ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৫ এপ্রিল ২০২৪, ১১ বৈশাখ ১৪৩১

হাজারীবাগে ৬৭ বছরের ট্যানারি ব্যবসার অবসান ঘটছে

প্রকাশিত: ০৫:১০, ৪ এপ্রিল ২০১৭

হাজারীবাগে ৬৭ বছরের ট্যানারি ব্যবসার অবসান ঘটছে

বিশেষ প্রতিনিধি ॥ আদালতের নির্দেশে আগামী ৬ এপ্রিলের মধ্যে রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারি কারখানা বন্ধ করে দেবেন মালিকরা। গত রবিবার সংবাদ সম্মেলন করে মালিকরা কারখানা বন্ধ করে দেয়ার কথা জানান। আর তা হলে হাজারীবাগে ৬৭ বছর ধরে চলা ট্যানারি ব্যবসার অবসান ঘটবে। অবশেষে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারি শিল্প স্থানাস্তরের খবরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন এলাকাবাসী। দুর্গন্ধের ‘রাজ্য’ রাজধানীর হাজারীবাগের চামড়া শিল্পনগরীতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বাস করে আসছিলেন এই এলাকার মানুষ। উচ্চ আদালতের নির্দেশে মালিকরা এখন ট্যানারি স্থানাস্তরে প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত। ট্যানারি পল্লীতে বাজছে বিদায়ের সুর। আর এতেই স্বস্তি ফিরছে এলাকাবাসীর। জানা গেছে, ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর নারায়ণগঞ্জে ট্যানারি তথা চামড়া প্রক্রিয়াজাতকরণ কারখানার সূত্রপাত ঘটে। ‘ঢাকা ট্যানারি’ নামের ওই কারখানাটি গড়ে তুলেছিলেন আর বি সাহা নামের এক ব্যবসায়ী। দানবীর হিসেবে পরিচিতি পাওয়া আর বি সাহার হাত ধরে গড়ে ওঠা ‘ঢাকা ট্যানারি’র অস্তিত্ব এখনও আছে। তবে এর মালিকানা বদল হয়েছে কয়েক দফা। নারায়ণগঞ্জে ‘ঢাকা ট্যানারির’ কার্যক্রম চলে প্রায় তিন বছর। এর পর নারায়ণগঞ্জ থেকে ট্যানারি কারখানা স্থানান্তর করে ১৯৫০ সালে রাজধানী ঢাকার হাজারীবাগের বর্তমান ট্যানারি অঞ্চলে আনা হয়। ‘ঢাকা ট্যানারি’র পাশাপাশি সেই সময় হাজারীবাগে কার্যক্রম শুরু করে রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা আরও ২১টি ট্যানারি। এসব ট্যানারির সবকই ছিল তৎকালীন পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণে। এ ট্যানারির মধ্যে ১৯টির নাম জানা গেছে। এগুলো হলো- ইস্ট পাকিস্তান ক্রোম ট্যানারি বা ঢাকা হাইডেন, দিলকুশা ট্যানারি, ইস্ট বেঙ্গল ট্যানারি, পাকিস্তান ট্যানারি, এসএনএ ট্যানারি, ইউনাইটেড ট্যানারি, হাফিজ ট্যানারি, রহমানিয়া ট্যানারি, ন্যাশনাল ট্যানারি, বেঙ্গল ন্যাশনাল ট্যানারি, মাহতাব ট্যানারি, নর্থইস্ট ট্যানারি, ফেরদৌস ট্যানারি, বেঙ্গল কর্পোরেশন, ওরিয়ন ট্যানারি, রাজ্জাক ট্যানারি, পাইওনিয়র ট্যানারি, মাহতাব-২ এবং ওমর ট্যানারি। বাঙালী মালিকানায় থাকা ‘ঢাকা ট্যানারি’ ও রাষ্ট্রীয়ভাবে