ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১২ বৈশাখ ১৪৩১

মিরপুরে আটক চার জনের তিনজনই আত্মঘাতী জঙ্গী

প্রকাশিত: ০৫:৩৫, ৪ এপ্রিল ২০১৭

মিরপুরে আটক চার জনের তিনজনই আত্মঘাতী জঙ্গী

গাফফার খান চৌধুরী ॥ গত ২৭ মার্চ রাজধানীর মিরপুর থেকে গ্রেফতারকৃত জামায়াতে ইসলামীর এক রোকনসহ চারজনের মধ্যে তিনজনই আত্মঘাতী জঙ্গী। অপরজন নিজে আত্মঘাতী জঙ্গী না, তবে আত্মঘাতী জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী। এই জামায়াত নেতা তার দুই ছেলে এবং দুই শ্যালিকার দুই ছেলেকে আত্মঘাতী জঙ্গী বানিয়েছেন। আত্মঘাতী জঙ্গী তৈরিতে তিনি কোটি কোটি টাকা খরচ করেছেন। ইতোমধ্যেই সীতাকু-ের জঙ্গী আস্তানায় পুলিশের অভিযানকালে এই জামায়াত নেতার বড় ছেলে এবং বিমানবন্দরে তার শ্যালিকার এক ছেলে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হয়েছেন। যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি হওয়া জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রীয় নেতা ও দলের মূল অর্থায়নকারী মীর কাশেম আলীর ঘনিষ্ঠ গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতা। মীর কাশেম আলীর বেশ কয়েকটি ব্যবসায়ী সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদেও ছিলেন। এসব সংগঠন থেকে জঙ্গীবাদে অর্থায়ন করা হয়েছে। এই জামায়াত নেতার সঙ্গে আন্তর্জাতিক জঙ্গী সংগঠনগুলোর নেটওয়ার্ক থাকার প্রাথমিক তথ্য মিলেছে। তিনদিনের রিমান্ডে এমন চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে পুলিশ। তদন্তকারী সংস্থা সূত্রে জানা গেছে, রাজধানীর মিরপুর মডেল থানাধীন পূর্ব মনিপুরী পাড়ার ১২৭০ নম্বর খালেদা মঞ্জিল নামের বাড়ি থেকে গ্রেফতার হয় তৌফিক হাসান (৫৪), শামসুল হক খান (৫৫), রাকিব আল হাসান (২১) ও আরেফিন হাসান (২৪)। তাদের কাছ থেকে মোট ৪৪ ককটেল ও বোমা এবং ৩৩টি নিষিদ্ধ জিহাদী বই উদ্ধার হয়। তাদের তিনদিনের রিমান্ড শেষে কারাগারে পাঠিয়েছেন ঢাকার সিএমএম আদালত। পুলিশের এক উর্ধতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জনকণ্ঠকে জানান, যে বাড়ি থেকে তারা গ্রেফতার হয়েছে, সেটির মালিক জামায়াতের অনুসারী হাজী আইনুদ্দিন। তার শুধু তিন মেয়ে। সবার বড় মেয়ে নিলুফার ইয়াসমিনকে বিয়ে করেন প্রকৌশলী তৌফিক হাসান। তার বাড়ি ঢাকা জেলার দোহারে। তিনি ১৯৮০ সালের দিকে ভর্তি হয়েছিলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে। ছাত্রজীবন থেকেই তিনি ছাত্র শিবিরের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। তার স্ত্রীও জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী। প্রকৌশলী তৌফিক হাসান ঢাকা জেলার কেরানীগঞ্জ উপজেলার চেয়ারম্যান পদে জামায়াতের প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতাও করেছিলেন। ২০০০ সালে স্ত্রী নিয়ে তিনি পবিত্র হজ পালন করতে সৌদি আরবে যান। সেখানে কয়েক বছর বসবাস করেন। সৌদিতেই জন্ম হয় তার দুই ছেলের। সৌদি আরব থেকে দেশে ফেরার পর তিনি জামায়াতে ইসলামীর পাশাপাশি দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে তৎপরতা শুরু করেন। নিজেই জিহাদের পথ বেছে নেন। পুরোপুরি জঙ্গীবাদে জড়িয়ে পড়েন। হয়ে ওঠেন