ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

ফারিহা হোসেন প্রভা

‘সাহসী নারী’ শারমিনকে নিয়ে কিছু কথা

প্রকাশিত: ০৪:১৮, ৫ এপ্রিল ২০১৭

‘সাহসী নারী’ শারমিনকে নিয়ে কিছু কথা

যুগে যুগে কালে কালে সমাজে-সংসারে, পাড়া-মহল্লা, গ্রাম-গঞ্জে, শহরে-বন্দরে, লোকালয়ে, দেশে দেশে সাহসী, উদ্যমী, কর্মঠ মানুষ জš§ায়। সময়ের প্রয়োজনে, যুগের প্রয়োজনে তারাই সমাজ, সংসার, পরিবার, রাষ্ট্রকে মুক্তির, কল্যাণের, উন্নয়নের পথ দেখান। এ দেশে নারী শিক্ষার প্রসারে, নারীদের চার দেয়ালের বন্দীদশা থেকে মুক্তি দিতে নিরন্তর, নিরলস, নির্মোহভাবে যেসব মানুষ কাজ করে যাচ্ছেন, কাজ করেছেন অতীতে তারা আমাদের নমস্য, স্মরণীয়, বরণীয়। তবে পরিবারে, সমাজে, সংসারে, রাষ্ট্রে এ ধরনের মানুষ খুব একটা বেশি থাকেন না। তারা সংখ্যায় স্বল্প, নগণ্য। কিন্তু তাদের কাজ, কথা, পদক্ষেপ সময়, কাল-স্থান, পরিবার, সমাজ সংসার, রাষ্ট্রের গ-ি ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ে বিশ্বপরিম-লে। এ ধরনের মানুষের কথা আসলেই বলতে হয়, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের অন্যতম পুরোধা, চট্টগ্রামের বিপ্লবী সূর্য সেনের সহযোগী অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদার, রাজা রামমোহন রায়, কবি ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, কবি সুফিয়া কামাল, পাকিস্তানের কিশোরী মালালা ইউসূফ জাই, নারী শিক্ষা ও জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়া শাখাওয়াত হোসেন, বেগম পত্রিকার সম্পাদক নূরজাহান বেগম প্রমুখ। তারা সকলেই আমাদের নমস্য, ইতিহাসে তাদের আসন চিরস্থায়ী। একই সঙ্গে আমাদের জন্য তাদের আদর্শ, ত্যাগ, অবদান পথপ্রদর্শক হিসেবে যুগ থেকে যুগান্তর, কাল থেকে কালান্তর পর্যন্ত। তারা নিরবধি আলোকবর্তিকা হিসেবে অনুপ্রেরণা, উৎসাহ, সাহস যোগাবেন। ঠিক তেমনি একজন সাহসী কন্যা দেশের প্রত্যন্ত জেলা ঝালকাঠির শারমিন আক্তার। শারমিন তার নিজের বাল্যবিয়ে ঠেকিয়ে বিশ্বজুড়ে প্রশংসিত হয়েছেন। তার সেই সাহসী ভূমিকার জন্য সম্প্রতি যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কাছ থেকে বিশ্বের অন্যতম ‘সাহসী নারী’র সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন। সম্প্রতি ওয়াশিংটনের ডিন এচেসন মিলনায়তনে ফার্স্টলেডি মেলানিয়া ট্রাম্প তার হাতে ‘ইন্টারন্যাশনাল উইমেন অব কারেজ এ্যাওয়ার্ড’ পদক তুলে দেন। এই তথ্যটি যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতরের ওয়েবসাইটের। যুক্তরাষ্ট্রের রাজনীতি বিষয়ক আন্ডার সেক্রেটারি থমাস শ্যাননের উপস্থাপনায় ওই অনুষ্ঠানে শারমিনের সঙ্গে বিভিন্ন দেশের আরও ১২ জন নারীকে এই সম্মাননা দেয়া হয়। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে মেলানিয়া বলেন, ‘যখনই নারীর অধিকার খর্ব করা হয়, সঙ্গে সঙ্গে পৃথিবী নিজেও অনেকটা খর্ব হয়ে পড়ে। খর্ব হয়ে পড়ে মানবতা, মানবাধিকার। আর যখনই পৃথিবীর কোথাও কোন নারী ক্ষমতায়িত হয়, সম্মানিত হয়, পুরস্কৃত হয় তখন আমরাও তাদের সঙ্গে সম্মানিত, পুরস্কৃত ও শক্তিশালী হয়ে উঠি। সম্মাননা পাওয়াদের মধ্যে বতসোয়ানার মালেবোগো মালেফে ও কলাম্বিয়ার নাতালিয়া পনসে দো লিয়ো অনুষ্ঠানে নিজেদের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন অনেকটা শারমিনের মতো। এর আগে বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাসের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, মাত্র ১৫ বছর বয়সে জোরপূর্বক বিয়ে ঠেকিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার কিশোরীদের জন্য দৃষ্টান্ত সৃষ্টি করায় এই বছর শারমিন আক্তারকে ‘সাহসী নারী’ পুরস্কার দেয়া হয়। ২০১৫ সালের আগস্টের ওই ঘটনায় শারমিন তার মা এবং ৩২ বছর বয়সী ‘হবু স্বামী’ প্রতিবেশী স্বপন খলিফার বিরুদ্ধে মামলাও করেছিলেন। শারমিনের মা গোলনূর মেয়েকে বিয়ে দেয়ার জন্য চাপ দিয়েও রাজি করাতে পারেনি বলে গণমাধ্যমে খবর বেরিয়েছে। এরপর মিথ্যা কথা বলে খুলনায় নিয়ে গিয়ে স্বপনের সঙ্গে মেয়েকে একঘরে আটকে রাখারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে। পরদিন সেখান থেকে কৌশলে পালিয়ে গেলেও ধরা পড়ে যান শারমিন। এরপর তাকে ঝালকাঠিতে নিজের বাড়িতে আটকে রাখা হয়। ওই বছরের ১৬ আগস্ট শারমিন ফের বাড়ি থেকে পালিয়ে এক সহপাঠীকে নিয়ে থানায় গিয়ে মামলা করেন। পুলিশ গোলনূর ও স্বপনকে গ্রেফতার করার পর আদালত শারমিনকে দাদির জিম্মায় দেয়। বিশ্বের মধ্যে বাংলাদেশ এখনও বাল্যবিয়ের হারে অন্যতম শীর্ষ একটি দেশ। এ ধরনের বিয়ে লাখো কিশোরীর স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও শিক্ষায় হুমকি হয়ে দেখা দেয়, যা দেশগুলোর উন্নয়ন, অগ্রগতি, অগ্রযাত্রাকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। এ প্রসঙ্গে আমাদের দেশের সব মায়ের উদ্দেশ্যে বলা দরকার যে, কোন মা যেন এভাবে অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়েকে বাল্যবিয়ে না দেন। বাল্যবিয়ের কুফল, ক্ষতিকর দিকগুলো নিয়ে ব্যাপক জনসচেতনতা গড়ে তোলা জরুরী। বাল্যবিয়ে হলে একদিকে জনসংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায়, অন্যদিকে অকালে অল্প বয়স্ক মেয়ে মা হয়ে অসময়ে নানা রোগে আক্রান্ত হয়। আবার বহু অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারী সন্তান জš§দানের সময় মৃত্যুবরণ করেন। এভাবে শিশু ও মাতৃমৃত্যু বাড়ে। আবার বেঁচে থাকা অপ্রাপ্ত বয়স্ক নারীদের জীবনের ঝুঁকিও বাড়ে। এসব বিবেচনায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকার নিরন্তর কাজ করছেন। চালাচ্ছেন ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা। বাল্যবিয়ে নিরোধে আইনও করা হয়েছে। কিন্তু এতসব করা শর্তেও ঠেকানো যাচ্ছে না বাল্যবিয়ে। এ জন্য প্রয়োজন দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, পাড়া-মহল্লায়, হাটে, ঘাটে বাজারে, শহরে, বন্দরে, বস্তিতে, মসজিদে, মন্দিরে, গির্জায়, প্যাগোডায় আলোচনা। সম্মিলিতভাবে এসব করা গেলে জাতি বাল্যবিয়ের অভিশাপ থেকে পরিত্রাণ পাবে। বাঁচবে অসংখ্য অপ্রাপ্ত বয়স্ক কিশোরীর জীবন, স্বপ্ন প্রভৃতি। তবেই সার্থক হবে ঝালকাঠির শারমিনের অবদান এবং তার অনন্য সাধারণ সাহসী ভূমিকা। একই সঙ্গে প্রত্যাশা থাকবে দেশের প্রতিটি কিশোরী কন্যা নিজেদের শারমিনের মতো সাহসী ভূমিকায় অবতীর্ণ করাবেন বাল্যবিয়েসহ সর্ব প্রকার সামাজিক অনিয়ম, অনাচার, ইভটিজিং, কুসংস্কারের বিরুদ্ধে। শারমিন তথা তাদের এই কর্মযজ্ঞে পেছন থেকে পুরুষ সমাজ সহায়তা দেবেন, সাহস যোগাতে এগিয়ে আসবেন।
×