ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৮ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

জনমনে স্বস্তি ॥ আতিয়া মহলের ২ লাশ উদ্ধার, মৌলভীবাজারে নিহত ৭ জন শনাক্ত

ময়মনসিংহে মেস ঘিরে অভিযান ॥ সাত জঙ্গী আটক

প্রকাশিত: ০৫:৩৬, ৪ এপ্রিল ২০১৭

ময়মনসিংহে মেস ঘিরে অভিযান ॥ সাত জঙ্গী আটক

স্টাফ রিপোর্টার, ময়মনসিংহ/ সিলেট ও নিজস্ব সংবাদদাতা, মৌলভীবাজার ॥ ময়মনসিংহ শহরের কালিবাড়ি রোডের আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল কাদিরের বাসা থেকে সাত জঙ্গীকে আটক করেছে ময়মনসিংহ পুলিশ। এদের মধ্যে নেত্রকোনা জেলার মোহনগঞ্জ উপজেলার সবুজের পুত্র নাসির উদ্দিন নামে ময়মনসিংহ মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষার্থীও রয়েছে। সোমবার দুপুরে কালিবাড়ি রোডের বিশাল জায়গাজুড়ে একটি ডুপ্লেক্স ও একটি চারতলা ভবনসহ একাধিক বাসার মধ্যে একটি আধাপাকা টিনের বাসা থেকে তাদের আটক করা হয়। প্রাণ কোম্পানির পণ্যসামগ্রী বিক্রির লেবাসে মেস আকারের এই বাসাটি এক বছর ধরে ভাড়া নিয়েছিল জঙ্গীরা। পুলিশী অভিযানকালে বাসার ভেতর থেকে সত্তর লাখ টাকা লেনদেনের চেক বই, বিভিন্ন জিহাদী পুস্তিকা, ইলেকট্রনিক ডিভাইস ও কম্পিউটার উদ্ধার করা হয়। প্রায় দুই ঘণ্টার রুদ্ধশ্বাসের এই অভিযান শেষে ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন স্থানীয় সাংবাদিকদের জানান, সাত জঙ্গী আটকের এই অভিযানকালে কোন বিস্ফোরক কিংবা অস্ত্র পাওয়া যায়নি। এমনকি আটক সাতজন কোন জঙ্গী সংগঠনের সঙ্গে জড়িত সেটিও নিশ্চিত হতে পারেনি পুলিশ। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য সাত জঙ্গীকে পুলিশ হেফাজতে নেয়া হয়েছে। পুলিশ আটক সাত জঙ্গীর পরিচয় প্রকাশ করেছে। এরা হচ্ছেÑ ময়মনসিংহ মেডিক্যালের শিক্ষার্থী নাসির উদ্দিন, ময়মনসিংহের ধোবাউড়া উপজেলার দীঘিরপাড় গ্রামের ইকবাল হোসেনের পুত্র আল আমিন, ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার মারফত আলীর পুত্র শহীদুল ইসলাম, আইন উদ্দিনের পুত্র আশিকুর রহমান, হাবিবুর রহমানের পুত্র মাসুম আহমদ, আবদুল লতিফের পুত্র রোমান মিয়া ও মাসুম আহমদ। এদের বয়স ২৫-৩০ এর মধ্যে। পুলিশ হেফাজতে এদের জিজ্ঞাসাবাদ চলছে। কোন ধরনের অঘটন ছাড়াই সাত জঙ্গী আটকের ঘটনায় স্বস্তি প্রকাশ করে পুলিশের প্রতি ধন্যবাদ জানিয়েছে ঘনবসতির আবাসিক কালিবাড়ি এলাকার বাসিন্দারা। আওয়ামী লীগের প্রয়াত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল কাদিরের শহরের কালিবাড়ি রোডের বাসায় জঙ্গীদের আস্তানার সন্ধান মিলেছেÑএমন খবর পেয়ে সোমবার দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে পুলিশ বাসাটি ঘিরে রাখে। এই খবর ছড়িয়ে পড়লে র‌্যাবসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অন্যান্য সদস্যসহ পুলিশ প্রশাসনের উর্ধতন কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন। এ সময় ভিড় জমান আশপাশের এলাকার বাসিন্দারাও। স্থানীয় সূত্র ও পুলিশ জানায়, প্রয়াত সংসদ সদস্য আনোয়ারুল কাদিরের এই বাসার বিশাল জায়গাজুড়ে মোট চারটি বাসা রয়েছে। এর মধ্যে দুতলা ডুপ্লেক্স ভবনটির মালিক আনোয়ারুল কাদিরের প্রয়াত পুত্র পাপ্পুর স্ত্রী কেয়ার। এই বাড়িটি ভাড়া দিয়ে গৃহবধূ কেয়া থাকেন শহরের আকুয়া এলাকায়। চারতলা ভবনটি ভাড়া দেয়া হয়েছে সূর্যের হাসি নামে একটি এনজিও প্রতিষ্ঠানকে। এই ভবনটির মালিক আনোয়ারুল কাদিরের আরেক পুত্র মুরাদ। চারতলা এই ভবনটি ভাড়া দিয়ে তিনি মাকে নিয়ে ঢাকায় থাকেন। আধাপাকা টিনের একতলা বাড়িটিরও মালিক মুরাদ। গত এক বছর আগে এই বাড়িটি ভাড়া দেয় কয়েক ব্যবসায়ীকে। প্রাণ কোম্পানির চিপস ও বিস্কুটসহ বিভিন্ন পণ্যসামগ্রী বিক্রির আড়ালে এই বাসায় থেকে গোপন তৎপরতা চালাচ্ছিল আটক সাত জঙ্গী। আশপাশের এলাকার বাসিন্দারা জানায়, সাতজনের মধ্যে ৩-৪ যুবক বাসার বাইরে বের হয়ে প্রাণের পণ্য বিক্রি করলেও বাকিদের দেখা মিলত না। কখনও প্যান্ট-শার্ট পরে হোন্ডায়, আবার কখনও প্রাণ কোম্পানির রিক্সা ভ্যানে করে কয়েকজন বের হতো। বাকিরা বেশিরভাগ সময় থাকত বাসার ভেতরে। বাসাটির ভেতর থেকে বেশিরভাগ সময় বন্ধ করে রাখা হতো বলে আশপাশের লোকজন বাসার ভেতরে কী হচ্ছে তা জানার কিংবা দেখার সুযোগ পেত না। এমনকি এই বাসার যুবকদের নিয়ে স্থানীয়দের মধ্যে কোন ধরনের সন্দেহও ছিল না। সোমবারের অভিযানের পর আশপাশের মানুষজন আটক সাতজনের জঙ্গী সম্পৃক্ততা নিয়ে বিস্ময় প্রকাশের পাশাপাশি আতঙ্কগ্রস্ত হয়ে পড়ে। জঙ্গী আস্তানার সন্ধান মিলেছে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসেন ময়মনসিংহ রেঞ্জের ডিআইজি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, অতিরিক্ত ডিআইজি আক্কাস উদ্দিন ভূঁইয়া, পুলিশ সুপার সৈয়দ নুরুল ইসলাম, ডিআইজি অফিসের পুলিশ সুপার হারুন অর রশিদ ও র‌্যাবের উর্ধতন কর্মকর্তাসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা। প্রায় দুই ঘণ্টাব্যাপী চলে সতর্ক তল্লাশি অভিযান। বাসার ভেতর কোন ধরনের বিস্ফোরক নেই নিশ্চিত হওয়ার পর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা জাপটে ধরে সাত জঙ্গীকে। পরে তাদের চোখ বেঁধে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য নিয়ে যাওয়া হয় পুলিশ অফিসে। প্রসঙ্গত, জেএমবির শীর্ষ জঙ্গী প্রয়াত বাংলাভাইকে ধরা হয়েছিল ময়মনসিংহের মুক্তাগাছা থেকে। সিলেট ॥ ১১ দিন পর দক্ষিণ সুরমার শিববাড়ীর আস্তানা আতিয়া মহল থেকে ২ জঙ্গী লাশ উদ্ধার করা হয়েছে। সোমবার র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের সদস্যরা অভিযানে নেমে ভবনের ভেতরে পড়ে থাকা দুই জঙ্গীর মরদেহ অপসারণের কাজ সম্পন্ন করে। বিকেল ৫টা ৩২ মিনিটে ওসমানী মেডিক্যালের একটি এ্যাম্বুলেন্সে করে লাশ দুটি মর্গে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে লাশ দুটি ময়নাতদন্ত হবে। দুপুর ১টার দিকে র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দল জঙ্গী আস্তানা আতিয়া মহলে অভিযান শুরু করেন। এর আগে সকাল ৮টার দিকে তারা ‘আতিয়া মহল’ এলাকায় উপস্থিত হয়ে অবস্থান গ্রহণ করেন। প্রায় ৫ ঘণ্টা ঘটনাস্থল এবং এর আশপাশ এলাকা পর্যবেক্ষণ করার পর অভিযান শুরু করা হয়। সেনাবাহিনীর পরিচালিত ‘অপারেশন টোয়াইলাইট’ নামক অভিযানে নিহত হয় মোট ৪ জঙ্গী, যাদের মধ্যে ছিল ১ নারী ও ৩ পুরুষ জঙ্গী। তাদের মধ্যে ২ জনের লাশ উদ্ধার করে পোস্টমর্টেম শেষে নগরীর হযরত মানিক পীরের (রঃ) কবরস্থানে দাফন করা হয়। অভিযান শেষে সেনাবাহিনীর প্যারা কমান্ডো টিমের পক্ষ থেকে ২ জঙ্গীর লাশ ও আতিয়া মহল পুলিশকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। ভবনের ভেতরে বিস্ফোরকদ্রব্য ও দুই জঙ্গীর শরীরে সুইসাইডাল ভেস্ট লাগানো থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ ভেবে পরবর্তী কার্যক্রম পরিচালনার জন্য র‌্যাবের বোমা নিষ্ক্রিয়করণ দলের অপেক্ষায় থাকতে হয়। মৌলভীবাজার ॥ সদর উপজেলার নাসিরপুরের ‘জঙ্গী আস্তানা’ সাত নিহতের লাশ শনাক্ত করেছেন জঙ্গী শিরিনা আক্তারের বাবা ও লোকমান হোসেনের শ্বশুর আবু বক্কর সিদ্দিক। সোমবার সকাল পৌনে ১১টায় দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থেকে মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালে পৌঁছান আবু বক্কর সিদ্দিক। তার সঙ্গে ছিলেন স্থানীয় ইউপি সদস্য মোফজ্জল হোসেন ও জঙ্গী লোকমানের ভায়েরা ভাই সানোয়ার হোসেন। দুপুর সাড়ে ১২টায় মৌলভীবাজার সদর হাসপাতালের মর্গে লাশ শনাক্তের পর কেঁদে কেঁদে বের হতে দেখা যায় আবু বক্কর সিদ্দিককে। জেলা পুলিশ কার্যালয়ে দুপুর ২ ঘটিকায় অনুষ্ঠিত এক প্রেস ব্রিফিংয়ে পুলিশ সুপার মোহাম্মদ শাহজালাল জানান, নিহতরা সবাই একই পরিবারের। লাশ শনাক্ত করেন দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থেকে আসা নিহত শিরিনা আক্তারের বাবা আবু বক্কর সিদ্দিক। তিনি জানান, ঘটনার আগের দিন তার মেয়ে মোবাইলে জানায় তোমরা আমাদের ক্ষমা কর আমাদের ভুলে যেও। এটাই আমার তোমাদের সঙ্গে শেষ কথা। এ কথা বলার পর হতে তাদের মোবাইল বন্ধ হয়ে যায়। এরপর হতে তাদের সঙ্গে আর কোন কথা হয়নি। পরে পত্রিকা ও টিভির মাধ্যমে ঘটনার সবকিছু জানতে পারি। নিহতদের লাশ নেবেন কি না, এর জবাবে তিনি বলেন, তারা জঙ্গী তারা আমার দেশের ও সমাজের শত্রু। এ লাশ নিয়ে কলঙ্কের গ্লানি বহন করতে চান না বলে জানান। দিনাজপুরের ঘোড়াঘাট থেকে আসা স্থানীয় মেম্বার মোজাম্মেল হোসেন জানান, জঙ্গী লোকমান স্থানীয় মাদ্রাসায় তৃতীয় অথবা চতুর্থ শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করে। পুলিশ ও র‌্যাব তাকে গ্রেফতারের জন্য আগে কয়েক বার তার বাড়িতে অভিযান চালায়। কিন্তু সেখানে তাকে পায়নি। নিহত ৭ জনের নাম পরিচয় জানা যায়।
×