ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আইপিইউ সম্মেলনে প্রতিনিধিদের একই আওয়াজ ॥ জঙ্গীবাদকে না

প্রকাশিত: ০৫:৩৪, ৪ এপ্রিল ২০১৭

আইপিইউ সম্মেলনে প্রতিনিধিদের একই আওয়াজ ॥ জঙ্গীবাদকে না

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদকে সমস্বরে ‘না’ করে দিয়েছে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) সদস্যভুক্ত রাষ্ট্রগুলো। তারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছে যে, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদকে কোনভাবেই সমর্থন করতে পারবে না কোন সদস্য রাষ্ট্র। বরং বৈশ্বিক সন্ত্রাসবাদ রুখতে বিশ্বের সংসদগুলোর সক্ষমতা বাড়াতে একটি কৌশল গ্রহণ করতে যাচ্ছে আইপিইউ। কোন কৌশলে সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ প্রতিরোধ করা যায় তা নিয়ে সোমবার দিনভর আলোচনা করেছেন সারাবিশ্ব থেকে আসা জনপ্রতিনিধিরা। অন্যদিকে শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে দু’দিনের আলোচনা চললেও এখনও ঐকমত্যে পৌঁছানো যায়নি। এছাড়া জরুরী গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়েও সোমবার আলোচনা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সম্মেলনের তৃতীয় দিনে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে সাধারণ অধিবেশন শুরু হয়। আইপিইউ প্রেসিডেন্ট সাবের হোসেন চৌধুরীর উপস্থিতিতে এই অধিবেশনে জরুরী গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুগুলো নিয়ে আলোচনা হয়েছে। একই সময়ে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি এবং শান্তি ও বিশ্ব নিরাপত্তার বিষয়ে আলোচনা চলেছে। এরপর আলোচনা হয়েছে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলার কৌশল নিয়ে। তবে কোন বিষয়েই সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হয়নি। বুধবার এসব বিষয়ে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করে এ সংক্রান্ত সুপারিশমালা ঘোষণা করা হবে। এসব বিষয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এ সংসদীয় ফোরাম আইপিইউ সেক্রেটারি জেনারেল মাটিন চুনগং ব্রিফিংকালে জানান, হতাশা, সামাজিক অসমতা, অবিচার, মানবাধিকার লঙ্ঘন এবং সুযোগের অভাব থেকে সহিংস সন্ত্রাবাদ জন্ম নেয়। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলার আমরা যে একটি কৌশল প্রণয়ন করতে যাচ্ছি, সেখানে এগুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। আর যে কৌশলটা প্রস্তাব করা হবে, সেখানে অনেকগুলো কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত করব। তিনি বলেন, সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকসহ সব ক্ষেত্রে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে বৈষম্য দূর করতে এবং মানবিক মর্যাদা পুনঃপ্রতিষ্ঠায় পার্লামেন্ট কীভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারে, খসড়া প্রস্তাবে সে বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত করা হবে। সেক্রেটারি জেনারেল আরও বলেন, স্থিতিশীল বিশ্ব ও শান্তির জন্য সন্ত্রাসবাদ সবচেয়ে বড় হুমকি। কোন দেশই এ হুমকির বাইরে নয়। এজন্য একটি বৈশ্বিক সমাধান প্রয়োজন। কিছু ঘটে যাওয়ার আগেই সন্ত্রাসবাদ তৈরির কারণগুলোকে চিহ্নিত করে তা নির্মূল করতে হবে। সন্ত্রাসবাদ সৃষ্টির কারণগুলোকে রুখতে গ্লোবাল পার্লামেন্টারি কমিউনিটিকে সাহায্য করবে। শান্তি ও নিরাপত্তার বিষয়ে দ্বিতীয় বারের মতো নির্বাচিত সেক্রেটারি জেনারেল চুনগং বলেন, এ বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর চেষ্টা চলছে। সদস্য দেশগুলো আলোচনা করছে। আশাকরি ঐকমত্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে। তিনি আরও বলেন, আমরা এমন কিছু করব না, যাতে আন্তর্জাতিক কোন আইন লঙ্ঘিত হয়। আন্তর্জাতিক আইনের আলোকেই খসড়াটি প্রণয়ন করা হয়েছে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ ইস্যু ॥ সন্ত্রাস-জঙ্গীবাদ রুখতে কার্যকরী ও এ্যাকশনমুখী কৌশল নির্ধারণ করবে ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন। সোমবার রাজধানীর বঙ্গবন্ধু সম্মেলন কেন্দ্রে আয়োজিত আইপিইউ সম্মেলনের ৩য় দিনে ‘শান্তি ও আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা’ বিষয়ক স্ট্যান্ডিং কমিটির বৈঠক শেষে এ মন্তব্য করেন আইপিইউর সেক্রেটারি জেনারেল মার্টিন চুংগং। তিনি বলেন, সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গীবাদকে কোনভাবেই সহায়তা করবে না আইপিইউভুক্ত দেশগুলো। একই সঙ্গে সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ রুখতে একটি কৌশল নির্ধারণেও আলোচনা চলছে। ওই আলোচনায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দলের সদস্য সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডাঃ দীপু মনি বলেন, সন্ত্রাস বা জঙ্গীবাদ কার্যক্রমে কোন দেশই যেন আর্থিক বা জনবল কোন কিছুতেই সহায়তা না পায় সেগুলো বন্ধ করার বিষয়ে নিজ নিজ দেশের সংসদের কী ভূমিকা হতে পারে সেই বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে। তিনি বলেন, নিজ দেশে নিরাপত্তাসহ আন্তর্জাতিক নিরাপত্তা একটি বড় ইস্যু। আমরা বর্তমানে বৈশিকভাবে সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মাদক পাচারসহ নানাবিধ সমস্যায় ভুগছি। এসবের থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে আইপিইউভুক্ত দেশগুলোকে একত্রিত হয়ে এর মোকাবেলা করতে হবে। যুক্তরাজ্যের প্রতিনিধি এন ইভানস বলেন, যুক্তরাজ্যে সন্ত্রাসবাদের কোন স্থান নেই। হাউস অব কমন্সের বাইরে যে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছিল তা শুধু যুক্তরাজ্য নয়, সারাবিশ্বের গণতন্ত্রের ওপর হামলা। তাই সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলায় সবাইকে একত্রিত হয়ে কাজ করতে হবে। সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ মোকাবেলায় বাংলাদেশ কাজ করছে বলে জানিয়েছেন ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট মোঃ ফজলে রাব্বী মিয়া। তিনি বলেন, সামাজিক বৈষম্য এবং সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ একে অপরের পরিপূরক। তাই জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসী গোষ্ঠীকে চিরতরে নির্মূল করতে হলে সামাজিক বৈষম্য দূর করতে হবে। সেই বিষয়টি আইপিইউ সম্মেলনে তুলে ধরা হয়েছে। অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির ফসল পৌঁছে দিতে হবে- স্পীকার ॥ এদিকে সাধারণ অধিবেশনে সভাপতির বক্তব্যে স্পীকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিই শেষ কথা নয়। প্রবৃদ্ধির সুফল পিছিয়ে পড়া প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছে দিতে না পারলে কাজে আসবে না। তিনি বলেন, পৃথিবীর যত মানুষ এক দশমিক ৫ ইউএস ডলারের নিচে আয় করে, তার একটি বড় অংশ হচ্ছে নারী। কাজেই নারীর দারিদ্র্য বিমোচনে পদক্ষেপ নিতে হবে। আর ক্ষুধা ও দারিদ্র্য মুক্ত বিশ্ব গড়তে হলে অংশগ্রহণমূলক গণতন্ত্রের প্রয়োজন। আইপিইউ সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে ডেপুটি স্পীকার এ্যাডভোকেট ফজলে রাব্বী মিয়া বলেন, আমরা নারী-পুরুষের সমতা আনতে কাজ করছি। আমাদের সরকার এমডিজি বাস্তবায়ন করেছে। এসডিজি বাস্তবায়নে উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। বাংলাদেশের নীতি হচ্ছে, সুপরিকল্পিত পরিকল্পনা যা এসডিজির লক্ষ্য বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। তিনি বলেন, এসডিজি বাস্তবায়নের জন্য সরকারের দাপ্তরিক পর্যায়ের ২০০ নাগরিককে প্রশিক্ষণ দেয়া হয়েছে। সংসদীয় স্থায়ী কমিটিও কাজ করছে। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তবায়নে আমাদের সংসদ ও আমলারা কাজ করছে। কারণ এসডিজি বাস্তবায়ন হলে উন্নয়নমূলক কাঠামোর মধ্যে সাম্য বজায় থাকে। অর্থনৈতিক সেবাও তৃণমূলে নিয়ে যেতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে বলেও তিনি জানান। ভিয়েতনামের প্রতিনিধি টি পি টং বলেন, তার দেশ এসডিজির নির্ধারিত অনেক লক্ষ্য ইতোমধ্যে বাস্তবায়ন করেছে। যার মধ্যে শিক্ষা, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিশ্চিত করেছে। যুব-সমাজ এবং লিঙ্গ বৈষম্য দূর করণে বিশেষ করে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মান্নয়নে বর্তমানে কাজ করছে। ভিয়েতনামের মানুষের মধ্যে সম্পদের অসম বৈষম্য দূর করণে কাজ করছে দেশটির সরকার। কম্বোডিয়ানের প্রতিনিধি এস ইয়াং বলেন, দেশটির স্বাধীনতার পর সার্বভৌমত্ব ও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা হয়েছে। অনেক অর্জন হয়েছে। খাদ্যের সুষম বণ্টন, স্কুলের বাচ্চাদের জন্য তহবিল নিজেদের সমৃদ্ধির জন্য সরকার কাজ করছে। দারিদ্র্যসীমার নিচের অবহেলিত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করছে সরকার, যাতে তারা স্বাবলম্বী হতে পারে। সুইজারল্যান্ডের প্রতিনিধি সি লওহর বলেন, যারা বিশেষভাবে সক্ষম তারা দুর্বল না। তবে প্রতিবন্ধী কিংবা বিশেষভাবে অক্ষম প্রত্যেক মানুষ যাতে মর্যাদা নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন সে বিষয়ে সবাইকে কাজ করতে হবে। মেক্সিকোর প্রতিনিধি এম ভারগস বারসিলোনা বলেন, আমি এখানে একজন নারী হিসেবে প্রতিনিধিত্ব করছি। আমাদের সংসদ এবং রাজনীতিতে নারীর অংশগ্রহণ রয়েছে তারই এই প্রমাণ। তবে আমাদের দেশে এখনও অনেক সমস্যা রয়েছে। নারী পাচার বন্ধ হয়নি। এমনকি বিধবা নারীদের পুরুষের সঙ্গে থাকতে হয়। এটা খুবই দুঃখজনক। নারীদের সংবিধানে যে অধিকার দিয়ে রেখেছে তা সঠিকভাবে প্রতিপালন হচ্ছে না। সুদানের ই এফ মুনছুর বলেন, মানবাধিকার রক্ষায় প্রতিটি সংসদের দায়িত্ব রয়েছে। মানুষের মৌলিক অধিকার রক্ষার দায়িত্ব রয়েছে। কারণ ইসলাম আমাদের নৈতিকতার শিক্ষা দেয় তাই আমাদের সবাইকে আইপিইউ সদস্য রাষ্ট্র হিসেবে একজোট হয়ে কাজ করতে হবে। রাশিয়ায় আইপিইউ সম্মেলনে ইউক্রেনের আপত্তি ॥ ইন্টার পার্লামেন্টারি ইউনিয়নের (আইপিইউ) ১৩৭তম সম্মেলন রাশিয়ায় অনুষ্ঠানের বিষয়ে ঘোর আপত্তি জানিয়েছে ইউক্রেন। ইউক্রেনের এমপি বি. টারজোক সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। দেশটি চরমভাবে মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আইপিইউ যেসব বিষয় ধারণ করে তা রাশিয়ার মধ্যে নেই। তাই ওই দেশে আইপিইউ সম্মেলন যাতে না হয়, সে বিষয়ে পদক্ষেপ গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। বি. টারজোক আরও বলেন, রাশিয়া ইউক্রেনে লুটতরাজ চালিয়েছে। আমরা তার তীব্র নিন্দা জানাই। রাশিয়া যদি জাতিসংঘের নিয়মগুলো মেনে চলে তাহলে এ সমস্যার সমাধান হতে পারে। তিনি বলেন, আইপিইউ ও জাতিসংঘ মিলে আমরা শান্তিরক্ষা করে চলতে চাই। কিন্তু দুঃখের বিষয় হলো মধ্যপ্রাচ্যসহ পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে শান্তি বিঘিœত হচ্ছে। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে। আমরা প্রতিজ্ঞা করতে চাই আর যেন একটিও মৃত্যু না ঘটে। কোন মানবাধিকার লঙ্ঘিত না হয়। এ বিষয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। অভিবাসন নিয়ে মেক্সিকোর প্রস্তাব ভোটে নাকচ ॥ আইপিইউর এসেম্বলির সাধারণ অধিবেশনে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সমালোচনা করে অভিবাসন সমস্যা সমাধানে মেক্সিকোর দেয়া প্রস্তাবটি ভোটে নাকচ হয়ে গিয়েছে। সেক্রেটারি জেনারেল চুনগং জানান, অভিবাসন নীতি সংক্রান্ত মেক্সিকোর প্রস্তাবে প্রদত্ত ৬০৩ ভোটের মধ্যে ২৫৬টি পক্ষে পড়ে। প্রদত্ত ভোটের দুই-তৃতীয়াংশ পক্ষে না পড়ায় প্রস্তাবটি বাতিল হয়েছে। আইপিইউ সদর দফতরের মুখপাত্র জ্যাঁ মিলিগান জানান, বুধবার এই প্রস্তাবের ওপর একটি রেজ্যুলেশন নেয়া হবে।
×