ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

সেবার হাত

প্রকাশিত: ০৪:১৭, ৫ এপ্রিল ২০১৭

সেবার হাত

সেবার জায়গা যদি হয়ে যায় ব্যবসাকেন্দ্র, তবে সেবামুখী অবস্থা আর থাকে না তার। জীবন নিয়ে ব্যবসার এই ধারাগুলো মূলত মানবতাবিবর্জিত হয়ে ওঠে। মানুষের জীবন নিয়ে ব্যবসা করার মধ্যে জনকল্যাণ কাজ করে না। বরং মানুষের মনুষ্যত্বের অবমাননাও করা হয়। সেবাকে যারা পরিণত করে ব্যবসায়, তারা সেবার প্রতি অবহেলাই করে অবলীলায়। মানুষকে বাঁচিয়ে রাখার উপকরণ যদি না হয় সুলভ ও সহজলভ্য এবং সেবা যদি হয় অধরা, তবে তার মৌলিক অধিকার আর রক্ষা হয় না। মানুষের যে পাঁচটি মৌলিক অধিকার রয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম স্বাস্থ্য। সেই স্বাস্থ্যই যদি হয় দুর্বল এবং ভুগতে হয় অপুষ্টির ভারে, আর পরিকল্পিত পরিবার প্রথা না থেকে জনসংখ্যার আধিক্য ঘটে, তখন জনস্বাস্থ্য অবনতিশীল হতে বাধ্য। স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টির সমন্বিত ক্ষেত্রগুলো যদি বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে পরিচালিত হতে না পারে, তবে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন ও স্বাস্থ্য খাতে স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সুকঠিন। জনস্বাস্থ্য রক্ষায় চিকিৎসা ব্যবস্থার যেমন উন্নতি জরুরী, তেমনি অপুষ্টি দূরীকরণে সার্বিক পদক্ষেপ নেয়াও একান্তই আবশ্যক। সেইসঙ্গে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণের কাজটিও যথাযথ হওয়া অতীব প্রয়োজন। স্বাস্থ্য খাতের কয়েকটি সূচকে বাংলাদেশ সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য (এমডিজি) অর্জন করতে পেরেছে। তবে নারী ও শিশুর অপুষ্টি, খর্বাকৃতি, ওজনহীনতার মতো সূচকগুলোতে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জিত হয়নি। দেশের প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার উন্নয়ন ফি বছর বরাদ্দ বাড়ছে। এর আগে স্বাস্থ্য ও জনসংখ্যা এবং পুষ্টি সেক্টর উন্নয়ন কর্মসূচী নেয়া হয়েছে তিন দফা। চতুর্থ পর্যায়ে এ বছর বরাদ্দ করা হয়েছে এক লাখ পনেরো হাজার চার শ’ ছিয়াশি কোটি টাকা। এমন বিপুল অর্থ যথাযথভাবে ব্যয় করা হলে এই তিনটি খাত লক্ষ্য অর্জনে যথেষ্ট ভূমিকা রাখতে পারে। ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত এই কর্মসূচী বাস্তবায়ন করা হবে। সদ্য সমাপ্ত তৃতীয় দফা কর্মসূচীতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাতান্ন হাজার কোটি টাকা। কিন্তু কাক্সিক্ষত লক্ষ্য তাতে অর্জন করা গেছে এমনটা নয়। কারণ যথাযথভাবে অর্থ ব্যয় করা না গেলে কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন সম্ভব হয় না। এসব প্রকল্পে দুর্নীতি, অনিয়ম, অব্যবস্থাপনা, অদক্ষতা, অবহেলা, উদাসীনতার মাত্রা অত্যধিক। ফলে লক্ষ্যে পৌঁছানোর আগেই পথে পথে অনিয়ম মাথাচাড়া দিয়ে ওঠে। এমনিতে পুষ্টি সূচকে দক্ষিণ এশিয়ার সার্কভুক্ত আটটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। বিশেষ করে পুষ্টি পরিস্থিতিতে ভারত ও পাকিস্তানের চেয়ে এগিয়ে আছে বাংলাদেশ। তবে বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সার্বিক পুষ্টি সূচকের আরও উন্নতি করা যে প্রয়োজন তা বিবেচনায় নেয়া সঙ্গত। অবস্থা পরিবর্তনের জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন কিশোরীদের পুষ্টি পরিস্থিতির উন্নতি করা। অবশ্য অপুষ্টিতে শিশুমৃত্যু হার অনেক কমেছে। যাতে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্য দেশের তুলনায় ভাল করেছে। কিন্তু এতে আত্মসন্তুষ্টি লাভ করার মাজেজা তেমন নেই। দেশের মা ও শিশুদের পুষ্টিহীনতা রোধে সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমন্বয়হীনতার কারণে অপুষ্টি দূর করতে গৃহীত কর্মসূচীসমূহ পুরোপুরি বাস্তবায়ন হচ্ছে না। এ কারণে পুষ্টি কার্যক্রম সফল করতে পুষ্টিনীতি ও কর্মসূচী ঢেলে সাজানো প্রয়োজন। শিশুর সুস্থ-সবলভাবে বেড়ে ওঠার জন্য দরকার গর্ভবতী মায়ের সঠিক পুষ্টি। দেশে উপজেলা থেকে ওয়ার্ড পর্যন্ত চালু স্বাস্থ্যকেন্দ্রের সংখ্যা চৌদ্দ হাজারের বেশি। উপজেলা পর্যায়ে রয়েছে ৪৩৬টি হাসপাতাল, ইউনিয়নে ৩১টি হাসপাতাল ও ১ হাজার ৩৬২টি আউটডোর ক্লিনিক। ওয়ার্ড পর্যায়ে রয়েছে ১২ হাজার ৫২৭টি কমিউনিটি ক্লিনিক। বর্তমানে প্রতি মাসে প্রায় কোটি মানুষ কমিউনিটি ক্লিনিক থেকে সেবা নেন। কিন্তু সে সেবা পর্যাপ্ত নয়। চিকিৎসক মেলে তো ওষুধ মেলে না। দুরবস্থা আষ্টেপৃষ্ঠে লেগে আছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে পরিবার পরিকল্পনা বিভাগের সক্রিয়তা আর মেলে না। অতীতের মতো কার্যকর নয় বলে গতি শ্লথ। বরাদ্দ দ্বিগুণ হলেই যে কাজকর্ম গতিশীল হবে, শনৈঃশনৈঃ উন্নতির চাকা ঘুরতে থাকবে, তা নয়। বরং হিতে বিপরীত হতে পারে। জনগণের জীবন নিয়ে সকল ধরনের উদাসীনতা দূর করে স্বাস্থ্যবান জাতি গঠনে মনোনিবেশ জরুরী।
×