অধিগ্রহণ করা পাকিস্তানীদের নিয়ন্ত্রণে থাকা ২১টিসহ মোট ২২টি প্রতিষ্ঠান দিয়ে হাজারীবাগে শুরু হওয়া চামড়া শিল্প ধীরে ধীরে জমজমাট হয়ে ওঠে। ১৯৬৬ সালের দিকে তা বেড়ে ২০০ ছাড়িয়ে যায়। দেশ স্বাধীনের পর ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সরকারের অধিগ্রহণ করা ২১টি ট্যানারি বেসরকারী খাতে দিয়ে দেয়া হয়। অবশ্য ১৯৭৬ সালের পর ছোট ছোট কিছু কোম্পানি গড়ে উঠলেও বড় কোন ট্যানারি আর দেশে গড়ে ওঠেনি। বর্তমানে হাজারীবাগে বড়ছোট মিলিয়ে প্রায় সাড়ে ৩০০ ট্যানারি আছে। এর মধ্যে স্বাধীনতার পর গড়ে ওঠা ট্যানারির সংখ্যা ১৫-২০টির বেশি হবে না বলে জানা গেছে। ট্যানারি স্থানান্তরের বিষয়ে গত ১৩ মার্চ বাংলাদেশ ট্যানার্স এ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি শাহীন আহমেদ বলেন, নারায়ণগঞ্জে নদীর পাশে ছিল ট্যানারি। ১৯৫০ সালে সেখান থেকে ট্যানারি সরিয়ে হাজারীবাগে আরেক নদীর পাশে দেয়া হয়। এখন তা সরিয়ে আবারও সাভারে নদীর পাশে দেয়া হয়েছে। এ ইন্ডাস্ট্রি কেন নদীর পাশে দেয়া হয়? ট্যানারি ওয়ার্কার্স ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মালেক বলেন, বর্তমানে হাজারীবাগে বড়ছোট মিলিয়ে সাড়ে ৩০০’র বেশি ট্যানারি আছে। এসব ট্যানারিতে ৩০ হাজারের বেশি শ্রমিক কাজ করেন। আর হাজারীবাগের ট্যানারির ওপর নির্ভর করে প্রায় ৫০ লাখ মানুষের খাওয়া-পরা। এখন হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নেয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। যেহেতু আদালতের নির্দেশ আছে সেহেতু ট্যানারি সরিয়ে নিতেই হবে। তবে হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধ হয়ে গেলে ৫০ শতাংশ শ্রমিক বেকার হয়ে যাবে। অনেক শ্রমিকের বেতন আটকে যাবে। ফিনিশ লেদার (চামড়া) সরবরাহ করা রবিন এন্টারপ্রাইজের মালিক সাইফুল ইসলাম বলেন, আমি প্রায় ২৩ বছর ধরে হাজারীবাগের ট্যানারি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বড় বড় কোম্পানিতে আমি ফিনিশ চামড়া সরবরাহ করি। প্রতিমাসে ৩০ হাজার স্কয়ার ফুট চামড়া সরবরাহ করি। যার মূল্য প্রায় ২৫ লাখ টাকা। হাজারীবাগের ট্যানারি বন্ধ করে দিলে আমার মতো অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী বিপদে পড়বে। তবে গ্যাস সংযোগ দেয়া হলে হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরীতে গিয়ে ব্যবসা করতে সমস্যা হবে না। ২৭ বছর ধরে ট্যানারি কারখানায় কাজ করা গ্রেট ইস্টার্ন ট্যানারির শ্রমিক মোঃ বাদল বলেন, ছোট বয়স থেকেই ট্যানারি কারখানায় কাজ করি। প্রথমদিকে কিছু সমস্যা হতো। এখন আর কোন সমস্যা হয় না। হাজারীবাগের ট্যানারি নিয়ে জীবনের