ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৪ চৈত্র ১৪৩০

নেত্রকোনায় কৃষকের সর্বনাশ

প্রকাশিত: ০৫:১৮, ৪ এপ্রিল ২০১৭

নেত্রকোনায় কৃষকের সর্বনাশ

সঞ্জয় সরকার, নেত্রকোনা থেকে ॥ টানা বৃষ্টি আর উজান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে সৃষ্ট আগাম বন্যায় হাওড়াঞ্চলের কৃষকের সর্বনাশ হয়ে গেছে। সুরমা, ধনু, কংস, সোমেশ্বরী ও মগড়াসহ প্রধান প্রধান নদীর পানি হু হু করে বাড়ছে। ফসল রক্ষাবাঁধ ভেঙ্গে এবং নদী-খাল-বিলের পানি উপচে প্রতিদিনই নতুন নতুন ফসলি এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। বিভিন্ন এলাকার কৃষকরা দিনরাত স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কেটে বাঁধ রক্ষার প্রাণপণ সংগ্রাম করে যাচ্ছে। এদিকে বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবোর) সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সীমাহীন গাফিলতির অভিযোগ উঠেছে। কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগাম বন্যায় মোহনগঞ্জ, খালিয়াজুরি, দুর্গাপুর, কলমাকান্দা, আটপাড়া, মদন, বারহাট্টা ও পূর্বধলা উপজেলায় সোমবার পর্যন্ত আট হাজার চারশ’ ২০ হেক্টর জমির বোরো ফসল তলিয়ে গেছে। এতে নিঃস্ব ও সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে অন্তত ২৬ হাজার তিনশ’ ৩৫টি কৃষক পরিবার। ধান নষ্ট হয়েছে অন্তত ৫২ হাজার ৯২০ টন। প্রতিমণ ৭০০ টাকা করে ধরলে টাকার অঙ্কে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে চার কোটি টাকা। তবে স্থানীয় সূত্রগুলোর মতে, ফসলের পরিমাণ সরকারী হিসাবের দ্বিগুণ হবে। কারণ হাইজদা বাঁধ ভেঙ্গে শুধু মোহনগঞ্জেই ডুবেছে ১০ হাজার হেক্টর জমি। এসব জমির ধান পাকতে আরও অন্তত ১৫-২০ দিন বাকি ছিল। সবেমাত্র ‘ফ্লাওয়ারিং’ ও ‘মিল্কিং’ স্টেজ চলছিল। এদিকে হাওড়াঞ্চলের ফসল রক্ষা বাঁধ রক্ষণাবেক্ষণে পানি উন্নয়ন বোর্ডের সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে সীমাহীন গাফিলতি ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। পাউবো সূত্রে জানা গেছে, এ বছর ৪১টি পিআইসি’র (প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি) মাধ্যমে ২ কোটি ৭৫ লাখ টাকার বাঁধ মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ হয়েছে। এছাড়া ১৪টি প্রকল্পে আরও প্রায় ৬ কোটি টাকার বাঁধ উন্নয়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ কাজ চলমান আছে। কিন্তু ভুক্তভোগীদের অভিযোগ, অনিয়ম, দুর্নীতি এবং সুষ্ঠু তদারকির অভাবে পিআইসির কাজ হয়েছে খুবই নিম্নমানের। এ কারণে বেশিরভাগ বাঁধ এখন হুমকির মুখে। ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে কাজ শেষ করার কথা থাকলেও তা হয়নি। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে বাঁধে মাটি কাটা হয়েছে। এ কারণে বাঁধ টেকসই হয়নি। অন্যদিকে খালিয়াজুরিতে বাস্তবায়নাধীন উন্নয়ন কাজ এখনও চলছেÑ যা শেষ হতে মে-জুন পর্যন্ত সময় লাগবে। কৃষকদের অভিযোগ, বৃষ্টি ও পাহাড়ী ঢলে নদ-নদীর পানি বৃদ্ধি পাওয়ায় এসব কাজ এখন আর খুব একটা ফল বয়ে আনবে না। কাঁচা এবং নরম মাটির বাঁধ নিমিষেই পানির তোড়ে ভেঙ্গে যাওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে। বিশেষ করে খালিয়াজুরী, মদন, মোহনগঞ্জ ও কলমাকান্দা উপজেলার অধিকাংশ বাঁধ এখন হুমকির মুখে। প্রায় সব বাঁধেই পানি ছুঁই ছুঁই করছে। জনরোষের ভয়ে পাউবো’র মাঠ কর্মকর্তাদের তেমন একটা দেখা মিলছে না। এলাকায় মাইকিং করে কৃষকরা স্বেচ্ছাশ্রমে মাটি কেটে ও বস্তা ফেলে ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধগুলো রক্ষার চেষ্টা করছে। এদিকে হাওড়াঞ্চলের ফসল রক্ষায় সব অসম্পূর্ণ বাঁধ দ্রুত মেরামতের দাবিতে সোমবার শহরে বিক্ষোভ মানববন্ধন হয়েছে। বিকেল সাড়ে তিনটায় মোক্তারপাড়া সড়কে ‘আমরা হাওড়বাসীর সন্তান’ ব্যানারে এ মানববন্ধন হয়। ঘণ্টাব্যাপী মানববন্ধন চলাকালে বক্তব্য রাখেনÑ ‘জনউদ্যোগ’ এর আহ্বায়ক কামরুজ্জামান চৌধুরী, রেডক্রিসেন্ট সোসাইটির জেলা শাখার সেক্রেটারি গাজী মোজাম্মেল হোসেন টুকু, সাংবাদিক সঞ্জয় সরকার, ছাত্রলীগ নেতা রবিউল আওয়াল শাওন, নিপুন সরকার বাপ্পা, ফুল মিয়া, লিংকন তালুকদার, নিহাদ ইবনে হেকিম প্রমুখ। টাঙ্গাইল নিজস্ব সংবাদদাতা, টাঙ্গাইল থেকে জানান, মধুপুরে ভারি বর্ষণে জলাবদ্ধতায় হাওদা ও ডাহাবিলের বোরো ধানের জমি তলিয়ে গেছে। কৃষকরা ধান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় হতাশ হয়ে পড়েছে। গত দুই-তিনদিনের বর্ষণে এ ২ বিলের বিস্তীর্ণ এলাকা তলিয়ে যায়। কয়েকশ’ একর বোরো থোর ধানের ক্ষতির আশঙ্কা করছে কৃষকরা। কৃষকরা জানান, চৈত্র মাসের মাঝামাঝিতে গত দুই-তিন দিনে মধুপুরের অরণখোলা ইউনিয়নে ভারি বর্ষণ ও পাহাড়ী ঢলে হাওদা ও ডাহাবিলের কয়েকশ’ একর এক ফসলি জমির বোরো ধান তলিয়ে গেছে। পিরোজপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল্লাহর দেড় বিঘা, নজরুল ইসলামের আট বিঘা, ফজলুল হকের পাঁচ বিঘা, রাধানগর গ্রামের কালু মিস্ত্রির ১০ বিঘা, আকালিয়া বাড়ি গ্রামের ইমাম আলীর ১৪ বিঘা, আব্দুল মান্নানের পাঁচ বিঘা ও আব্দুল কুদ্দুসের দুই বিঘাসহ পিরোজপুর, জটাবাড়ী, কাকরাইদ, আকালিয়া বাড়ি, গাছাবাড়ীসহ কয়েক গ্রামের শত শত কৃষকের আবাদ বোরো থোর ধান তলিয়ে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় তারা হতাশ হয়ে পড়েছে। পিরোজপুর গ্রামের কৃষক আব্দুল্লাহ জানান, বিলে একমাত্র বোরো ধান আবাদ করা যায়। এ ধান নষ্ট হয়ে গেলে আমাদের খাবারের ধানের সঙ্কট দেখা দেবে। পিরোজপুর গ্রামের ফজলুল হক সরকার জানান, এ বিলের মধ্য দিয়ে লম্বা নালা ছিল। কাকরাইদ থেকে দোখলা পর্যন্ত নালাটি ভরাট হয়ে যাওয়ায় বিলের পানি নামতে পারে না। তাই বর্ষণ হলেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয় এবং