ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক

বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব রক্ত দিয়ে লেখা

প্রকাশিত: ০৪:১৯, ৫ এপ্রিল ২০১৭

বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব রক্ত দিয়ে লেখা

আমাদের প্রধানমন্ত্রী ভারতে রাষ্ট্রীয় সফরকালে তাঁকে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভবনে থাকার ব্যবস্থা করে সে দেশের সরকার যে বিরল সম্মাননা প্রদর্শন করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে তার থেকে প্রমাণ হয় ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্বকে উচ্চতম অবস্থানে রাখতে চায়। বস্তুত, ভারত-বাংলাদেশ বন্ধুত্বের সঙ্গে পৃথিবীর অন্য কোন প্রতিবেশী দেশের বন্ধুত্বকে এক মাপকাঠিতে বিচার করা যায় না। কেননা বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব একান্তই তুলনাহীন। এ বন্ধুত্ব রক্ত দিয়ে লেখা। গত ২৬ জানুয়ারি দিল্লীতে অনুষ্ঠিত ভারত-বাংলাদেশ সহযোগিতা সম্মেলনে ভাষণদানকাল সাবেক সেনাপ্রধান লে. জেনারেল হারুন বলেছেন, ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দেয়ার পর বাঙালী সৈন্যদের মনে প্রশ্ন জেগেছিল তারা কি করে অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত পাকি সৈন্যদের মোকাবেলা করবেন! আর ঠিক তখনই দেবদূতের মতো আবির্ভূত হয়েছিলেন শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। বাংলাদেশে পাকিরা গণহত্যা শুরু করার দু’দিন পর ২৭ মার্চ শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের প্রতি পূর্ণাঙ্গ সমর্থন ব্যক্ত করেন এবং ৩১ মার্চ মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় কামনা করে নিজ লোকসভায় প্রস্তাব উপস্থাপন করেন, যা সর্বসম্মতিক্রমে অনুমোদিত হয়। এপ্রিল মাস থেকেই ভারতীয় সেনাবাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র প্রদান শুরু করে। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ, অস্ত্র প্রদান এবং মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে থেকে পাকবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার মধ্যেই ভারতের অবদান সীমাবদ্ধ ছিল না। ভারত নিজের অর্থনীতি, এবং এমনকি নিরাপত্তাকে ঝুঁকির মুখে ঠেলে দিয়ে ১ কোটির অধিক বাংলাদেশের উদ্বাস্তুকে আশ্রয় এবং আহার দিয়েছিল, যা বিশ্বে নজিরবিহীন। শুধু তাই নয়, শ্রীমতী গান্ধী মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে এবং পরবর্তীতে পাকিস্তানী কারাগার থেকে বঙ্গবন্ধুর মুক্তির দাবিতে, এমনকি আন্তর্জাতিক সমর্থন আদায়ের জন্য সারাবিশ্ব ভ্রমণ করেছেন নিরলসভাবে। মার্কিন এবং চীনা আগ্রাসন ঠেকানোর জন্য সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে চুক্তি করেছেন, যার ফলে নিরাপত্তা