উল্লেখ্য, একদিকে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন বর্জন এবং অপর দিকে এ নির্বাচনের এক বছর পর টানা ৯২ দিনের নেতিবাচক আন্দোলন কর্মসূচী দিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় বিএনপির রাজনীতির প্রতি সাধারণ মানুষের নেতিবাচক ধারণা সৃষ্টি হয়। এ পরিস্থিতিতে বিএনপির সর্বস্তরের নেতাকর্মীদের মনোবল ভেঙ্গে পড়ে। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা হতাশ হয়ে দল বিমুখ হয়ে পড়েন। আর রাজপথে দলীয় কর্মসূচী জোরদার করতে না পারা এবং দলের অনেক নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা থাকায় বিএনপি যখন দিশেহারা তখন কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনে বিজয় দলটিকে আশার আলো দেখায়। আর এ জন্যই নতুন উদ্যমে দলকে চাঙ্গা করতে জনসংযোগ কর্মসূচী শুরু করতে যাচ্ছেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। জেলায় জেলায় জনসংযোগ কর্মসূচী পালনের বিষয়ে তিনি বগুড়া, রাজশাহী. সিলেট, চট্টগ্রাম, যশোর, খুলনা ও কুমিল্লাকে প্রাধান্য দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের ডাকে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে টানা ৯২ দিনের অবরোধ ও দফায় দফায় হরতাল কর্মসূচীর কারণে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। বিশেষ করে পেট্রোলবোমার আঘাতে শতাধিক মানুষের মৃত্যু এবং আরও শতাধিক মানুষ আগুনে দ্বগ্ধ হয়ে মৃত্যুমুখে পতিত হওয়ার মতো নেতিবাচক দিকগুলো এখনও দেশের মানুষ ভুলতে পারেনি। তাই আন্দোলনের কথা মনে হলেই মানুষ এখন বিএনপির বিরুদ্ধে এই ধ্বংসাত্মক কর্মকা-ের অভিযোগ উত্থাপন করে। দেশের গ-ি পেরিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গণেও এই নেতিবাচক আন্দোলনের সমালোচনা হয়। আর এ কারণেই এর পর আর বিএনপি আন্দোলনে যাওয়ার সাহস দেখাচ্ছে না। তবে আপাতত আন্দোলনে না গিয়ে তৃণমূল পর্যায়ে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া জেলায় জেলায় জনসংযোগ কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নেয়ার বিষয়টিকে অভিজ্ঞ মহল ইতিবাচক বলে মনে করছে। এর আগে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তি সামনে রেখে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় জনসংযোগ করে সরকারবিরোধী আন্দোলনের যৌক্তিকতা তুলে ধরেন। এরপর ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি রাজধানী ঢাকায় বড় ধরনের সমাবেশ করে সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা করার প্রস্তুতি নেন বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া। ২০ দলীয় জোটের ব্যানারে এ কর্মসূচী সফল করতে ২ দিন আগে অর্থাৎ ৩ জানুয়ারি রাতেই তিনি গুলশান কার্যালয়ে অবস্থান নেন। সেখানে থেকেই তিনি ২০ দলীয় জোটের বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাদের সঙ্গে যোগাযোগ করতে থাকেন। এর আগে থেকেই বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী নয়া পল্টন বিএনপি কেন্দ্রীয় অবস্থান করতে থাকেন। ৩ জানুয়ারি রাত ১১টার দিকে গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকালে খালেদা জিয়ার জানতে পারেন নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে অবস্থানরত রুহুল কবির রিজভী অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। তখন খালেদা জিয়া রিজভীকে দেখতে গুলশান কার্যালয় যেতে চান। কিন্তু খালেদা জিয়া ৫ জানুয়ারির কর্মসূচীকে সামনে রেখে কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে থেকে যাবেন এমন আশঙ্কা থেকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের বাইরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করে এবং তাকে সেখান থেকে বের হতে বাধা দেয়। সেই রাতেই রিজভীকে রাজধানীর বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় এ্যাপোলে হাসপাতালে ভর্তি করে বিএনপি কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। পরদিন ৪ জানুয়ারি খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের সামনের রাস্তায় দুই পাশে ব্যারিকেড দিয়ে র‌্যাব-পুলিশের বিপুল সংখ্যক সদস্য সেখানে অবস্থান করে। এক পর্যায়ে খালেদা জিয়ার কার্যালয় সংলগ্ন ৮৬ নম্বর সড়কের দুইপাশে আড়াআড়িভাবে ইট, বালি ও মাটিভর্তি ট্রাক, প্রিজন ভ্যান, সাজোয়া যান ও জলকামান জড়ো করা হয়। এর ফলে ৫ জানুয়ারি বিএনপির ঢাকায় সমাবেশ করার বিষয়টি অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। ৫ জানুয়ারি দুপুরে খালেদা জিয়ার গুলশান কার্যালয়ের গেটে তালা ঝুলিয়ে দেয়া হয়। বিকেলে গুলশান কার্যালয় থেকে বের হয়ে নয়াপল্টন কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন খালেদা