ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

টি ইসলাম তারিক

‘চীনের প্রাচীর’ ডিফেন্ডার আজমত আলী

প্রকাশিত: ০৫:০৪, ৫ এপ্রিল ২০১৭

‘চীনের প্রাচীর’ ডিফেন্ডার আজমত আলী

ছোট বেলায় স্কুলের চাইতে গ্রামের ফুটবল মাঠ তাকে খুব বেশি টানতো। স্কুল থেকে ফেরার পথে ফুটবলে দু’চারটা লাথি মেরে তবেই বাড়ি ফেরা হতো। কোন প্রশিক্ষকের কাছ থেকে ঘটা করে প্রশিক্ষণ নেয়া হয়নি, এরপরও স্কুলের সেই ছোট্ট বয়স থেকেই তার নাম ডাক ছড়িয়ে পড়েছিল একজন দক্ষ ফুটবলার হিসেবে। ফুটবল বোদ্ধারা সে সময়ে তার খেলা দেখে বলেছিলেন ছেলেটি গ্রামের মান রাখবে। বড় হয়ে তাদের কথা রেখেছিলেন তিনি। রেডিওর বিখ্যাত ধারাভাষ্যকার প্রয়াত আব্দুল হামিদ, আতাউল হক মল্লিকসহ সবাই ১৯৮১ সালে ঢাকায় অনুষ্ঠিত আগাখান ফুটবল ফাইনালে তার দুর্দান্ত খেলা দেখে চীনের প্রাচীর হিসেবে আখ্যায়িত করেছিলেন। তিনি আজমত আলী। সাবেক নামকরা ডিফেন্ডার। পাড়া মহল্লায় খেলতে খেলতেই ফুটবলার হিসেবে আত্মপ্রকাশ আজমতের। স্কুল কলেজে এ্যাথলেট হিসেবে পরিচিত পাওয়া আজমত ফুটবলার হিসেবেও পেয়ে যান খ্যাতি। ঢাকার ফুটবলে আসাটা তার কাছে এখনও স্বপ্নের মতোই মনে হয়। এ প্রসঙ্গে তনি বলেন, ১৯৭৬ সালে খ্যাপ খেলতে যাই ময়মনসিংহে। চুক্তি পঞ্চাশ টাকা। বিপক্ষ দলে তৎকালীন ঢাকা মোহামেডানের গোলাম সারোয়ার টিপু, শহিদুর রহমান সান্টু, নওসেরুজ্জামান এবং হাফিজ ভাইয়ের মতো সব নামকরা খেলোয়াড়। ওই ম্যাচে আমার দল হেরে যায় ৫-৩ গোলে । তবে আমার দল একটা পেনাল্টি পেলে কেউ এগিয়ে যায়নি সেটা মারার জন্য। কারণ গোলপোস্টে ছিলেন দেশ সেরা সান্টু। আমি সাহস নিয়ে এগিয়ে যাই। সান্টু গ্যালারি সো করার কাজে ব্যস্ত। ঠিক এই সুযোগটাই কাজে লাগাই আমি। গোলে শূট নেই এবং গোল করি। খেলা শেষে বখশিস পাই ৮০০ টাকা। যা আজও আমাকে বিস্মিত করে তোলে। এর কিছুদিন পরেই ঢাকাতে আরেক ফাইনাল। বিজেএমসির গোলরক্ষক করিম ভাইকে নিয়ে মালা ভাই আমাকে নিয়ে যান লালবাগ। আমাকে মাঝ মাঠে খেলানো হয় । আমরা ৩-১ গোলে জয়লাভ করি। যার তিনটা গোলই আমি করেছিলাম। সেখানে উপস্থিত ছিলেন ঢাকা মোহামেডানের অনেক কর্মকর্তা। তারা আমার খেলা দেখার পর আমাকে ঢাকা মোহামেডানে খেলার আমন্ত্রণ জানান। সেই থেকে ঢাকা লীগে আমার পদচারণা। তার ফুটবলার হওয়ার পেছনে পরিবারের গুরুত্ব তুলে ধরে আজমত বলেন, আমি বাবার