পরিষদে ভোট দিয়ে সোভিয়েত ইউনিয়ন মুক্তিযুদ্ধ বন্ধ করার প্রচেষ্টা রুদ্ধ করেছিল, মার্কিন ৭ম নৌবহরের আবির্ভাব বন্ধ করেছিল। আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের পাশে দাঁড়িয়ে ভারতের ১৬ হাজার সৈন্য প্রাণ দিয়েছেন, প্রাণ দিয়েছেন ৪শ’ অফিসার, আহত হয়েছেন কয়েক সহস্র। আমরা ভারতের এহেন অবদান ভুলে যাওয়ার মতো অকৃতজ্ঞ জাতি নই। ১৯৭২-এর ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, ‘আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের জনগণ এবং ভারত সরকারের অবদানের কথা বাংলাদেশের মানুষ কখনও ভুলবে না।’ বাংলার মানুষ যে তা ভোলেনি তার বড় প্রমাণ খুব শীঘ্রই স্বয়ং আমাদের প্রধানমন্ত্রী দিতে যাচ্ছেন মুক্তিযুদ্ধে ভারতের যেসব সেনা শহীদ হয়েছেন তাদের সম্মাননা প্রদান করে। ইতোপূর্বে ২০১১ সালের জুলাই মাসে শ্রীমতী গান্ধীকে সর্বোচ্চ সম্মাননা প্রদানও ছিল কৃতজ্ঞতা প্রকাশের আর এক উজ্জ্বল উদাহরণ। বছর কয়েক আগে এক অনুষ্ঠানে মেজর জেনারেল (অব.) আব্দুর রশিদ ভারতীয় শহীদ সৈন্যদের স্মৃতি রক্ষার্থে স্মৃতিসৌধ নির্মাণের দাবি তুলেছিলেন। আশা করি অচিরেই তা হবে। আমরা এ কথা ভুলে যেতে পারি না যে, ভারতের সাহায্য ছাড়া আমাদের বিজয় কঠিন হতো, বিলম্বিত হতো, আরও অনেক রক্ত ক্ষয় হতো, ধ্বংসযজ্ঞ আরও ব্যাপক হতো। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই ’৭১-এর পরাজিত শত্রুরা ভারতবিরোধী মিথ্যাচার দিয়ে জনগণকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করে। ’৭৫-এর আগস্টের পর তারা পাকি চর জিয়াউর রহমানের ছত্রছায়ায় একত্রিত হয়ে যে রাজনীতি শুরু করে তার একমাত্র পুঁজি ছিল ভারতবিরোধিতা। এর পেছনে একমাত্র কারণ ছিল এই ভারত আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সহায়ক শক্তি হিসেবে পাকিপ্রেমীদের মোহ ভেঙ্গে দিয়েছিল। ৯৩ হাজারের অধিক পাকি সৈন্যের পরাজয় এবং আত্মসমর্পণ ’৭১-এর ওই পাকিপ্রেমী পরাজিত শক্তি মেনে নিতে পারেনি। তাই বলেই তো জিয়া সোহ্রাওয়ার্দী উদ্যানের চেহারা পাল্টে দিতে চেয়েছিল, সেখান থেকে গুঁড়িয়ে দিয়েছিল বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে তৈরি ইন্দিরা মঞ্চ এবং ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এলাকা। দুর্ভাগ্যবশত এই পাকিপ্রেমীরা বহু বছর ক্ষমতায় থাকার কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধে ভারতের অবদান স্বীকার করতে তো দেয়ইনি, বরং ভারতের নিরাপত্তা বিঘিœত করার জন্য ভারতীয় বিচ্ছিন্নবাদীদের বাংলাদেশের ভূমি ব্যবহার করতে দিয়েছে, তাদের অস্ত্র এবং প্রশিক্ষণ দিয়েছে এবং ১০ টাক অস্ত্র তাদের জন্য পাঠিয়ে পাকি মনিবদের খুশি করে বাংলা-ভারত সম্পর্ক নষ্ট করার চেষ্টা করেছে। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের দল ক্ষমতায় ফিরে আসার পরই আবার ভারতের সঙ্গে আমাদের কষ্টিপাথর পরীক্ষিত বন্ধুত্ব সর্বোচ্চ উচ্চতায় চলে গেছে। যার ফলে এ সরকার সৌহার্দ্যপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে গঙ্গার পানি চুক্তি, সমুদ্রসীমা, ছিটমহল প্রভৃতি সমস্যা সমাধান করতে পেরেছে। পেরেছে ভারত থেকে বিদ্যুত আমদানি করতে, পেয়েছে সহজশর্তে ভারতীয় ঋণ। তবে তিস্তা সমস্যা এখনও রয়ে গেছে। এর সমাধানও সময়ের ব্যাপার বলেই মনে হচ্ছে। তাছাড়া প্রধানমন্ত্রীর সফরকালে গঙ্গা ব্যারাজ চুক্তিও হতে পারে বলে শোনা যাচ্ছে, যা বাংলাদেশ এক কৃষি বিপ্লব ঘটাতে পারবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন, সাংবাদিক শাহরিয়ার কবির এবং ভারতীয় দু’জন মন্ত্রীসহ উভয় দেশের বেশ কয়েকজন দিল্লী সম্মেলনে বলেছিলেন, আমাদের চিরন্তন বন্ধুত্বের অন্যতম ভিত্তি হচ্ছে অভিন্ন সংস্কৃতির বন্ধন। ভারতীয় মন্ত্রী শ্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান এবং স্মৃতি ইরানি বলেছিলেন, রবীন্দ্রচর্চা ভারতের চেয়ে বাংলাদেশেই বেশি হয় অত্যন্ত সত্য কথা। এমনকি পাকিস্তানী ঔপনিবেশিকরা বহু চেষ্টা করেও আমাদের মাঝে থেকে রবীন্দ্রনাথকে বিদায় করতে পারেনি, পারেনি নজরুলকে মৌলবাদী কবি হিসেবে প্রদর্শন করতে, পারেনি জীবনানন্দ, ডিএল রায়, অতুল প্রসাদ, মাইকেল, শরৎ, বঙ্কিম, বিদ্যাসাগর, লালন চর্চা বন্ধ করতে, পারেনি উত্তম-সুচিত্রা, শাবানা আজমী, ওয়াহিদা রহমানের ছবি দেখা বন্ধ করতে, পারেনি হেমন্ত, সন্ধ্যা, শ্যামল, মানবেন্দ্র, লতা, গীতা দত্ত, কিশোর, মান্না, মোঃ রফি, চিন্ময়, দেবব্রত, কণিকার গান শোনা বন্ধ করতে। রবীন্দ্রনাথ এবং সত্যজিৎ রায় যেমন ভারতের গর্ব, ঠিক তেমনি আমাদেরও গর্ব। মুনতাসীর মামুনের উক্তি পুনরুল্লেখ করে বলতে চাই কোন শক্তিই এই ভিত্তি ভাঙতে পারবে না। বাংলা-ভারত বন্ধুত্ব অবশ্যই চিরস্থায়ী হবে। আমরা আরও গর্বিত হবো সেদিন যেদিন ভারত নিরাপত্তা পরিষদের স্থায়ী সদস্য হবে। কেননা, তার সুবিধা তো আমরাও পাব। ভারত থেকে অধিক সুবিধা আদায় করার জন্যই ভারতের সঙ্গে সৌহার্দ্যপূর্ণ সম্পর্ক জোরদার করা আবশ্যক। ভারতীয় বিচ্ছিন্নতাবাদীদের জন্য অস্ত্র পাঠিয়ে, ভারতীয় রাষ্ট্রপতিকে অবমাননা করে, পাকি আইএসআই-এর লোকদের যারা বাংলাদেশে ঘাঁটি বানাতে দিয়েছিল তারা শুধু ভারত-বাংলা সম্প্রীতিই নষ্ট করেনি, তারা বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতিও করেছে। পাকিদের কথা অনুসরণ করে ভারতবিরোধী অবস্থানে না গেলে অনেক আগেই অনেক সমস্যার সমাধান করতে পারত বিগত বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার। ভারত আমাদের সর্বোচ্চতম অকৃত্রিম বন্ধু। এ বন্ধুত্বে ফাটল ধরানোর কোন অপচেষ্টাই অতীতে যেমন সফল হয়নি, ভবিষ্যতেও তা সফল হবে না। লেখক : আপীল বিভাগের সাবেক বিচারপতি
×