ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২০ এপ্রিল ২০২৪, ৭ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইকবাল হুসাইন

পাঠ্যপুস্তক হেফাজতীকরণ ও আওয়ামী লীগের ‘কাউয়া’

প্রকাশিত: ০৩:৪৪, ৪ এপ্রিল ২০১৭

পাঠ্যপুস্তক  হেফাজতীকরণ ও আওয়ামী লীগের ‘কাউয়া’

খবরটি প্রথম পাই এক বন্ধুর নিকট থেকে। এনসিটিবির ২০১৭ সালের পাঠ্যপুস্তকে হেফাজতের দাবির শতভাগ প্রতিফলন ঘটেছে। হেফাজত প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের বিভিন্ন শ্রেণীর বাংলা বই থেকে ১৩টি গল্প ও কবিতা বাদ দেওয়ার দাবি করেছিল। নতুন বই থেকে তাদের দাবিকৃত ১৩টি গল্প/কবিতাই তুলে দেওয়া হয়েছে। খবরটিকে প্রথমে কেবল বিস্ময়কর নয়, অবিশ্বাস্য বলে মনে হয়েছে। আর যাই হোক, শেখ হাসিনার সরকার হেফাজতের কাছে আত্মসমর্পণ করতে পারে না! কিন্তু শেষ পর্যন্ত বন্ধুর খবরটিকে বিশ্বাস করতেই হলো। হেফাজতের আপত্তি জানানো সব গল্প-কবিতা বিভিন্ন শ্রেণীর বাংলা বই থেকে তুলে দেওয়া হয়েছে! আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে সরকার গঠনের পর ২০১০ সালে নতুন শিক্ষানীতি প্রবর্তন করে। নতুন এ শিক্ষানীতির আলোকে প্রণীত হয় প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শিক্ষার নতুন পাঠ্যক্রম। এ পাঠ্যক্রমের মূল লক্ষ্য ছিল কর্মমুখী, যুগোপযোগী এবং যুক্তিবাদী ও বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষা নিশ্চিত করা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়াও এর অন্যতম লক্ষ্য ছিল। নৈতিক মূল্যবোধ গঠন এবং মুক্তচিন্তা এবং সৃজনশীল কর্মকাণ্ডে উদ্বুদ্ধ করা ছিল এ পাঠ্যক্রমের বিশেষ উদ্দেশ্য। এসব লক্ষ্য এবং উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে পাঠ্যপুস্তক থেকে জোট-আমলের ধর্মভিত্তিক এবং সাম্প্রদায়িক গল্প-কবিতাগুলো বাদ দেওয়া হয়। প্রতিস্থাপিত হয় চমৎকার কিছু নতুন গল্প-কবিতা। কিন্তু সরকার চার বছরের মধ্যেই তার অবস্থান বদল করল। হেফাজতের আস্ফালনের কাছে মাথা নত করল সরকার। পাঠ্যবই থেকে যেসব গল্প-কবিতা তুলে দেওয়া হয়েছে সেগুলোর বিরুদ্ধে হেফাজত হিন্দুত্ববাদ এবং নাস্তিক্যবাদের অভিযোগ তুলেছিল। হুমায়ুন আজাদের ‘বই’, গোলাম মোস্তফার ‘প্রার্থনা’, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ‘বাংলাদেশের হৃদয়’, কাজী নজরুল ইসলামের ‘বাঙালির বাংলা’, সত্যেন সেনের ‘লাল গরুটা’ লালন সাঁইয়ের ‘সময় গেলে সাধন হবে না’, জ্ঞানদাসের ‘সুখের লাগিয়া’, জসীম উদদীনের ‘দেশ’, ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের ‘আমার সন্তান’, রঙ্গলাল বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘স্বাধীনতা’ ইত্যাদি লেখার বিরুদ্ধে হেফাজত তার নিজস্ব ব্যাখ্যামতে উপর্যুক্ত অভিযোগ তোলে। ২০১৩ সালে হেফাজতে ইসলামের