কাছ থেকে উৎসাহ পেয়েছি। আমাদের বড় সংসার। ভাইবোন মিলে আমরা ১২ জন। বাবা কৃষিকাজ করতেন। টানাটানির সংসারে বাবা আমাদের পড়াশুনা করাবেন নাকি কোন কাজে উৎসাহ যোগাবেন সেটা ভাবার সময় ছিল না । তবুও যখন শুনতেন আমি ভাল খেলতাম তখন বাবা খুশিই হতেন। আমার বাবা ঢাকা মোহামেডানের সমর্থক ছিলেন। বাবা বলতেন মেহামেডান হাহ হাহ হাহ। বর্তমানে বাংলাদেশ ফুটবলের করুণ চিত্র দেখে আজমত হতাশা ব্যক্ত করেন। তিনি জানান, তাদের সময় সারাদেশে নিয়মিত ফুটবল লীগ হতো। লীগ বা বিভিন্ন টুর্নামেন্ট থেকে অনেক খেলোয়াড় বের হয়ে আসত। এখন একমাত্র ঢাকা ছাড়া কোথাও নিয়মিত লীগ বা টুর্নামেন্ট হয় না। এখন ক্রমেই সে সুযোগ হারিয়ে যাচ্ছে। একাডেমির বিষয়ে তিনি জানান, শুধু একাডেমি করলেই হবে না, জেলায় জেলায় নিয়মিত লীগ আয়োজন করতে হবে। বিভিন্ন জেলায় ফুটবল লীগ বা টুর্নামেন্ট হলো খেলোয়াড়দের মাপকাঠি। তবে খেলোয়াড়দেরও খেলার প্রতি বেশি মনোযোগী হতে হবে, কঠোর অনুশীলন করতে হবে। জেদ এবং একাগ্রতা থাকা জরুরী। এ প্রসঙ্গে আজমত একটা মজার ঘটনার কথা উল্লেখ করেন । তিনি জানান, ছোট বেলায় পড়াশুনায় ফাঁকি দিতাম বলে বড় ভাই খুব রাগ করতেন। একদিন বড় ভাই রাগ করে আমার খেলার বুট জোড়া আমার সামনেই পুড়িয়ে দেন। আমার মাথা খারাপ হয়ে যাবার উপক্রম। আমি রাগে বাসায় কাউকে না জানিয়ে রাজমিস্ত্রির কাজ করি ছয় টাকা রোজে। পরে টাকা জমিয়ে ঠাঠারি বাজার থেকে বুট বানিয়ে নেই। আমি কি কাজ করে বুট কেনার টাকা রোজগার করছি সেটা ভাবিনি, প্রয়োজন বুট কেনার টাকা। আমার জিদ ছিল বলেই খেলোয়াড় হিসেবে আত্মপ্রকাশ করতে পেরেছিলাম। চালচলনে অত্যন্ত সাদামাটা এবং সবসময় হাসি খুশি থাকতেই পছন্দ করেন আজমত। কখনও কোন অন্যায় কিংবা অন্যায়ের সাথে আপোস করেননি। স্মরণীয় মুহুর্তের কথা জিজ্ঞেস করতেই সোজা উত্তর ১৯৮১ সালের আগাখান ফুটবলে ব্রাদার্সের হয়ে ব্যাংকক ব্যাংক ক্লাবের সাথে যুগ্মচ্যাম্পিয়নের স্বাদ এবং একই বছর উত্তর কোরিয়ার সাথে সেমিফাইনালে জয়লাভ করে ফাইনালে যাওয়া তার জীবনের সবচাইতে স্মরণীয় মুহূর্ত। পুরস্কারের বিষয়ে তিনি জানান, গাজীপুর জেলার পক্ষ থেকে গাজীপুরের সেরা ফুটবলারের পুরস্কার পেয়েছেন ১৯৮৭ সালে । তাছাড়া সম্প্রতি ব্যতিক্রমধর্মী মোহামেডান সমর্থক দল মহাপাগল কর্তৃক সন্মাননা স্মারক পেয়েছেন এ বছর। হাসতে