ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ

প্রকাশিত: ০৫:৪৪, ৪ এপ্রিল ২০১৭

মানবাধিকার ও গণতন্ত্র রক্ষায় কার্যকর উদ্যোগ

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সম্মেলনের তৃতীয় দিনে অংশগ্রহণমূলক বিতর্কে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার নিয়ে আলোচনা হয়েছে। আলোচনায় গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষায় সম্মিলিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে সদস্য দেশকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। এ নিয়ে দিনভর সারাবিশ্ব থেকে আসা সংসদীয় ফোরামের নেতৃবৃন্দ বিতর্কে অংশ নিলেও সম্মিলিত কোন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে পারেননি। সোমবার বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে আইপিইউর গণতন্ত্র ও মানবাধিকারবিষয়ক স্থায়ী কমিটির চেয়ারপার্সন বি তিশিরিলেস্তের সভাপতিত্বে এই বিতর্ক অনুষ্ঠিত হয়। দিনব্যাপী বিতর্কে বিশ্ব মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনাকালে দেশে দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন ও নারীর প্রতি সহিংসতার বিষয়টি উঠে এসেছে। এ নিয়ে চুক্তি ও সমঝোতা কাজে আসছে না বলে দাবি করা হয়েছে। আলোচনায় গণহত্যার ঘটনা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে। ক্ষুধা ও দারিদ্র্য নিরসনে পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। সেখানে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন এবং গণমাধ্যমের স্বাধীনতার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে। এ সকল বিষয়ে আইপিইউর সংসদগুলোকে কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের আহ্বান জানানো হয়েছে। আজও এই আলোচনা অব্যাহত থাকবে। আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য ও বিরোধী দল জাতীয় পার্টির সংসদ সদস্য কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, বাংলাদেশ গণতন্ত্র ধ্বংসের চক্রান্ত প্রতিহত করেছে। গণতন্ত্র ও সংবিধান রক্ষায় বিগত নির্বাচনটি ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। নির্বাচন নিয়ে অনেক চ্যালেঞ্জও ছিল, যা মোকাবেলা করে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বর্তমান জাতীয় সংসদ গঠিত হয়। ওই সফলতার কারণে আইপিইউ সম্মেলনের মতো এই বৃহৎ আয়োজন করা সম্ভব হয়েছে। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ সব সময়ই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার রক্ষা এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক। আমরা ১৯৭০ সালে নির্বাচনে বিপুল ভোটে নির্বাচিত হই। কিন্তু নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর না করে আমাদের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দেয়া হয়। দেশব্যাপী গণহত্যা চালানো হয়। যুদ্ধ করে আমরা স্বাধীন হয়েছি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র বিকাশে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা প্রয়োজন। আমরা সেটা নিশ্চিত করছি। দেশে ৩৬টি প্রাইভেট চ্যানেল স্বাধীনভাবে জনগণের মতামত তুলে ধরছে। চলমান সংসদীয় প্রক্রিয়া অব্যাহত থাকলে দেশে গণতন্ত্রের দ্রুত বিকাশ ঘটবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। বিশ্বব্যাপী যুদ্ধ পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেন ফিলিস্তিনের প্রতিনিধি আজম আলহমদ। তিনি বলেন, গাজায় প্রতিনিয়ত নিরীহ মানুষ হত্যা করা হচ্ছে। সেখানে গণহত্যা চললেও এ নিয়ে জাতিসংঘের নিরপেক্ষ ভূমিকার অভাব রয়েছে। এ বিষয়ে আইপিইউ কার্যকর ভূমিকা নিতে পারছে না। তিনি বলেন, মানবাধিকারবিষয়ক অনেক আইন থাকলেও উন্নয়নশীলরা তা মেনে চলছে না। মানবাধিকার নিয়ে নানা চুক্তি ও সমঝোতা হলেও তা কার্যকর হচ্ছে না। দুর্বল গণতন্ত্রের কারণে সেখানে মানুষ অধিকার বঞ্চিত হচ্ছে। বিশ্বব্যাপী সংখ্যালঘু নির্যাতনে উদ্বেগ প্রকাশ করেন উগান্ডার প্রতিনিধি। তিনি বলেন, আমরা মুখে বড় বড় কথা বলছি। কিন্তু বিভিন্ন দেশে সংখ্যালঘু নির্যাতন চলছে। নারীর ওপর নির্যাতন চালানো হচ্ছে। অনেকে পরিবর্তনকে মেনে নিতে পারছেন না। তিনি বলেন, গণতন্ত্র ও নির্যাতন-নিপীড়ন একসঙ্গে চলতে পারে না। অনেক দেশেই মানবাধিকার লঙ্ঘিত হওয়ায় গণতন্ত্র নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিচ্ছে। কেনিয়ার প্রতিনিধি ইয়োকে ইথোরো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য স্বাধীন গণমাধ্যমের প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন। তিনি বলেন, কেনিয়াতে শক্তিশালী গণমাধ্যম রয়েছে। যে কারণে কোন কিছুই লুকিয়ে থাকতে পারে না। দেশের অসামঞ্জস্যগুলো জনগণের সামনে তুলে আনে গণমাধ্যম। এর পর প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়। ভারতের