পক্ষ থেকে প্রথম যখন এসব অভিযোগ তোলা হয় তখন এনসিটিবির সদস্য অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ আবদুল মান্নান একটি চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, ‘পাঠ্যপুস্তকের বাংলা বইগুলো ধর্ম, সমাজ কিংবা বিজ্ঞান শেখানোর জন্য নয়। এগুলো ভাষা ও সাহিত্য শেখানোর বই। ভাষা শিক্ষার জন্য যেসব লেখা থাকা দরকার তাই দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ও নৈতিক শিক্ষা হচ্ছে ধর্ম শেখানোর বই। সেখানে ধর্ম শেখানোর জন্য যা দরকার তা আছে।’ তিনি তখন জোর দিয়ে বলেছিলেন, কেবল ইসলাম নয়, কোন ধর্মকেই হেয় করা হয় এমন একটি শব্দও পাঠ্যপুস্তকে ব্যবহার করা হয়নি। অধ্যাপক মান্নান আরও বলেছিলেন, ‘আমাদের দুটি সংস্কৃতি। একটি ধর্মীয়, অপরটি জাতিগত। যখন জাতিগত সংস্কৃতির কথা আসবে তখন হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতির কথাই আসবে।’ জোট সরকারের সাম্প্রদায়িক পাঠ্যক্রম থেকে বেরিয়ে আসার ক্ষেত্রে উপর্যুক্ত ব্যাখ্যাটি নিঃসন্দেহে যৌক্তিক এবং গ্রহণীয়। কিন্তু ২০১৭ সালে সংঘটিত হেফাজতী পরিবর্তন বিষয়ে উক্ত সদস্যের মতামত জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এখন চাইলেও অনেক কিছু করা সম্ভব নয়।’ তার মানে দাঁড়াচ্ছে, গত চার বছরে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী রাজনীতি আরও শক্তিশালী হয়েছে। কিন্তু শেখ হাসিনার সরকারের সময় বাংলাদেশের এ অধঃগতি কোনভাবেই কাক্সিক্ষত নয়। পাঠ্যপুস্তকে অনাকাক্সিক্ষত কিছু ভুল নিয়ে গণমাধ্যমে বিস্তর লেখালেখি হয়েছে। এ নিয়ে সরকার একটি তদন্ত কমিটিও গঠন করেছে। তদন্ত কমিটি ভুলের জন্য এনসিটিবির কয়েকজনকে প্রাথমিকভাবে দোষী সাব্যস্ত করেছে। কিন্তু অসাম্প্রদায়িক, দেশাত্মবোধক এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতির চেতনাবাহী লেখাগুলো বাদ দেওয়ার বিষয়ে খুব বেশি শোরগোল হয়নি। সরকারও এ বিষয়ে মৌনব্রত পালন করেছে। কিন্তু হেফাজতের কথিত ‘হিন্দুত্ববাদী’ ও ‘নাস্তিক্যবাদী’ লেখা বাদ দেওয়ার বিষয়ে সরকারের সুস্পষ্ট বক্তব্য দেওয়া উচিত। হয় সরকারকে বলতে হবে, হেফাজতের বক্তব্যের সঙ্গে তারা একমত এবং সে কারণেই পাঠ্যপুস্তক থেকে লেখাগুলো তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুবা বিশেষ কোন ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর ষড়যন্ত্রে এটি হয়েছে। সেক্ষেত্রে তাদেরকে চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে এবং আগামী বছরের নতুন পাঠ্যপুস্তকে বাদ পড়া লেখাগুলো পুনর্বহাল করতে হবে। আওয়ামী লীগের একটি নিজস্ব রাজনৈতিক আদর্শ আছে। আর তা হচ্ছে অসাম্প্রদায়িকতা ও ধর্মনিরপেক্ষতা। গণতান্ত্রিক এবং অসাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতেই বঙ্গবন্ধু আজীবন সংগ্রাম