অনেক স্মৃতি রয়েছে। এখন তো আদালত নির্দেশ দিয়েছে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি সরিয়ে নিতে হবে। হাজারীবাগ থেকে ট্যানারি যেখানে সরিয়ে নেয়া হবে আমি সেখানেই কাজ করতে যাব। তিনি বলেন, আমার দুই মেয়ে কলেজে পড়ে। এক ছেলে ও এক মেয়ে স্কুলে পড়ে। ট্যানারিতে কাজ করে যে টাকা পাই তা দিয়ে সংসার চলে। হাজারীবাগে কোন রকমে একটি বাসা ভাড়া নিয়ে থাকি। হেমায়েতপুরে কাজ করতে হলে হাজারীবাগ থেকেই যাতায়াত করতে হবে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই কিছু সমস্যা হবে। আট বছর ধরে হাজারীবাগের ট্যানারিতে কাজ করা আইয়ুব ব্রাদার্সের শ্রমিক মোঃ হারুন বলেন, হেমায়েতপুরে শ্রমিকদের থাকার ব্যবস্থা নেই। যারা কাজ করেন তারা কারখানার ভেতরেই থাকেন। এভাবে পরিবার নিয়ে থাকা সম্ভব নয়। তাই হেমায়েতপুরের চামড়াশিল্প নগরীতে শ্রমিকদের জন্য থাকার ব্যবস্থা করার দাবি জানান তিনি। এলাকাবাসীর স্বস্তি ॥ হাজারীবাগ মানেই কারখানার ধোঁয়া, বাতাসে উৎকট গন্ধ, ড্রেনের পানিতে বিষাক্ত তরল বর্জ্য। ট্যানারি শিল্পের বর্জ্যের তীব্র দুর্গন্ধে এ এলাকায় টেকাই যেন দায়। কড়া দুর্গন্ধে শ্বাস নেয়া হয়ে পড়ে কষ্টকর। এই দুর্গন্ধের ‘রাজ্য’ রাজধানীর হাজারীবাগের চামড়া শিল্পনগরীতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকির মধ্যে বাস করে আসছিলেন এই এলাকার মানুষ। অবশেষে হাজারীবাগ থেকে সাভারে ট্যানারিশিল্প স্থানাস্তরের খবরে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন তারা। শুধু হাজারীবাগের মানুষই নয়; জীবজন্তু, পশুপাখি, পানি, মাটি, বাতাস সবকিছুই যেন বিষে আক্রান্ত। হাজারীবাগে অবস্থিত প্রায় তিন শ’ ট্যানারির কারণে বাতাস আর পানিতে ঘুরছে বর্জ্যের বিষ। এ বিষ হাজারীবাগ, লালবাগ, রায়েরবাজার, জিগাতলা, ধানম-িসহ আশপাশের ১০ বর্গকিলোমিটার এলাকার স্বাভাবিক জীবনযাত্রা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। পরিবেশ অধিদফতরের এক গবেষণায় দেখা যায়, হাজারীবাগ ট্যানারির তরল বর্জ্যের কারণে প্রতিবছর ৪০ কোটি ১৫ লাখ টাকার ক্ষতি হয়েছে। দুই হাজার ৪০৯ কোটি টাকার পরিবেশগত ক্ষতি হয়েছে। হিউম্যান হেলথ এ্যান্ড হিউম্যান ওয়েলফেয়ার কস্ট অব এনভায়রনমেন্টাল পলিউশন ইন্ডাস্ট্রি ইন ঢাকা নামের একটি গবেষণা হয়েছিল ১৯৯৭ সালে। ওই গবেষণায় দেখা যায়, ওই সময়ে স্বাস্থ্য খাতে হাজারীবাগ এলাকার প্রতিটি মানুষের এক বছরে ১৫০ ডলারের সমপরিমাণ ক্ষতি হয়। দূষণের কারণে এলাকার সম্পদ নষ্ট হয়। বাসা ভাড়া কমে যাওয়ার ফলে মোট ৫ হাজার ৩৬৭ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়। বর্তমানে এ ক্ষতির পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি। হাজারীবাগে থাকা সব ট্যানারি আগামী ৬ এপ্রিল থেকে বন্ধ হচ্ছে বলে জানিয়েছে মালিকপক্ষ। আদালতের নির্দেশনা মেনেই তারা ট্যানারি বন্ধের ঘোষণা দিয়েছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৬০ সাল থেকে গড়ে ওঠা রাজধানীর হাজারীবাগের ট্যানারিশিল্প এলাকায় বাজছে বিদায়ের সুর। বর্তমানে ট্যানারি স্থানাস্তরে প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত মালিকপক্ষ। আর এতেই স্বস্তি ফিরেছে এলাকাবাসীর মধ্যে। ওই এলাকার গজমহল, কালুনগর, সোনা টাঙ্গর ও শিকারিটল ঘুরে জানা গেছে, ট্যানারির বর্জ্যের দুর্গন্ধে এখানে বাস করাই ছিল দায়। কিন্তু বাধ্য হয়ে এখানে তাদের বসবাস করতে হতো। ট্যানারি স্থানান্তরের সিদ্ধান্তে এখন এলাকাবাসীর মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। ট্যানারি বর্জ্যের কারণে যুগ যুগ ধরে এলাকা দূষিত হয়েছে। অথচ এজন্য দায়ী একশ্রেণির ব্যবসায়ী, তারা শুধু মুনাফার চিন্তা করেছেন। এখানের বাসিন্দাদের কথা তারা ভাবেননি। বাসিন্দারা শুধু শারীরিক নয়, নিয়মিত আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এই এলাকায় ৩০ বছরের বেশি সময় ধরে বসবাস করছেন রিয়াজুল ইসলাম। তিনি বলেন, নিজের কর্মক্ষেত্রের জন্য এ এলাকায় বাধ্য হয়ে থাকতে হয়। যুগ যুগ ধরে হাজারীবাগ-লালবাগের ট্যানারি এলাকায় সুষ্ঠু কোন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ছিল না। ট্যানারি এলাকাজুড়ে বর্জ্যের দূষণ নিয়ন্ত্রণে এবং বর্জ্য পরিশোধনের কোন প্ল্যান্টও ছিল না। যে যার মতো করে বর্জ্য ফেলেছে। ফলে এলাকার পরিবেশ দূষিত হয়েছে। মালিকপক্ষের এ নিয়ে কোন মাথাব্যথা ছিল না। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্ত হতাম আমরা। এখন ট্যানারিগুলো স্থানান্তর হচ্ছে- এর চেয়ে বড় সুখবর আমাদের জন্য আর কী হতে পারে! বাসিন্দা ফরিদা আক্তার বলেন, কারখানার বিষাক্ত ধোঁয়ায় পুরো এলাকা আচ্ছন্ন হয়ে যেত। একটি স্টিলের আলমারি কেনার এক মাসের মধ্যে জং ধরে যায়। টিনের ঘরের চালগুলোও ধূসর বিবর্ণ হয়ে যায়। শুধু টিন নয়, পুরো হাজারীবাগ এলাকার মানুষ, মাটি, পানি ও বাতাস বিষে আক্রান্ত হয়ে পড়ে। ছোট শিশুরাও বিভিন্ন সময় নানা রোগে আক্রান্ত হয়। এসব কিছু বিবেচনা করে ট্যানারি স্থানান্তরের সিদ্ধান্ত আমাদের মধ্যে স্বস্তি ফিরে এসেছে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) রিভার কিপার শরীফ জামিল আশঙ্কা প্রকাশ করে বলেছেন, যে দূষণ ঘটেছে, তাতে ট্যানারি সরিয়ে নেয়ার কয়েক যুগ পরও সেখানে দূষণ থাকবে। এর পরও স্থানীয়দের দাবি, যত দ্রুত সম্ভব ট্যানারি সাভারে স্থানান্তর করা হোক।
×