প্রতিনিধি বলেন, বিশ্বের বৃহত্তম গণতান্ত্রিক দেশ ভারত। সংসদীয় গণতন্ত্রের কারণে রাষ্ট্রটি এখনও ইউনাইটেড রয়েছে। যেখানে সাধারণ নির্বাচনে জনগণের মতামতের প্রতিফলন ঘটে। লোকসভায় ৩৫টি দলের প্রতিনিধি রয়েছে। সেখানে গণমাধ্যমও দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করছে। তিনি গণতন্ত্র বিকাশে জনগণের সঙ্গে সংসদের সম্পর্ক উন্নয়নের ওপর গুরুত্বারোপ করেন। সুস্থ সাংস্কৃতিক বিকাশের ওপর গুরুত্বারোপ করেন রিপাবলিক অব কোরিয়ার প্রতিনিধি। তিনি বলেন, আমরা দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে গণতন্ত্রকে পৌঁছে দিয়েছি। সকলেই এখন গণতান্ত্রিক অধিকার ভোগ করছে। আর এটা সম্ভব হয়েছে সংস্কৃতির বিকাশের কারণে। শ্রীলঙ্কার সংসদ সদস্য কাদের মাস্তান বলেন, গণতন্ত্রের জন্য শিক্ষার বিকাশ ও দারিদ্র্য নিরসন জরুরী। শ্রীলঙ্কা সেই কাজটি করছে। ২০০৬ সাল থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে শ্রীলঙ্কা ব্যাপক উন্নয়ন করেছে। সকল ধর্ম ও জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে নিয়ে এই উন্নয়ন কাজ চলছে। আইপিইউ সদস্য দেশগুলোর জন্য এ বিষয়ে আরও বেশি সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা জরুরী। জাম্বিয়ার প্রতিনিধি বলেন, দক্ষিণ আফ্রিকার দেশ জাম্বিয়ায় স্কুল থেকে গণতন্ত্রের শিক্ষা শুরু হয়। আমাদের সংসদে উন্মুক্ত একটি সেশনের সুযোগ রয়েছে। যেখানে সকলেই কথা বলতে পারেন। সংসদীয় কার্যক্রম জনগণের কাছে পৌঁছে দিচ্ছে গণমাধ্যম। আইপিইউতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পাশাপাশি তার বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্বারোপ করে রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রতিনিধি। তিনি বলেন, গণতন্ত্র বিকাশে সম্মিলিত সিদ্ধান্ত নিতে হবে। তার বাস্তবায়নও নিশ্চিত করতে হবে। স্পীকারের সঙ্গে পাঁচটি দেশের প্রতিনিধি দলের সাক্ষাত ॥ জাতীয় সংসদের স্পীকার ও ১৩৬তম আইপিইউ এসেম্বলির সভাপতি ড. শিরীন শারমিনের সঙ্গে তার বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে স্থাপিত কার্যালয়ে সোমবার সম্মেলনে যোগ দিতে আসা পাঁচটি গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের প্রতিনিধি দল সাক্ষাত করেছে। দেশগুলো হচ্ছে- জার্মানি, ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, ইরান ও সুইডেন। স্পীকার এ সময় আইপিইউ এসেম্বলিতে যোগ দেয়ার জন্য প্রতিনিধিদের স্বাগত জানান। সুন্দর ও বর্ণাঢ্য আন্তর্জাতিক সম্মেলন আয়োজনে স্পীকারকেও ধন্যবাদ জানান প্রতিনিধিরা। আইপিইউ এসেম্বলিকে বিশ্বের সর্ববৃহৎ মিলনমেলা আখ্যায়িত করে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সংসদ সদস্য ও সহযোগী সংস্থা থেকে আগত প্রতিনিধিদের অংশগ্রহণ বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় অধিষ্ঠিত করেছে। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বাংলাদেশের সংসদীয় চর্চা, সংসদীয় রীতিনীতি, বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে জানতে চাইলে স্পীকার বলেন, বর্তমান সরকার দেশের মানুষের কল্যাণে অক্লান্ত পরিশ্রম করে যাচ্ছে। এর ফলে আর্থ-সামাজিক সূচকে বাংলাদেশ দ্রুত উন্নতি লাভ করছে। তিনি বাংলাদেশের মানব সম্পদ উন্নয়ন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচী, বিদ্যুত উৎপাদন বৃদ্ধিসহ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন বিষয়ে বাংলাদেশের অগ্রগতির বিবরণ দেন। বাংলাদেশের গণতন্ত্র সম্পর্কে স্পীকার বলেন, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর বাংলাদেশে গণতন্ত্র অবরুদ্ধ হয়, স্তব্ধ হয়ে যায় বাক স্বাধীনতা। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর তনয়া বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১৯৮১ সালে স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর হতে গণতন্ত্রকে পুনরুদ্ধারের জন্য জনগণকে সঙ্গে নিয়ে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলেন। অবশেষে ১৯৯০ সালে গণতন্ত্র মুক্তি পায়। তখন থেকেই জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার পরিবর্তনের ধারা সূচিত হয়। তিনি বলেন, ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে ১৯৯৬ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন। সাংবিধানিক সঙ্কট কাটিয়ে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পুনর্বার প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে তিনি বাংলাদেশকে পরিণত করেছেন উন্নয়নের রোল মডেল। প্রতিনিধি দলের সদস্যরা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের প্রশংসা করেন এবং সন্ত্রাসবাদকে একটি বৈশ্বিক সমস্যা হিসেবে আখ্যায়িত করে মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার তাগিদ দেন।
×