আত্মঘাতী জঙ্গী। দেশে ইসলামী শাসন ব্যবস্থা কায়েমের জন্য তিনি জঙ্গীবাদের পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। এখাতে ঢালতে থাকেন কোটি কোটি টাকা। এসব টাকার অধিকাংশই বিদেশ থেকে এসেছে। এছাড়াও তিনি নিজের টাকা ও শ্বশুরবাড়ির লোকজনের কাছ থেকেও টাকা নিয়ে জঙ্গীবাদে ব্যয় করেছেন। তিনি যুদ্ধাপরাধ মামলায় ফাঁসি হওয়া জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় নেতা মীর কাশেম আলীর ঘনিষ্ঠ ছিলেন। মীর কাশেম আলীর বেশ কয়েকটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এবং তার ব্যবসায়িক সংগঠনের গুরুত্বপূর্ণ পদে ছিলেন। এখান থেকেও তিনি জঙ্গী অর্থায়নে সহায়তা পেতেন। মীর কাশেম আলী তাকে প্রচুর অর্থও দিয়েছেন। যা জঙ্গী অর্থায়নে ব্যয় হয়েছে। ওই পুলিশ কর্মকর্তা বলছেন, প্রকৌশলী হওয়ার পর চাকরির সুবাদে এবং ব্যক্তিগতভাবে অন্তত অর্ধশত দেশে গেছেন তৌফিক হাসান। ইরাক, সিরিয়া, পাকিস্তান, আফগানিস্তান, আমেরিকাসহ বহু দেশে একাধিকবার গেছেন। এখান থেকেই তার জঙ্গীবাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠে। তার মোবাইল ফোনটি যাচাইবাছাই করা হচ্ছে। প্রাথমিক যাচাইবাছাইয়ে তার আন্তর্জাতিক জঙ্গীবাদের নেটওয়ার্ক থাকার বিষয়টি অনেকটা স্পষ্ট। তিনি সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরে আত্মঘাতী জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী হয়ে ওঠেন। নব্য জেএমবির পৃষ্ঠপোষকতা শুরু করেন। দলে ভেড়ান তারই ভায়রা অর্থাৎ শ্যালিকার স্বামী রফিকুল ইসলামের ছেলে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার সাইন্স এ্যান্ড টেকনোলজি বিভাগের ষষ্ঠ সেমিস্টারের ছাত্র আরেফিন হাসানকে। পরবর্তীতে আরিফিন নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য হন। আরেফিন হাসান নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য হিসেবে তৈরি করে তৌফিক হাসানের দুই ছেলেকে। এরমধ্যে গত ১৫ মার্চ তৌফিক হাসানের বড় ছেলে আহমেদ রাফিত আল হাসান চট্টগ্রামের সীতাকু-ে একটি জঙ্গী আস্তানায় অভিযানকালে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত হন। সীতাকু-ের দুইটি জঙ্গী আস্তানায় ৫ জঙ্গী নিহত হয়। রাফিত হাসান নব্য জেএমবির আত্মঘাতী স্কোয়াডের সদস্য ছিলেন। গত বছরের ৯ আগস্ট থেকে রাফিত হাসান নিখোঁজ ছিলেন। এ বিষয়ে মিরপুর মডেল থানায় গত বছরের ৯ আগস্ট একটি সাধারণ ডায়েরি হয়। যার নম্বর-৬৩৮। এছাড়া গত ২৪ মার্চ সন্ধ্যা সাড়ে সাতটার দিকে রাজধানীর হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের সামনে পুলিশ চেকপোস্টে আত্মঘাতী হামলার চেষ্টাকালে নিজের বুকে বেঁধে রাখা বোমায় নিহত হন নব্য জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য আয়াত হাসান। শক্তিশালী বিস্ফোরণে তার কোমর থেকে উপরের অংশ আর নিচের অংশ আলাদা হয়ে যায়। আয়াত হাসান সীতাকু-ে আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত জঙ্গী রাফিত হাসানের খালাত ভাই। আয়াত হাসানের মায়ের নাম মুন মুন বেগম। তিনি গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতা তৌফিক হাসানের শ্যালিকা। নিহত দুই জঙ্গীর এমন পরিচয় নিশ্চিত করেছে গ্রেফতারকৃত