করেছেন। যারা আওয়ামী লীগকে পছন্দ করেন তারা এ আদর্শের কারণেই করেন। আবার যারা বিরোধিতা করেন তারা মূলত এ আদর্শেরই বিরোধিতা করেন। এ আদর্শকে সামনে রেখেই আওয়ামী লীগ সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল এবং মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্ব দিয়েছিল। ১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে বিজয়ী হতে এ আদর্শের সঙ্গে আপস করতে হয়নি। তাহলে এখন কেন নতজানু হতে হবে? যদি কেউ মনে করে থাকেন, হেফাজতীকরণে আওয়ামী লীগের ভোট বাড়বে, আমরা মনে করি তিনি বোকার স্বর্গে বাস করছেন। জামায়াত, হেফাজত এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী কোন ব্যক্তি বা সংগঠন কখনও আওয়ামী লীগকে ভোট দেয়নি, ভবিষ্যতেও দিবে না। এমনকি আওয়ামী লীগ যদি এমন ঘোষণাও দেয় যে, আল্লামা শফিকে রাষ্ট্রপতি করা হবে, তবুও জামায়াত-হেফাজতের একটি ভোটও তারা পাবে বলে মনে করার কোন কারণ নেই। আমরা আগেও বলেছি, হেফাজত একটি ভুঁইফোঁড় সংগঠন। জামায়াতের সঙ্গে তাদের কোন পার্থক্য নেই। ২০১৩ সালের আগে দেশের বেশিরভাগ মানুষ এ সংগঠনের নাম পর্যন্ত জানত না। ২০১৩ সালের ৫ মে যখন মতিঝিল দখল করে তাণ্ডবলীলার মাধ্যমে সরকারকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছিল, তখন মাত্র দেড়ঘণ্টার অভিযানে তারা বুড়িগঙ্গা পার হয়ে গিয়েছিল। অথচ তখন আঠারো দলীয় নেত্রী বেগম খালেদা জিয়া সবাইকে তাদের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানিয়েছিলেন। হেফাজতী লেবাসে জামায়াত-শিবির সরাসরি মতিঝিলে অবস্থান নিয়েছিল। জাতীয় পার্টি রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে খাবার-পানি সরবারহ করেছে। বাংলাদেশের বৃহৎ কয়েকটি রাজনৈতিক দলের সমর্থন ও সহযোগিতা থাকার পরেও রাতের আধারেই তারা গর্তে ঢুকে গেল। অথচ ২০১৭ সালে এসে সরকার তাদের দাবির কাছে আত্মসমর্পণ করল। গত পাঁচ বছরে হেফাজত শক্তিশালী হয়েছে নাকি সরকার দুর্বল হয়েছে, সেটিই এখন বড় প্রশ্ন। কেবল জামায়াত-হেফাজত নয়, ধর্মভিত্তিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী কেউই আওয়ামী লীগের অসাম্প্রদায়িক আদর্শের সহযাত্রী নয়। এমনকি তথাকথিত উলামা লীগও নয়। কেবল অমুসলিম বলে উলামা লীগ বর্তমান প্রধান বিচারপতি এস. কে সিনহার নিয়োগের প্রকাশ্য বিরোধিতা করেছে। তারা সুপ্রীমকোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ন্যায়বিচারের প্রতীক ভাস্কর্য সরিয়ে ফেলার আল্টিমেটাম দিয়েছে। হেফাজতের চিন্তা, আদর্শ এবং দাবি-দাওয়ার সঙ্গে উলামা লীগের বিশেষ কোন পার্থক্য আছে বলে মনে হয় না। আওয়ামী লীগের কোন কোন নেতা দু’একবার প্রকাশ্যেই বলেছেন, আওয়ামী লীগের সঙ্গে উলামা লীগের কোন সম্পর্ক নেই। কিন্তু সম্পর্ক পুরোপুরি ছিন্ন করার মতো ঝুঁকিও