হাসতে জানান সবচাইতে দামি পুরস্কারটা পেয়েছিলাম ১৯৮৩ সালে। কিভাবে সেটা জিজ্ঞেস করতেই এক সময়ের জাদরেল ডিফেন্ডার আজমত আবেগ ধরে রাখতে না পেরে হু হু করে কেঁদে ওঠেন। তিনি জানান, ১৯৮৩ সালের ঘটনা। মোহামেডান-আবাহনী ফেডারেশন কাপ ফাইনাল। টান টান উত্তেজনা। আমি সে ম্যাচে দুর্দান্ত খেলি। আমরা ২-০ গোলে জয়লাভ করি। আমার বাবা সেদিন রাতে চিটাগং যাবার জন্য কমলাপুর স্টেশনে ভিড় ঠেলে ট্রেনে উঠার চেষ্টা করছেন। চিটাগং থেকে ফাইনাল খেলা দেখতে আসা মোহামেডান-আবাহনীর সমর্থকরাও ঠেলা ঠেলি করে ট্রেনে উঠার চেষ্টা করছেন। এক সমর্থক বলছেন, ‘আইজ আজমইত্তা যা দেখাইসে’। আরেকজন বলছেন, ‘এই আজমত হালায় ভ্যাজালডা লাগাইসে’। বাবা ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করেন, আজমতের কি হয়েছে? তারা উত্তরে বলেন, ‘আরে চাচা আইজ আবাহনীর বিরুদ্ধে আজমত একাই খেলছে, আবাহনীর এক হালারেও কাছে ভিড়তে দেয় নাই’। এরপর যখন তারা বুঝতে পারেন উনি আজমতের বাবা তখন তারা তাকে অনেক সম্মান করেন, বসতে দেন। আজমত ক্রন্দনরত অবস্থায় জানান, বাবাকে কিছুই দিতে পারি নাই কিন্তু এই সামান্য সন্মানটুকু পেয়ে বাবা আমাকে বহুদিন এই গল্পটা শুনিয়েছিলেন। বাবা বলেছিলেন আজমত আইজ থাইকা তোরে মাফ কইরা দিলাম। চোখ মুছতে মুছতে বলেন, পৃথিবীতে এর চাইতে বড় পুরস্কার আর কি হতে পারে। ঢাকার মাঠে আপনাকে অন্য একটি নামে ডাকা হতো সেটা আপনার মনে আছে? খুব সাবলিলভাবে উত্তর দেন, ‘দমের ডিব্বা’ হাহ হাহ হাহ । এ প্র্রসঙ্গে একটি মজার কাহিনী শোনাান। সালটা মনে হয় ১৯৮৪ হবে। ঈদ আনন্দ মেলায় একবার আমিসহ মোহামেডানের আবুল আর গোলী মোহসিন অন্যদিকে আবাহনীর চুন্নু, গাফফার আর অলোককে আমন্ত্রণ জানায় । পিছনে হাত বেঁধে পাইপ দিয়ে কোক খেতে হবে। আমার অভ্যাস ছিল ডাব খাওয়া। যাই হোক আমি এক টানে সবার আগেই যখন খাওয়া শেষ করে ফেলি তখন সবায় অর্ধেক শেষ করেছে। সেখানে আবারও আমার দমের পরীক্ষা হয়ে যায়। এর সাথে আর যোগ করেন ফুটবল খেলোয়াড় হতে হলে অফুরান্ত দমের প্রয়োজন। আজকাল খেলোয়াড়রা শেষ ২৫/৩০ মিনিট দাঁড়িয়ে সময় কাটায়। আজমত ব্রাদার্সে বেশিরভাগ সময় খেললেও ঢাকার মাঠে আবির্ভাব ১৯৭৭ সালে মোহামেডানের হয়ে। খেলা প্রিয় মানুষগুলো যখন মোহামেডানের আজমত বলে তখন তার গর্বে বুকটা ভরে যায়। আজমত জাতীয় দলে খেলেছেন ১৯৮১ সাল থেকে ১৯৮৮ পর্যন্ত। ১৯৮৫ সালে বাংলাদেশ সবুজ দলের অধিনায়ক ছিলেন প্রেসিডেন্ট গোল্ড কাপে । তাছাড়া ১৯৮৬ সালে ( পাকিস্তান প্রেসিডেন্ট কাপ) এবং ১৯৮৭ সালে ( লাহোরে কায়দে আজম ট্রফি) বাংলাদেশের ফুটবলের অধিনায়কত্ব করেন। ফুটবল খেলে আপনি কি তৃপ্ত? আজমত বলেন, কেউ যদি পাওয়ার আশায় খেলে তাহলে সে কখনই তৃপ্ত হতে পারবে না । আমি খেলেছি খেলার জন্য। পাওয়ার চিন্তা মনের মধ্যে কখনই আনি নাই। আল্লাহর রহমতে আমি না চাইতেই অনেক পেয়েছি। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, আগের গানের শিল্পীদের কথা ভেবে দেখেন। ভারতের মান্না দে, কিশোর কুমার, হেমন্ত, আমাদের দেশের আব্দুল আলিম, সাবিনা ইয়াসমিন, রুনা লাইলা, আব্দুল জব্বার তাদের নাম মানুষ ভুলে নাই। কখনও ভুলবেও না। আর আজকাল শিল্পীদের নাম কয়জন মনে রাখে বলেন। সবকিছুর ক্ষেত্রেই তাই। আপনি যদি কিছু দিয়ে যেতে পারেন তবেই আপনাকে মানুষ মনে রাখবে। আর এই মনে রাখাটাই পাওয়া। তিনি আরও যোগ করে বলেন, আমার বাড়ির সামনের রাস্তাটা আগে খুব করুণ অবস্থায় ছিল। ভাল খেলোয়াড় ছিলাম বলেই আমার অনুরোধে তৎকালীন পৌরসভার চেয়ারম্যান বর্তমান মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক সে রাস্তাটি পাকা করে দিয়েছিলেন। এটাও আমার জীবনের একটা বড় অর্জন । ভাওয়াল রাজার এলাকা গাজীপুরে আজমতের জন্ম। তবে রাজ পরিবারের কেউ নন। রাজার রাজমুকুট পরা হয়নি ঠিকই কিন্তু ফুটবলের রাজতিলক কপালে এঁটেছিলেন। ফুটবলের অদম্য নেশার কাছে কোন কিছুতেই তিনি হার মানতে নারাজ ছিলেন। আর তাইতো বড় ভাই রাগ করে তার বুট পুড়িয়ে ফেলা সত্ত্বেও বাসার কাউকে না জানিয়ে দৈনিক ছয় টাকা রোজে চুপি চুপি রাজমিস্ত্রির কাজ করেছিলেন বুট ক্রয়ের জন্য। পাওয়া না পাওয়ার হিসেব কখনও মেলাবার চেষ্টা করেননি। অল্পতে তুষ্ট আজমত আলী সমর্থকদের যে ভালবাসা পেয়েছেন সেটা তার সারাজীবনের সঞ্চয় বলেই মনে করেন। এমন অফুরন্ত দম আর জেদি খেলোয়াড় বাংলাদেশ ফুটবলের জন্য আজ বড্ড বেশি প্রয়োজন । আজমত আলী স্ত্রী আর দুই ছেলে নিয়ে গাজীপুর হাড়িনাল এলাকায় বসবাস করেন। বড় ছেলে মোঃ আজিজুল হক জরীপ দেশের বাইরে পড়াশুনা শেষ করে বর্তমানে দেশে একটি ব্যাংকে কর্মরত আছেন। ছোট ছেলে মোঃ আহসানুল হক অর্নব ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে ট্রিপল ই’তে পড়াশুনা করছেন।
×