ধান তলিয়ে যায়। তিনি দ্রুত কৃষকের এ সমস্যার কথা চিন্তা করে খালটি খননের দাবি জানান। বরিশালে নদীভাঙ্গন খোকন আহম্মেদ হীরা, বরিশাল থেকে জানান, সুগন্ধা নদীর আকস্মিক ভাঙ্গনে জেলার বাবুগঞ্জ উপজেলার দক্ষিণ রাকুদিয়া এলাকার বেড়িবাঁধের প্রায় এক হাজার ফুট অংশ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। একই সঙ্গে দেবে গেছে বেড়িবাঁধের সংযোগ সড়ক। ফলে বেড়িবাঁধসংলগ্ন ঢাকা-বরিশাল মহাসড়কে অবস্থিত শত কোটি টাকা মূল্যের বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুটি ঝুঁকির মুখে রয়েছে। সূত্রমতে, শনি ও রবিবার রাতের এ ভাঙ্গনে গৃহহীন হয়ে গ্রামের ৩২টি পরিবার। আরও অর্ধশতাধিক পরিবার তীব্র ভাঙ্গনের মুখে রয়েছে। বেড়িবাঁধ ভেঙ্গে তলিয়ে গেছে ৭০ একর জমির ফসল। রাস্তার বিরাট অংশ আকস্মিক ভাঙ্গনে নদীর বুকে হারিয়ে যাওয়ায় বিপর্যস্ত যোগাযোগ ব্যবস্থা। ওই গ্রামের আইয়ুব আলী মাতুব্বর জানান, গত দুইদিনের আকস্মিক ভাঙ্গনে তার নিজের বসতবাড়িসহ স্থানীয় কনক হাওলাদারের বাড়ির চারটি বসতঘর, আমির আলী হাওলাদার বাড়ির পাঁচটি ঘর, তাহের আলীর বাড়ির চারটি ও খাদেম হোসেনের বাড়ির চারটি বসতঘর, আব্দুল মজিদ, রফিজ উদ্দিন, মোশারেফ মাতুব্বর, মাহাবুব হাওলাদার, কালাম হাওলাদার, আবুল বাশার, ইউনুস হাওলাদার, ইদ্রিস আলী, আনিস হাওলাদার, আবু বক্কর ও গনি হাওলাদারের বসতঘরসহ নদীগর্ভে বিলীন হয়ে গৃহহীন হয়ে পড়েছে ৩২টি পরিবার। অপরদিকে সেতুর পাদদেশ পর্যন্ত বিস্তৃত ওই বেড়িবাঁধের প্রায় এক হাজার ফুটেরও বেশি অংশ ভেঙ্গে যাওয়ায় দক্ষিণবঙ্গের প্রবেশদ্বারে ১০২ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর সেতুটিও এখন হুমকির মুখে। আশঙ্কার কথা স্বীকার করে পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আবু সাঈদ জানান, ইতোমধ্যে ওই এলাকার ভাঙ্গন প্রতিরোধ এবং সেতু রক্ষায় সড়ক ও জনপথ বিভাগের (সওজ) সঙ্গে যৌথভাবে প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। তবে পানি উন্নয়ন বোর্ডের পক্ষ থেকেও জিও ব্যাগ ফেলে ভাঙ্গন প্রতিরোধে পৃথক আরেকটি প্রকল্পের কাজ খুব শীঘ্রই শুরু করা হবে। এ ব্যাপারে স্থানীয় সংসদ সদস্য এ্যাডভোকেট শেখ মোঃ টিপু সুলতান বলেন, সেতুসংলগ্ন দক্ষিণ রাকুদিয়া এলাকায় আকস্মিক ভাঙ্গনের বিষয়টি মোবাইলের মাধ্যমে ঢাকায় বসে জানতে পেরে তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থলে লোক পাঠিয়েছি। নদীভাঙ্গনের বিষয়ে বিগত সংসদ অধিবেশনে আমি জোরালোভাবে উত্থাপন করেছি। ভাঙ্গনরোধ করতে এখন স্থায়ী ও বৃহৎ কয়েকটি প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে। এগুলো অনুমোদনের জন্য প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন। অপরদিকে কীতর্নখোলা নদীর ভাঙ্গন প্রতিরোধে বেড়িবাঁধের দাবিতে মানববন্ধন বিক্ষোভ মিছিল ও স্মারকলিপি পেশ করা হয়েছে।
×