আওয়ামী লীগ নিচ্ছে না। এখানেও ‘ভোট পলিটিক্স’! আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সম্প্রতি দলে ‘কাউয়া’ ঢুকেছে বলে মন্তব্য করেছেন। এ কাউয়া কেবল আওয়ামী লীগে নয়, সরকারে, ছাত্রলীগে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী পেশাজীবী সংগঠনে এমনকি বুদ্ধিজীবী মহলেও অবাধ বিচরণ করছে। এ কাউয়ারাই সরকারকে বিভ্রান্ত করে পাঠ্যপুস্তককে হেফাজতীকরণ করে। ছাত্রলীগের কাউয়ারা কেবল চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি নয়, পহেলা বৈশাখে মিলাদ মাহফিলের মতো কর্মকাণ্ডের আয়োজন করে। আওয়ামী লীগের মাঠপর্যায়ে কাউয়াদের প্রভাবে আদর্শবাদী ত্যাগী নেতা-কর্মীরা কোণঠাসা। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী পেশাজীবী সংগঠন এবং বুদ্ধিজীবী মহলেও একই অবস্থা। সুবিধাবাদীরা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে সর্বত্র। ফলে সরকারের নজিরবিহীন উন্নয়নের পরেও আওয়ামী লীগের জনপ্রিয়তার পারদ নিম্নমুখী। কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন সে বার্তাই প্রদান করছে। কাউয়াদের চিহ্নিত এবং বিতাড়িত করা না গেলে ২০১৯ সালের নির্বাচনেও চরম মূল্য দিতে হতে পারে। সন্ত্রাস এবং জঙ্গীবাদ দেশের জন্য বিরাট এক হুমকি। কেবল বাংলাদেশে নয়, গোটা বিশ্বই এখন সন্ত্রাস, জঙ্গীবাদ, মৌলবাদ এবং উগ্র সাম্প্রদায়িকতার হুমকিতে রয়েছে। সরকার সর্বোচ্চ আন্তরিকতা দিয়ে চেষ্টা করছে এটি প্রতিরোধ করতে। কিন্তু কাজটি মোটেও সহজ নয়। কেবল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা শক্তি প্রয়োগ করে এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। সামাজিক সচেতনতার পাশাপাশি প্রয়োজন সঠিক শিক্ষা। কেবল ধর্মভিত্তিক শিক্ষা যেমন মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতা রুখতে পারে না, তেমনি নীতি, সংস্কৃতি, আদর্শ ও চেতনাবিহীন শিক্ষাও সুনাগরিক গড়ে তুলতে পারে না। নৈতিক শিক্ষার সঙ্গে সঙ্গে প্রয়োজন শেকড়-সন্ধানী শিক্ষার। যে শিক্ষা যুক্তি এবং আলোর পথ দেখায়, যে শিক্ষা দেশপ্রেম ও মানবপ্রেম শেখায় কেবল সে শিক্ষাই পারে জঙ্গীবাদ রুখতে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাদ দিয়ে কিংবা দুর্বল করে কোন পাঠ্যক্রম তৈরি হতে পারে না। এখানে অসাম্প্রদায়িক আদর্শের পাশাপাশি হাজার বছরের বাঙালী সংস্কৃতিও এক অমূল সম্পদ। এ সম্পদই আমাদের শক্তি। শিক্ষার প্রতিটি স্তরে এ শক্তির চর্চা ও প্রয়োগ ঘটাতে হবে। জামায়াত-হেফাজত এবং কাউয়ারা সম্মিলিতভাবে আমাদের তিমির-বিনাশী শক্তিকে দুর্বল করতে তৎপর। এর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে আমাদেরকেই। লেখক : সহকারী অধ্যাপক, বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় [email protected]
×