জামায়াত নেতা তৌফিক হাসান। আত্মঘাতী বিস্ফোরণে নিহত দুই জঙ্গী এবং গ্রেফতারকৃত আরেফিন এবং তৌফিক হাসানের ছেলে ডেলটা মেডিক্যাল কলেজ এ্যান্ড হাসপাতালের ডাঃ রাকিব আল হাসান নব্য জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য। এ চারজনই ইংরেজী মাধ্যমের ছাত্র ছিল। তারা মানারাত ইন্টারন্যাশন্যাল স্কুল এ্যান্ড কলেজের ছাত্র ছিল বলে জানা গেছে। গ্রেফতারকৃতদের জিজ্ঞাসাবাদকারী একজন পুলিশ কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে জানান, শুধু তৌফিক হাসান নয়, তার প্রভাবে শ্বশুরবাড়ি ও তার এক শ্যালিকাসহ মোট চারটি পরিবার আত্মঘাতী জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী হয়েছে। সীতাকু-ে নিহত আত্মঘাতী জঙ্গী রাফিত সম্পর্কে তথ্য পেতে তার মা নিলুফার ইয়াসমিনকেও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের সময় পুত্রশোকে তেমন কাতরতা লক্ষ্য করা যায়নি। এমনকি এক ছেলে গ্রেফতার হয়ে কারাগারে রয়েছে, সে সম্পর্কেও তেমন কোন চিন্তিত নন তিনি। তিনি নিজেও আত্মঘাতী জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী বলে জিজ্ঞাসাবাদে বুঝা গেছে। এছাড়া তার এক বোন সপরিবারে পূর্ব মনিপুরীপাড়ার বাড়ি থেকে চলে গেছেন। তিনি জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী কিনা তা স্পষ্ট নয়। গ্রেফতার এড়াতে তিনি অন্যত্র চলে যেতে পারেন। এছাড়া বিমানবন্দরে নিহত আয়াত হাসানে মা মুনমুন বেগমও আত্মঘাতী জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী। তাকেও জেরা করা হয়েছে। এই কর্মকর্তা বলছেন, রিমান্ডে জিজ্ঞাসাবাদকালে তৌফিক হাসান, তার ছোট ছেলে ডাঃ রাকিব আল হাসান, ভায়রার ছেলে আরেফিন হাসান ছিল একেবারেই নির্বিকার। তারা পুলিশকে বলেছেন, পুলিশ অন্যায় পথে আছে। আর তারা (গ্রেফতারকৃতরা) সঠিক পথে রয়েছে। পুলিশ তাদের বিরুদ্ধে যেকোন ধরনের পদক্ষেপ নিতে পারে। এমনকি বন্দুকযুদ্ধে মারা গেলেও, তাদের কোন আফসোস নেই। তবে গ্রেফতারকৃতরা অনেক কিছুই গোপন করে গেছেন। তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক ও অর্থের উৎস সম্পর্কে সুস্পষ্ট কিছুই জানাননি। তাদের টিএফআই সেলে নিয়ে কড়া জিজ্ঞাসাবাদ করা প্রয়োজন। ঢাকার কেরানীগঞ্জে নাশকতার মামলায় তিনি গ্রেফতার হয়ে জেলও খেটেছেন। একমাত্র শামছুল হক খানের ভেতরে কিছুটা অনুশোচনা লক্ষ্য করা গেছে। তিনি আত্মঘাতী জঙ্গী না হলেও, আত্মঘাতী জঙ্গীবাদে বিশ্বাসী। তার মোবাইল ফোন যাচাইবাছাই করে এমন তথ্যই মিলেছে। মিরপুর মডেল থানার ওসি মোঃ নজরুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, গ্রেফতারকৃত তৌফিক হাসান নিহত রাশিত হাসানের পিতা বলে স্বীকার করেছেন। এছাড়া বিমানবন্দরে নিহত জঙ্গী আয়াত হাসান তৌফিক হাসানের শ্যালিকা মুনমুন বেগমের ছেলে ছিলেন। আরেফিন হাসান, রাফিত হাসান, আয়াত হাসান ও ডাঃ রাকিব আল হাসান যে নব্য জেএমবির সুইসাইডাল স্কোয়াডের সদস্য, তা তাদের পরিবার অনেক আগ থেকেই জানত। এজন্য রাফিত হাসান ও আয়াত হাসান নিখোঁজ হওয়ার পর পরিবারের তরফ থেকে ছেলে খোঁজার বিষয়ে কোন তৎপরতা ছিল না। তারা ছেলের খোঁজ না করে, নিখোঁজের পর পরই আমেরিকায় চলে যান। অনেক দিন সেখানে থাকার পর দেশে ফেরেন।
×