জিয়া। গাড়িতে চড়ে বসলেও পুলিশ গেট খুলে না দেয়ায় গুলশান কার্যালয়ে থাকা মহিলা দলের নেতাকর্মীরা গেটে লাথি মেরে চিৎকার চেচামেচি করতে থাকে। এক পর্যায়ে পুলিশ তাদের ওপর পিপার স্প্রে ছুড়ে মারে। পরে খালেদা জিয়া গাড়ি থেকে নেমে গুলশান কার্যালয়ের ভেতরে গেটের সামনে দাড়িয়ে ২০ দলীয় জোটের পক্ষ থেকে সারাদেশে টানা অবরোধ কর্মসূচী পালনের ঘোষণা দেন। কিন্তু দীর্ঘ ৩ মাস ধরে এ কর্মসূচী চলাকালে বিএনপিসহ ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা মাঠে না নামলেও বিচ্ছিন্নভাবে রাজপথে নেমে পেট্রোলবোমাসহ চলন্ত যানবাহনে ঝটিকা হামলা চালানো হয়। এতে সারাদেশে জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। আর এ নেতিবাচক আন্দোলনটির কারণেই বিএনপি এখনও রাজনৈতিকভাবে চরম বেকায়দায় রয়েছে। অবশ্য সম্প্রতি জাতীয়তাবাদী সাংবাদিক নেতাদের সঙ্গে বৈঠককালে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া বলেছেন, দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আন্দোলন স্থগিত করার সিদ্ধান্ত ভুল ছিল। তার এ বক্তব্যের মধ্য দিয়ে বোঝা যাচ্ছে সারাদেশে জনসংযোগ কর্মসূচীর পর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বিএনপি আবারও আন্দোলনে যেতে পারে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেও বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশের বেশ ক’টি জেলায় জনসভা করে সরকারবিরোধী আন্দোলন জোরদার করার জন্য জনমত তৈরি করেন। ২০১৩ সালের ২৯ ডিসেম্বর মার্চ ফল ডেমোক্রেসি কর্মসূচী ঘোষণা করে সারাদেশ থেকে বিএনপি জোটের নেতাকর্মীদের রাজধানীতে এসে জড়ো হওয়ার ডাক দেন খালেদা জিয়া। তার ডাকে সাড়া দিয়ে ক’দিন আগে থেকেই সারাদেশ থেকে ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীরা ঢাকায় আসার চেষ্টা করেন। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বাধার কারণে ঢাকা আসতে না পেরে তারা নিজ নিজ জেলায় প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। কিন্তু রাজধানীতে অবস্থান করা বিএনপির সিনিয়র নেতারা আত্মগোপনে চলে যাওয়ায় দলের কোনস্তরের নেতাকর্মীরা ২৯ ডিসেম্বর রাজপথে নামার সাহস দেখাননি। তবে ওইদিন বিকেলে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া তার গুলশানের বাসা থেকে বের হতে চাইলেও পুলিশী বাধায় তিনি বাসা থেকে বের হতে পারেননি। এ কারণে মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচী ব্যর্থ হয়। মার্চ ফর ডেমোক্রেসি কর্মসূচী ব্যর্থ হওয়ার পর বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশে ভোটকেন্দ্র ভিত্তিক সংগ্রাম কমিটি গঠন করে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন প্রতিহত করার ঘোষণা দেন। তার ঘোষণার সাড়া দিয়ে দেশের বিভিন্ন জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা নির্বাচনকে বাধাগ্রস্ত করার ব্যাপক চেষ্টা করলেও রাজধানীতে বিএনপির পক্ষ থেকে নির্বাচন ঠেকানোর কোন চেষ্টাই পরিলক্ষিত হয়নি। এ কারণে কেন্দ্রীয় নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ হয়ে সারাদেশের জেলা-উপজেলা পর্যায়ের নেতাকর্মীরা দলীয় কার্যক্রমে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের এক বছর পূর্তিকে সামনে রেখে আবার খালেদা জিয়া জেলা সফর কর্মসূচীর মাধ্যমে তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের সক্রিয় করেন। এর ফলে ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হওয়া ৩ মাসব্যাপী আন্দোলনে ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলায় তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীরা সক্রিয় ছিল। তবে ঢাকায় অবস্থান করা কেন্দ্রীয় নেতাদের ব্যর্থতার কারণে সে আন্দোলনে সফল হতে পারেনি বিএনপি। এ বিষয়টিকে মনে রেখেই খালেদা জিয়া তৃণমূল পর্যায়ের নেতাদের মূল্যায়ন করতে আবার জেলায় জেলায় সফরে গিয়ে জনসংযোগ কর্মসূচী পালনের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন বলে জানা গেছে। এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য লে. জেনারেল (অব) মাহবুবুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া অনেকদিন হলো ঢাকার বাইরে কোন কর্মসূচীতে যাচ্ছেন না। তাই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মনোবল চাঙ্গা করতে তিনি বিভিন্ন জেলা সফরে যাবেন। এ ছাড়া সামনে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন কিন্তু সরকার এখনও নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের বিষয়টি নিশ্চিত করেননি। তাই নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের ব্যাপারে জনমত তৈরি করতে বিএনপি চেয়ারপার্সন খালেদা জিয়া সারাদেশের বিভিন্ন এলাকায় যাবেন।
×