ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৯ এপ্রিল ২০২৪, ৬ বৈশাখ ১৪৩১

আবহাওয়া বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা : এবার হবে উষ্ণতম বছর

গ্রীষ্মে ভয়াবহ খরার কবলে পড়তে পারে বাংলাদেশ ॥ প্রকৃতিতে এল নিনোর প্রভাব

প্রকাশিত: ০৫:৪১, ৩ এপ্রিল ২০১৭

গ্রীষ্মে ভয়াবহ খরার কবলে পড়তে  পারে বাংলাদেশ ॥ প্রকৃতিতে এল নিনোর প্রভাব

সমুদ্র হক ॥ আকাশের মেঘের আচরণও বিরূপ। মেঘ দেখে কিছু বলা যায় না। চৈত্রের শেষ ভাগে কখনও বর্ষার মেঘ, কখনও শীতের কুয়াশা। আবার সাদা মেঘে দাবদাহ। তবে আগুনে হাওয়া নয়। এর মধ্যেই ঠা-া। যা চৈত্রের চিরচেনা পরিচয় নয়। আবহাওয়াবিদদের কথা : এটা বিকিরণজনিত ঠা-া। বঙ্গোপসাগর থেকে বাতাস আসছে না। আসছে উত্তর পশ্চিম কোণ থেকে। ঠা-া হলেও শুষ্ক। এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের ইন্টারন্যাশনাল রিসার্চ ইনস্টিটিউট এক অশনিসঙ্কেত দিয়েছে : বিশ্বে সর্বোচ্চ উষ্ণায়নের বছর হবে এবার। যার ভয়াবহ প্রভাব পড়বে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোতে। বাংলাদেশ ও ভারতে এ যাবতকালের সর্বোচ্চ তাপপ্রবাহ বইতে থাকবে, হবে দীর্ঘস্থায়ী। ভারতের আবহাওয়া গবেষণা বিভাগ ইতোমধ্যে তীব্র দাবদাহের সতর্কতা দিয়েছে। যা ৫০ ডিগ্রী সেলসিয়াস অতিক্রম করতে পারে। বাংলাদেশেও দাবদাহের সঙ্গে দেখা দেবে তীব্র খরা। কিছুদিন ধরেই বাংলাদেশের আবহাওয়া অনেকটাই মরু অঞ্চলের মতো। তারওপর বৈশ্বিক উষ্ণতার আভাস আরও খানিকটা ভাবিয়ে তুলেছে। দেশে বর্তমানে কোন ঋতুই ঠিকমতো চেনা যায় না। শীতের প্রতীক্ষা কোন ফল দেয়নি। মাঘ এসেছিল চেনা যায়নি। চৈত্রের প্রথম সপ্তাহে বর্ষা। ক’বছর ধরেই বর্ষার প্রাণ নেই। শরত হেমন্ত ঋতু এখন শুধু কাব্যে। গ্রীষ্মটা একটু জানান দেয়। এবারের গ্রীষ্মের দাবদাহ কোন পর্যায়ে গিয়ে ঠেকে তা ভাবছেন জলবায়ুর বিজ্ঞানীরা। প্রকৃতির স্বাভাবিক চিত্র ক্রমেই সরে যাচ্ছে। দিনে দিনে উষ্ণ হচ্ছে বায়ুম-ল। যত দ্রুত উষ্ণতা বাড়ছে গত হাজার বছরেও তা বাড়েনি। বিজ্ঞানীরা যে ভয়ঙ্কর তথ্য দিয়েছেন তা হলো : গ্রীষ্মম-লীয় পর্যায়বৃত্ত পরিবর্তনে (যাকে বলা হয় এল নিনো) সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা অন্তত এক মিটার বেড়ে তাপমাত্রা বিশ্বের বি পজ্জনক মাত্রার একেবারে কাছাকাছি পৌঁছে যাবে। ডেকে আনবে বড় ধরনের বিপর্যয়। যুক্তরাষ্ট্রের ইনস্টিটিউট ফর ক্লাইমেট এ্যান্ড সোসাইটির ক্লাইমেট প্রেডিকশন সেন্টার এবং ভারতের এ ধরনের কয়েকটি কেন্দ্র জানাচ্ছে চলতি বছর হবে ইতিহাসের সবচেয়ে উষ্ণ বছর। এদিকে বিশ্ব আবহাওয়া সংস্থার খবর : চলতি বছর আগের সকল সময়ের চেয়ে তাপমাত্রা গড়ে ১ দশমিক ২ ডিগ্রী বেড়ে যেতে পারে। সংস্থার মহাপরিচালক বলেন, বৈশ্বিক উষ্ণতার মাত্রা প্রতিবছর একটু করে বাড়ছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার এমন অবস্থা থাকলে নিকট দিনে অনেক প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের মুখে পড়তে হবে। যা হতে পারে ভয়ঙ্কর। মার্কিন ন্যাশনাল এ্যারোনটিকস এ্যান্ড স্পেস এ্যাডমিনিস্ট্রেশন (নাসা) ও ন্যাশনাল ওসেনিক এ্যান্ড এটমোসফেরিক এ্যাডমিনিস্ট্রেশনের (নোয়া) ক্লাইমেট ডাটা সেন্টার চলতি বছরকে বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি তাপমাত্রার আভাস দিয়েছে। যার প্রভাবে দক্ষিণ পূর্ব এশিয়ার দেশগুলো বিশেষ করে বাংলাদেশ ভারত নেপাল শ্রীলঙ্কায় কৃষি ভূমি, জীববৈচিত্র্য, রোগব্যাধিসহ নানা বিপর্যয়ের মুখে পড়তে পারে। দীর্ঘ খরার কবলে পড়ে ফসল উৎপাদনে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। সেচের পানি উত্তোলন সহজ হবে না। পানির স্তর যার পর নেই নিচে চলে যাবে। প্রভাব পড়বে কৃষির আবাদে। ভূগর্ভ থেকে সুপের পানি প্রাপ্তি স্বাভাবিক পর্যায়ে থাকবে না। এই অবস্থায় সবচেয়ে ভয়াবহ সঙ্কটে পড়বে রাজধানী ঢাকা মহানগরী ও আশপাশের মানুষ। বিজ্ঞানীরা বলছেন, উষ্ণতার সবচেয়ে বড় কারণ বিশ্বজুড়ে বায়ুম-লে কার্বন নিঃসরণ। তা যে শুধু জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যাপক ব্যবহার এবং বনভূমি হ্রাস, গ্রিনহাউস এফেক্টে জলবায়ুর পরিবর্তন হচ্ছে তা নয়। গ্রীষ্মম-লীয় এল নিনোর প্রভাবেও এমনটি হচ্ছে। আর লা নিনা হলো তার উল্টোটা। চলতি বছর বৈশ্বিক আবহাওয়ার তীব্র উষ্ণতার চরম বিপর্যয়ের অন্যতম কারণ হলো এল নিনো। এই এল নিনোর প্রভাবে প্রশান্ত মহাসাগর, ভারত মহাসাগর ও বঙ্গোপসাগরের পানি বর্তমানের চেয়ে এক ডিগ্রী সেলসিয়াসেরও বেশি গরম হয়ে উঠবে। এ বছর জানুয়ারিতে যখন শীত থাকার কথা তখন গড় তাপমাত্রা অন্য যে কোন সময়ের চেয়ে বেশি ছিল। যে কারণে তখন শীত অনুভূত হয় কম। বলাবলি হয় শীত এবার নেই। শীত না থাকার কারণ হলো, বৈশ্বিক উষ্ণতার এল নিনোর প্রভাব। গত শতকের এই সময়ের তাপমাত্রা পর্যালোচনা করে জানা যায়, গত বছর তাপমাত্রা ১ দশমিক ২২ ডিগ্রী সেলসিয়াস বেশি ছিল। চলতি বছর (২০১৭) এই তাপমাত্রা আরও বাড়তে পারে। দেশে তাপমাত্রা বেড়ে যাওয়ার এক রেকর্ড থেকে জানা যায়, ১৯৭২ সালের মে মাসের শেষে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ৪৫ দশমিক ১ ডিগ্রী সেলসিয়াস ছিল রাজশাহীতে। এর ২৩ বছর পর ১৯৯৫ সালের এপ্রিলে ছিল ৪৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। ২০০৯ সালের এপ্রিল শেষে ছিল ৪২ দশমিক ৩ ডিগ্রী সেলসিয়াস। গত বছর সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৪৫ ডিগ্রী সেলসিয়াস। জলবায়ুর পরিবর্তনে এল নিনোর প্রভাবে এ বছর অতীতের সকল রেকর্ড ভেঙ্গে দিতে পারে। ভয়াবহ খরা দেখা দিতে পারে উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে। উত্তরাঞ্চলের বৈশিষ্ট্য হলো শীতের সময় যেমন শীত গ্রীষ্মেও তেমনই গরম। এ বছর কৃষি প্রধান উত্তরাঞ্চল খরার কবলে পড়লে তা কাটিয়ে উঠতে কৃষি ও পানি ব্যবস্থাপনার সঙ্গে যুক্তদের আগে থেকেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়ার তাগাদা দিয়েছেন আবহাওয়া বিজ্ঞানীরা।
×